আগামীকাল ১১ ডিসেম্বর বুধবার, পাক-হানাদারমুক্ত হয়েছিল ফেঞ্চুগঞ্জ। তাই এই দিনটিকে ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করে আসছে উপজেলাবাসী। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী আক্রমনে ফেঞ্চুগঞ্জ পাকিস্থানী হানাদার ও রাজাকার মুক্ত হয়েছিল সেদিন। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে মুক্তিকামী মানুষের জন্য এই দিনটি একদিকে আনন্দের ও অন্যদিকে বেদনার। স্বস্থির নিঃশ্বাস নিয়ে মুক্তিকামি মানুষ লাল সবুজের পতাকা হাতে তাঁরা আনন্দ মিছিল করেছিল ফেঞ্চুগঞ্জে। তবে মুক্তিকামি অসহায় নিরীহ মানুষদের ধরে এনে কাইয়ার গোদামের ভিতরে ও ইলাশপুর ঢালার ব্রীজে চালাতো নির্যাতন, গুলি করে হত্যা অতঃপর নদীতে ফেলে দেয়া, ভয়াল সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয় ফেঞ্চুগঞ্জের ঐতিহাসিক স্থাপনা কাইয়ার গোদাম ও ইলাশপুর ঢালার রেলওয়ে ব্রীজ! যা বধ্যভূমির সরকারি স্বীকৃতির দাবি আজও উপেক্ষিত। তবে ঐতিহাসিক এই কাইয়ার গোদাম ও ইলাশপুর ঢালার ব্রীজে বধ্যভূমির সাইনবোর্ড টানিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা শাখা।
বুধবার (১১ ডিসেম্বর) এ দিনকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে ফেঞ্চুগঞ্জ প্রেসক্লাব আয়োজন করেছে “যুদ্ধদিনের কথা” নামে বীরত্বগাঁথা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের মুখ্য আলোচক হলেন ফেঞ্চুগঞ্জের সন্তান কানাডা প্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা বদরুল ইসলাম নিলু। এ ছাড়া স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও উপস্থিত থাকবেন এ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান সফলে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ফেঞ্চুগঞ্জ প্রেসক্লাব জানালেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ উদ্দীন ইসকা।
এছাড়া এই দিনকে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড ফেঞ্চুগঞ্জ। নির্ধারীত কর্মসূচির অংশ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের উদ্যোগে সকাল ১০ টায় উপজেলা প্রশাসন হলরোমে আলোচনা সভা এবং পরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগনদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে র্যালী। র্যালীটি প্রদক্ষিণকালীন সময়ে ফেঞ্চুগঞ্জ পশ্চিমবাজারস্থ মহান মুক্তিযুদ্ধে মৃত্যুপূরী খ্যাত ঐতিহাসিক কাইয়ার গোদামে ঝড়ে পড়ে যাওয়া বধ্যভূমির সাইনবোর্ড টানিয়ে বীর শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নিরবতা পালন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁতা গল্প শোনা হবে। বিকেল ৩ টায় ফেঞ্চুগঞ্জ প্রেসক্লাব আয়োজিত মুক্তদিবস অনুষ্ঠানে যোগদান। সন্ধ্যায় মোমবাতি জ¦ালিয়ে কাইয়ার গোদামে নির্যাতীত ও নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে এ সংগঠনটি, জানালেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ আলী বাচ্চু।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিভিন্ন সময়ে আলাপচারিতায় জানা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে এই ঘাতক পশ্চিমা হানাদার বাহিনী ফেঞ্চুগঞ্জ থানা সদরে পদার্পন করে চারভাগে বিভক্ত হয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল। ফেঞ্চুগঞ্জ থানাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো দখল করে ফেলে পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। তখন ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ফেঞ্চুগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মরহুম হাজী মোঃ আছকর আলী’র বাড়ীতে হামলা চালায় পাক-হানারা, এ সময় বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে যায় আছকর আলী’র বড় ছেলে ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি, সিলেটের মদন মোহন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র আসাদুজ্জামান বাচ্চুকে। ঘাতকদের এই নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেধাবী ছাত্র আসাদুজ্জামান বাচ্চুই হলেন ফেঞ্চুগঞ্জের প্রথম শহীদ। বাচ্চুকে হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকরা, এর চার দিন পরেই জ¦ালিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের বাড়ীঘর, তছনছ করে দেয়া হয়েছিল আছকর