শান্তি কমিটির নেতাদের নামের পরিবর্তে রাজাকারের তালিকায় এসেছে রাজশাহীর ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকেরও নাম! সনদে যাঁর স্বাক্ষরেই বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ পেয়েছেন স্বীকৃতি। এখন তিনিও না-কি ছিলেন রাজাকার? শুধু তাই নয়, এই রাজাকারের প্রকাশিত তালিকায় রয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলিও! ফলে বিষয়টি নিয়ে রাজশাহীতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। যার প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি মানববন্ধন কর্মসূচীও পালন করেছে রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধারা।
জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনা করে গত ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথম ধাপে ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছে। যে তালিকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর রাজশাহীর শান্তি কমিটির নেতাদের নাম নেই। তবে আছে ভাষাসৈনিক এবং মুক্তিযোদ্ধার নাম। এ নিয়ে রাজশাহীতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
রাজাকারের তালিকায় রাজশাহী বিভাগের স্বাধীনতাবিরোধীদের এক থেকে ১৫৪টি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এসব তালিকায় কয়েকশ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এদের কয়েকজনের নাম দ্বিতীয়বারও রয়েছে। তালিকার ৮৯ নম্বরে (ক্রমিক নম্বর ৬০৬) পাঁচজনের নাম রয়েছে। এরা হলেন- অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ, অ্যাডভোকেট মহসিন, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুর রউফ এবং পুলিশ কর্মকর্তা এসএস আবু তালেব।
পাঁচজনের মন্তব্যের ঘরে লেখা আছে তাদের অব্যাহতি দিতে জেলা কমিটি আবেদন করেছিল। এর বাইরে কোনো তথ্য নেই। দুই সরকারি কর্মকর্তার বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ এ নামে একজন আইনজীবীকে পাওয়া গেছে। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু। তিনি একজন ভাষা সৈনিকও। আর আবদুস সালাম ও মহসিন আলী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।
অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রভাষা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের রাজশাহীর যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বেই মূলত রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৫ সদস্যবিশিষ্ট স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্যও ছিলেন টিপু। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০১৯ সালে একুশে পদক প্রদান করে।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ওয়ালিউর রহমান বাবু বলেন, বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থার মানুষ ছিলেন অ্যাডভোকেট সালাম। তার স্ত্রী সুরাইয়া সালাম শহীদ জননী। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ও পরে অনেকবারই অ্যাডভোকেট সালামের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সুরাইয়া সালামের রান্না অনেক পছন্দ ছিল বঙ্গবন্ধুর। যুদ্ধের শুরুতেই দুই সন্তনসহ পরিবারের পাঁচজনকে হারান এই দম্পতি। ইতিহাসের কালো রাত্রে অ্যাডভোকেট সালামকে না পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তুলে নিয়ে যায় তার দুই সন্তাসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে। পরে তাদের লাশও পাওয়া যায়নি।
বাবু বলেন, রাজাকারের তালিকায় থাকা আরেক নাম অ্যাডভোকেট মহসিন। এ নামে রাজশাহীতে দুইজন রয়েছেন। একজনের নাম অ্যাডভোকেট মিয়া মহসিন। অন্যজন অ্যাডভোকেট মহাসিন খান। মিয়া মহসিন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রাজশাহী অঞ্চলের অন্যতম সংগঠক। এখনো বহু মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটে অ্যাডভোকেট মহসিনের স্বাক্ষর আছে। তিনি ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে রাজশাহী-১ আসনে এমপি নির্বাচন করেছিলেন। আর মহসিন খান তিনিও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের এই গবেষক আরও বলেন, তালিকায় রাজশাহীর অন্যতম রাজাকার তৎকালীন জামায়াতের আমীর অ্যাডভোকেট আফাজ উদ্দিন, শান্তি কমিটির সভাপতি সাবেক এমপি আয়েন উদ্দিন এবং ওয়াহেদ আলী মোল্লার নাম নেই। অথচ এই তিনজনই রাজশাহীর রাজাকারদের শীর্ষস্থানীয়। অথচ, তাদের নাম না থাকা খুবই দুঃখজনক। অন্যদিকে যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাদের নাম তালিকায় আসাটা চরম লজ্জার।
রাজাকারের এই তালিকা দেখে ক্ষুব্ধ রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধারাও। যার ফলশ্রুতিতে মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) বিকালে রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে বিক্ষোভ সমাবেশ করে প্রথম প্রকাশিত রাজকারের তালিকার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, রাজশাহীর সব মুক্তিযোদ্ধার কাছে আবদুস সালাম অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার পরিবারের ঋণ কোনোদিন শোধ করা যাবে না। আর অ্যাডভোকেট টিপু মুক্তিযুদ্ধের একজন আজন্ম যোদ্ধা। তিনি এখনও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজাকারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। আর অ্যাডভোকেট মহসিন ছাত্রনেতা হিসেবেই স্বাধীনতার আগে আন্দোলন করেছেন। সে জন্য তিনি দ-িত হয়েছিলেন, কারাভোগও করেছেন। অথচ, আজ তাদের নাম রাজাকারের তালিকায়। এ লজ্জা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নয়, সারা জাতীর। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে এমন একটি বিতর্কিত রাজাকারের তালিকা প্রকাশ সত্যিই কলঙ্কের জন্ম দিয়েছে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা শুধু লজ্জিত বা মর্মাহত হয়নি, একইসঙ্গে তালিকা প্রস্তুতকারী ও প্রকাশকারীদের প্রতি ক্ষুব্ধ।
রাজাকারের তালিকায় নাম আসায় বিস্মিত ও হতবাক হয়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু বলেন, এ ঘটনায় দেশের নাগরিক হিসেবেও আমি লজ্জিত। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলনে যার ভূমিকা ছিল তাকে কারা কেন এই তালিকায় এনেছে, এর তদন্ত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, এই তালিকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা ছিলেন, তাদের নাম এসেছে। এমনকি যারা পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের নামও এসেছে। আবার যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, তাদের নাম রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর, তার নামও আছে এতে। বিষয়টি বড়ই বেদনাদায়ক। আমরা কোনোভাবেই এটি মানতে পারছি না।
মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের রাজশাহী অঞ্চলের সাব সেক্টরের উপ-অধিনায়ক মুক্তিযোদ্ধা তসিকুল হক রাজা বলেন, কারা রাজাকার আমরা তাদের চিনি। শান্তি কমিটির সদস্যদের নাম তালিকায় নেই। এর বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদেরই নাম স্থান পেয়েছে তালিকায়। এখন স্পস্ট বোঝা যাচ্ছে এ তালিকা তৈরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণ ছিলনা, ছিল রাজাকাররাই। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের নাম রাজাকারের তালিকায় এসেছে।