দিগন্তজোড়া আমনের মাঠ। আর সেই মাঠের কাচা ধান দেখে শুরুতে কৃষকের মুখে হাঁসি ফুটেছিল। কিন্তু ধান সোনালী রূপ নিলেই কৃষকের মুখের হাঁসি মলিন হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ছোবলে একদিকে উৎপাদন কম হয়েছে, অপরদিকে বাজারদরও মন্দা। ফলে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ১৮ হাজার আমন চাষী দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এদিকে, সরকারিভাবে ধান কেনাও এখনো শুরু হয়নি। তাই ধারদেনা, দাদন কিংবা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে লোকসান দিয়েই কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। অপরদিকে কৃষি বিভাগের দাবি, সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু হলেই বাজারদর বেড়ে যাবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে ৩৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে উফশী ২২ হাজার এবং স্থানীয় জাতের ১৩ হাজার ৫০০ হেক্টর। এতে আমনের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে। তবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্র প্রতি হেক্টরে উফশীর ৩ দশমিক ৫ মেট্রিকটণ এবং স্থানীয় জাতের ২ দশমিক ৫ মেট্রিকটণ নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ছোবলে ১৫ শতাংশ ফসলের ক্ষতি হওয়ায় প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয়েছে উফশী ৩ দশমিক ৪ মেট্রিকটণ ও স্থানীয় জাতের ২ দশমিক ৩ মেট্রিকটণ। এরফলে শতকরা প্রায় ১৫ শতাংশ ফসল উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষি বিভাগ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাজারদর কম থাকলেও কেউ ধানের দাম বাড়ার আশায়, কেউ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে ফসল গোলায় তুলতে ব্যস্ত। ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের ধান কাটা শুরু হয়। সেই ধান আঁটি বেঁধে বাড়ির উঠান কিংবা নির্ধারিত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মড়াই করে রোদে শুকানো হয়। এসব কাজে কৃষাণের পাশাপাশি কৃষাণীরাও ব্যস্ত সময় পার করছে। পরিবারের বাকি সদস্যরাও কাজে নেমে পড়ছে। তবে বর্তমানে ধানের বাজারদর কম থাকায় তাদের এই শ্রম বৃথা হয়ে যাবে না তো, এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কৃষক পরিবারের মুখে। স্থানীয় কৃষকদের তথ্যমতে, বর্তমান বাজারে প্রতিমণ ধানের দর ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। ধানের এ মূল্য এখনকার বাজারে দুই কেজি পেঁয়াজের সমান। তাই বাজারে ধানের এ দামে লাভতো দূরের কথা, শ্রমিকের মজুরিই উঠছে না। আর শ্রমমূল্য আর উৎপাদন খরচো বাদই।
কৃষি বিভাগ জানায়, উপজেলার ১৮ হাজার ১৩ জন কৃষক এবার আমন চাষাবাদ করেছে। এরমধ্যে কৃষক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ৪ হাজার কৃষকের কাছ থেকে ২ হাজার ৮৩৩ টণ ধান ক্রয় করবেন সরকার। প্রতি মণ ধানের মূল্য ১ হাজার ৪০ টাকা এবং প্রতিকেজি ২৬ টাকা। একজন কৃষক সর্বোচ্চ ৩ হাজার কেজি এবং সর্বনি¤œ ১২০ কেজি ধান বিক্রি করতে পারবে। শর্ত অনুযায়ী শুকনো ও চিটামুক্ত ধান খাদ্যগুদামে বিক্রি করতে পারবে নির্ধারিত কৃষক। এ শর্ত মেনে ধান বিক্রি করলে কৃষকের ব্যাংক একাউন্টে টাকা পরিশোধ করা হবে।
কৃষকরা বলছেন, এ উপজেলায় চারভাগের মাত্র একভাগ কৃষকের ধান কেনা হবে সরকারিভাবে । তাও এখনও বেচাকেনা শুরু হয়নি। তাছাড়া নানা শর্তের জটিলতার কারণে অনেক কৃষক সরকারিভাবে ধান বিক্রি করতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান খালিদ বিন ওয়ালিদ বলেন, ‘শুধু চার হাজার কৃষকের নয়, বাকি কৃষকদের কাছ থেকেও সরকারিভাবে ধান কেনার দাবি জানান তিনি। এছাড়া সরকারিভাবে ধান কেনার প্রক্রিয়া কৃষকদের কাছে জটিল। তাই কৃষকদের সুবিদার্থে ধান কেনার পদ্ধতিটি সহজ করা হলে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হবে বলেও মনে করেন তিনি।’
উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কাউখালী গ্রামে গিয়ে কথা হয় প্রান্তীক কৃষক আব্দুর রশিদের (৪০) সঙ্গে। আঁটি বেঁধে দুই ছেলেকে নিয়ে ধান গোলায় তুলতে ব্যস্ত তিনি। এর ফাঁকে আব্দুর রশিদ বলেন, ‘ধারদেনা করে দেড় একর জমিতে আমন দিছি। এহন (এখন) ধান কাটতে রোজ ৫০০ টাহায় (টাকায়) একজন রোষ্ঠিয়ার (শ্রমিকের) মজুরি দিতে হয়। অথচ একমণ ধানের দামই বাজারে ৫০০-৫৫০ টাহা।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘গতবারও ধানে লোকসান দিছি। এইবারও লোকসান দিতে ওইবে (হবে)।’ আব্দুর রশিদের কথার সঙ্গে যোগ করে ওই গ্রামের কৃষক আবু মুন্সি বলেন, ‘ধান দিয়া লাভ কি? আগামীতে ধানই দিমু না। প্রতিবছর লোকসান ওয়। এবার ধানের যে দামÑ লোনের (ঋণের) জ্বালায় অনেক কৃষকের এলাকা ছাড়তে ওইবে।’
আব্দুর রশিদ ও আবু মুন্সির কথায় সহমত পোষণ করে কৃষক হোসেন মুন্সি, ইব্রাহিম মুন্সি, মিরাজ ও ছলেমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে ধান চিটা হয়ে গেছে, ঝরে পড়েছে। তাই ফসল ভাল হয়নি। এরমধ্যে বাজারদরও খারাপ। ধান কিনতে ব্যাপারীরাও আসছে না। আর সরকারিভাবেও নির্ধারিত কিছু কৃষকের ধান কিনবে, তাও পর্যাপ্ত নয়। সরকারিভাবে ধান কেনার যে পদ্ধতি, তা মেনে অনেক কৃষকই ধান বিক্রি করতেই পারবে না। এছাড়া ধান কেনা এখনও শুরু না হওয়ায় দাদন কিংবা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে অনেক কৃষক বর্তমান বাজারের কম দামেই ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।’ কৃষকদের দাবি, কৃষকদের সুবিদার্থে সরকারিভাবে ধান কেনার পদ্ধতি সহজ করে সকল কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা হোক।
জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বে) আব্দুল মান্নান বলেন, ‘দুই একদিনের মধ্যেই সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু হবে। লটারি হয়ে গেছে। আশা করছি, সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু হলেই বাজারদরও বেড়ে যাবে। আর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের শিগগরই সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হবে।’ এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান বলেন, ‘প্রতারক চক্র, সিন্ডিকেট কিংবা দালালদের খপ্পরে পড়ে কৃষকরা যাতে প্রতারিত না হয়, এজন্য প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি নায্যমূল্যে ধান কিনবে সরকার। এতে সুবিধাভোগী কৃষকরা লাভবান হবে বলে আশা করছি।