আলী’র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পর্যায়ক্রমে তারা উপজেলার গুরুত্বপুর্ন স্থান সমুহে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। তাদের এই নির্মম অত্যাচারে আতঙ্ক নেমে আসে ফেঞ্চুগঞ্জে। তখন ফেঞ্চুগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মরহুম আবদুল লতিফ ও সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল হক চৌধূরীসহ রাজনীতিবিদদের পরিবারে নেমে আসে নির্মম অত্যাচারের খড়গ। বাড়ী ছেড়ে পালাতে হয় তাদের। যুদ্ধকালীন সময়ে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা ও মনিপুর চা বাগান ছিল তাদের নারী নির্যাতনের ঘাঁটি। এ ছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ পশ্চিম বাজারে অবস্থিত কাইয়ার গোদাম ছিল হায়েনাদের বন্দীশালা। পাকসেনারা নির্মম হত্যা ও নির্যাতন চালাতো এ বন্দীশালায়। তারা প্রতিরাতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ধরে এনে এই বন্দীশালায় (কাইয়ার গোদাম) গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করত আর লাশ পার্শ্ববর্তী কুশিয়ারা নদীতে ফেলে দিত। দীর্ঘ নয় মাস এভাবে কত বাঙ্গালীর রক্তে সিক্ত হয়েছে এই কাইয়ার গোদাম, এর হিসাব আজও জানা যায়নি।
যুদ্ধের শেষ মুহুর্তে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অতর্কিত আক্রমনে বর্বর পাকসেনারা ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে পালিয়ে যাবার পূর্বে কুশিয়ারা নদীর দক্ষিণ তীরে অর্থাৎ ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার ও রাজনপুর গ্রামে তাদের বিরাট গাড়ীবহর পুড়িয়ে দেয় এবং অন্যান্য যুদ্ধ সামগ্রী বিনষ্ট করে ফেলে। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে খন্ড খন্ড যুদ্ধের পর তারা কুশিয়ারা নদী পার হয়ে উত্তর তীরে অবস্থান নেয় আর দক্ষিণ তীরে অবস্থান নেয় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। ১০ ডিসেম্বরই হয় বড় ধরনের সম্মূখ যুদ্ধ। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা কুশিয়ারা রেলওয়ে সেতুর উপর দিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হলে পাকসেনারা তাদের লক্ষ্য করে অতর্কিত হামলা চালায়। এ হামলায় রেলওয়ে সেতুর উপর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা মুহুর্তের মধ্যে কুশিয়ারা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবুও থেমে যাননি মুক্তিযোদ্ধারা, তারা তাদের কৌশল পরিবর্তন করে পরদিন ১১ ডিসেম্বর উপজেলার কাসিম আলী উচ্চবিদ্যালয়ের সামন (রাজনপুর গ্রাম) থেকে কুশিয়ারা নদীর উত্তর তীরে অবস্থানরত পাকসেনাদের লক্ষ্য করে মর্টার সেল নিক্ষেপ করে তাদের ঘায়েল করতে সক্ষম হয় মুক্তিযোদ্ধারা। একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা সংঘবদ্ধ হয়ে পাকসেনাদের ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে বিতাড়িত করার প্রত্যয় নিয়ে কুশিয়ারা নদী পার হয়ে তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক সম্মূখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে বর্বর পাকসেনাদের পরাস্থ করে। পরবর্তীতে পাকসেনারা মল্লিকপুর রাস্তা দিয়ে ইলাশপুর হয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ ছেড়ে সিলেটের দিকে পালিয়ে যায়। এ সময় ধানক্ষেতে ও বাংকারে ৫ জন পাকসেনার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সাহসী ভূমিকায় রক্তক্ষয়ী সম্মূখ যুদ্ধে অবশেষে মুক্ত হয় ফেঞ্চুগঞ্জ। স্বস্তি ফিরে আসে সাধারন মানুষের মাঝে। লাল সবুজের পতাকা হাতে সেদিন আনন্দ মিছিল করেছিল তারা।
১১ ডিসেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত হবার পর এই ঐতিহাসিক কাইয়ার গোদামে শত শত জনতার ভীড় জমে এবং স্বজনহারাদের কান্ন আর আহাজারীতে সেদিন বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। কালের সাক্ষী এই কাইয়ার গোদামের ভিতরে ঢুকতে এখনো কেউ সাহস পায়না। একদিন হারিয়ে যাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের এই ঐতিহাসিক স্থাপনা কাইয়ার গোদাম।
ফেঞ্চুগঞ্জ পশ্চিমবাজারে অবস্থিত বীর শহীদদের রক্তে মাখা এই কাইয়ার গোদাম ও ইলাশপুর ঢালার ব্রীজকে বধ্যভূমির সরকারি স্বীকৃতির দাবিতে সূদীর্ঘ ৪৮ বছর থেকে সরকারের নিকট বিভিন্নভাবে আবেদন জানিয়ে আসছেন ফেঞ্চুগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা, তবে সে দাবি আজও উপেক্ষিত।