অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও উৎসবের ঘাটতি ছিলো না ঝালকাঠি জেলার একমাত্র খ্রিস্টানপাড়া নলছিটি উপজেলার রাজাবাড়িয়া খ্রিস্টান পল্লীতে। ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন পালন উৎসবে আলোক সজ্জা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিশেষ প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বড় দিন উৎসব পালন করেছে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা।
জানাগেছে, ঝালকাঠি জেলার একমাত্র খ্রিষ্টানপাড়া নলছিটি উপজেলার রাজাবাড়িয়া গ্রামে প্রতি বছরই বড় দিনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মুসলিমদের সাথে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সব চেয়ে বড় উৎসব ২৫ ডিসেম্বর বড় দিন পালনে ওই এলাকার মুসলমানদের সহযোগিতায় অনুষ্ঠান প্রাণবন্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়। “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার” এটার ব্যত্যয় ঘটে না এখানকার অনুষ্ঠানে। পল্লী ও তৎসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এলাকাবাসী। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন। যার ফলে স্থানীয়ভাবে একে অপরের প্রতি সহাবস্থানে থেকে উৎসব পালন করছে। ২২টি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে খ্রিস্টান পল্লী। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব ধমীর্য় প্রবক্তা যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বড়দিন। ২৫ ডিসেম্বর (সোমবার) রাতে বড়দিনকে কেন্দ্র করে ঝালকাঠির একমাত্র খ্রিস্টান পল্লী নলছিটি উপজেলার রাজাবাড়িয়া গ্রামে পালন করা হয় নানা কর্মসূচী। বড়দিন পালনে গ্রাম জুড়ে উৎসব মুখোর পরিবেশ আর বাহারী সাজে সাজানো হয় গির্জা। সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় অনুষ্ঠান। রাত ১১ টায় নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে বিশেষ প্রার্থনা শুরু হয়। তারা ধর্মীয় প্রবক্তার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছেন। দ্বিতীয় পর্বে সকাল ৮ টায়ও তাদের প্রার্থনালয়ে নামাজ আদায়ে দিনের শুভ সুচনা করেন। বড়দিন উপলক্ষ্যে প্রায়তদের স্মরনে সমাহিতের স্থানে এবং প্রতিটি ঘর ও উপসনালয়ের সামনে মোমবাতি প্রজ্জলন করা হয়।
রাজাবাড়িয়া খ্রিষ্টান পল্লী ও প্যারিস কমিটির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা লাজারেজ গমেজ বলেন, ২ শত বছর কিংবা তার পূর্ব পর্তুগিজ শাসন আমলে এ অঞ্চলে খ্রিস্টানরা বসতি স্থাপন করে। বর্তমানে ২২ টি পরিবারে জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৯৫ জন বাসিন্দা। এখানে গড়ে উঠেছে গির্জা, বিদ্যালয় এবং বাসভবন। গির্জার সামনে নির্মাণ করা হচ্ছে পুরোহিত সাধু আন্তনী স্মরণে একটি গ্রোটো। সড়ক যোগাযোগ, শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা ও পানিসহ নানা সমস্যায় দিন কাটছে এ খ্রিস্টান পল্লীর বাসিন্দাদের। শিশুদের পড়ার জন্য সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই এ গ্রামে। তবে রবি নিকলজ গমেজ নামক এক গৃহ শিক্ষক পল্লীর শিশুদের ১ম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি সমমানের শিক্ষা দেন। আর এ জন্য তাকে থাকা, খাওয়াসহ সামান্য বেতন দেয়া হয়। বিশেষ কোন সরকারী সহায়তা নেই খ্রিস্টান পল্লীর বাসিন্দাদের জন্য। এছাড়াও গোসল কিংবা ওজু করার জন্য পানি সমস্যা প্রকট বলে জানান খ্রিস্টান পল্লীর বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা লাজারেজ গমেজ ওরফে ফকু গমেজ (৭২)। যে কোন নির্বাচন এলে যোগাযোগের অনুন্নত রাস্তা সংস্কার এবং খ্রীষ্টান পল্লীর সামনে বয়ে যাওয়া খালের উপর একটি ঘাটলা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায় প্রার্থীরা। তা কেবল প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। নাগরিক সুবিধা বলতেও তেমন কিছু পাচ্ছে না বলে তাদের অভিযোগ। ক্ষোভ প্রকাশ করে লাজারেজ গমেজ বলেন, যদি কোন বরাদ্দ আসে তা পল্লী পর্যন্ত নিয়ে আসতে অর্ধেকে নেমে যায়। সেই সহায়তা আমাকে গ্রহণ করার সময় পুরো টাকা বুঝে পেলাম বলেই সই (স্বাক্ষর) দিতে হয়। তার চেয়ে কোন সহায়তা ছাড়া আমাদের নিজেদের অর্থায়নে অনুষ্ঠান ভালোভাবেই চলে। বিভিন্ন নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা এসে আমাদের সহায়তার প্রলোভন দেখালেও আমরা লোভ লালসার উর্ধ্বে থেকে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করি। সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের এখানে যেভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন রয়েছে তা আর কোথাও নেই। আমরা চলাচলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের যেমন সম্মান দিয়ে চলি। ঠিক তারাও আমাদের তেমন সম্মান দিয়ে চলেন। দারিদ্রতা কিংবা নানা অসংগতি নিত্য সঙ্গী হলেও উৎসব আয়োজনে কমতি থাকে না এ খ্রিস্টান পল্লীর কোন ঘরে। ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর থেকেই আলোক সজ্জা ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বড়দিনের শুভ সূচনা করা হয়। গির্জায় অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাত ১০ টার পরে ঘরে ঘরে কীর্তন এবং শিশু বৃদ্ধ বনিতা সকলের জন্য থাকছে উৎসবের নাস্তা, কেক কাটা এবং অতিথি আপ্যায়ন। খ্রিস্টান পল্লীর যুব কমিটির সাধারন সম্পাদক পলাশ রবিন গমেজ জানান, আমাদের যাতায়াতের পথ নেই বললেই চলে। এমনিতে দুর্গম এলাকার মধ্যে আমাদের পল্লী, সেখানে আবার যাতায়াতের সমস্যা। যার জন্য দূরদূরান্ত থেকে মেহমানরা আসতে চাইলেও তারা সড়ক ব্যবস্থা ভালো না থাকায় আসছে না। আমাদের চলাফেরায় অনেক কষ্ট হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবী জানান খ্রিস্টান পল্লীর বাসিন্দারা।