সতত হে নদ তুমি পড়ো মোর মনে ,সতত তোমারী কথা ভাবি এ বিরলে । বাংলা সাহিত্যের অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম ধন্য কপোতাক্ষ তীরের সাগরদাঁড়ির দত্তবাড়ির প্রাচীন নিদর্শনগুলো দীর্ঘ ২০ বছরেও পুণসংস্কার না হওয়ায় জানালা, দরজা, সংরক্ষিত আসবাবপত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে ছোট-বড় ৫টি স্থাপনা, মন্দির ও পুকুর ঘাট সংস্কার করা জরুরী হয়ে পড়েছে। অপরদিকে, অতিথিদের বিশ্রামের জন্যে নির্মিত ডাক বাংলোটি এক যুগ আগে ভেঙে ফেলা হলেও তা দীর্ঘদিনেও নির্মাণ করা হয়নি। এরপরও, কর্তৃপক্ষের অবহেলায় কবির জন্মস্থান সাগরদাঁড়িতে পর্যটন আকর্ষণীয় স্থান সমূহের জন্যে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড কর্তৃক বরাদ্দকৃত ১ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ সম্পাদন না হওয়ায় সমুদয় অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরৎ গেছে। ফলে মধুপল্লী উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হওয়ায় মধু ভক্তদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আগামি ২২ জানুয়ারী থেকে সংস্কৃত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সপ্তাহ ব্যাপী মধু মেলা ও মধুজন্মোৎসব পালনের প্রস্তুতি চলছে।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারী যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব কাটে মায়ের কোলে। তাঁর জীবন যতটা না বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য ছিল, তাঁর চেয়ে অনেক বেশী ছিল যাতনায় ভরা। তিনি খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী হেনরিয়েটাকে বিয়ে করে পিতার চক্ষুশুল হয়ে যান। হেনরিয়েটাকে কলকাতা থেকে তিনি বজরায় করে নিয়ে আসেন সাগরদাঁড়িতে। কিন্তু দাম্ভিক পিতা রাজনারায়ন দত্ত পুত্র এবং পুত্রবধুকে বাড়িতে ওঠানো তো দূরের কথা পায়ে হাত দিয়ে আর্শীবাদ পর্যন্ত নিতে দেননি। বাংলা ভাষায় সনেট রচয়ীতা এ কবি ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতায় মারা যান।
কেশবপুর উপজেলা সদর থেকে সাগরদাঁড়ির দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। পিচের রাস্তা হলেও রাস্তাটি প্রায় ১ যুগ সংস্কার না হওয়ায় খানা-খন্দের কারণে যাতায়াত করতে গিয়ে মধুভক্তদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মধুকবির জমিদার বাড়িটি ৪ একর ৩৩ শতক জমির ওপর অবস্থিত। ১৮৬৫ সালে পাকিস্থান সরকার কবি ভক্তদের থাকার জন্যে চারশয্যা বিশিষ্ট একটি রেস্টহাউজ বানিয়ে ছিল। এই রেস্ট হাউজের একটি রুমেই পাঠাগার বানানো হয়। ১৯৬৬ সালে কবির বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে সরকার ন্যাস্ত করে। কবির জন্মস্থান খ্যাত ঘরটি এখন আর নেই। কবির বাড়ি সংলগ্ন আবক্ষ মূর্তিটি কলকাতার সেন্ট্রল কো-অপারেটিভ ব্যাংক স্থাপন করে দেয়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জমিদার বাড়ি, পুকুর পুণসংস্কারসহ পুরো এলাকাটি পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলে। যে বজরায় কপোতাক্ষ নদীর কুলে কবি সস্ত্রীক সাত দিন অবস্থান করেছিলেন, সেখানে একটি পাথরে খোদাই করে লেখা আছে ‘শতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে’। এই জায়গাটি বিদায় ঘাট নামে খ্যাত। ১৯৯৮ সালে এর পুণসংস্কার কাজ শুরু হয়। ২০০১ সালে কাজ শেষ হয়। এরপর আর সংস্কার হয়নি। দীর্ঘ দিনেও দত্তবাড়ি, মন্দিরসহ প্রাচীন নিদর্শনগুলো পুণসংস্কার না হওয়ায় এর জানালা, দরজা ভেঙে যাচ্ছে। ছাদেও ফাটল ধরেছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সংরক্ষিত আসবাবপত্রগুলো। ছোট-বড় ৫টি স্থাপনা, মন্দির ও পুকুর ঘাট এ মুহূর্তে সংস্কার করা জরুরী হয়ে পড়েছে। মধুপল্লীর জায়গা স্বল্পতার কারণে গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থাসহ পিকনিক কর্ণার নেই। স্যুভিনির সপ, ক্যাফেটোরিয়া, পিকনিক পার্টির জন্য ভালো মানের টয়লেট, ফ্যাসেলিটি, দর্শনার্থীদের বসার জন্যে চেয়ার, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ও বিশ্রামাগার নেই।
এদিকে, মধুমেলায় আগত ভিআইপদের বিশ্রামের জন্যে নির্মিত ডাকবাংলোটি ২০০৬ সালে ভেঙে ফেলা হলেও আজও তা নির্মাণ করা হয়নি। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আগত অতিথিদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সাগরদাঁড়িতে প্রচুর দর্শনার্থীদের আগম ঘটে থাকে। গত ১০/০৬/২০১৮ তারিখে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিখিল রঞ্জন রায় স্বাক্ষরিত বিটিবি( যশোর-পর্যটন/২০১৮(৬৪২)/১৯৮০ নং স্মারকে সাগরদাঁড়ির পর্যটন আকর্ষণীয় স্থান উন্নয়ন কাজের জন্যে ১ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। এ টাকায় মহাকবির আধুনিক ভাস্কর্য, সমাধি লিপি প্রতিস্থাপণ, অনশনস্থলে কাঠ বাদাম গাছের শ্রী বৃদ্ধি, বিখ্যাত কবিতা অবলম্বনে টেরাকোটা দিয়ে কাহিনী চিত্র ওয়াল ও ওয়াস ব্লক নির্মাণের জন্যে ওই বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সমুদয় অর্থই ফেরৎ যায়। মধুপল্লী উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়। দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে এই মুহূর্তে কবির বাসগৃহসহ ৫টি ভবন সংস্কার, স্যাঁতসে্যঁতেভাব দূরীকরণে রঙ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
সাগরদাঁড়িতে মধুসূদন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় চাই আন্দোলনের নেতা অ্যাডভোকেট আবুবকর সিদ্দিকী বলেন, মধুকবির জন্ম সাগরদাঁড়িতে হলেও জীবনের বেশীর ভাগ সময় কেটেছে ফ্রান্স ও ভারতে। তাই তিনি শুধু বাংলাদেশের কবি নয়। আন্তর্জাতিকভাবে তাকে তুলে ধরার জন্যে সাগরদাঁড়িতে মধুসূদন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।
প্রতিবছর শীতের আগমনের শুরুতে কবির প্রতি জাগে ভক্তদের ভালোবাসা। তাই কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাগরদাঁড়িতে পর্যটকদের আগমন ঘটে থাকে। আগামী ২২ জানুয়ারী থেকে সাংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে সাগরদাঁড়িতে বসছে ৭ দিন ব্যাপী মধুমেলা। প্রতিদিন স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা সাগরদাঁড়িতে আসছে বনভোজনে। ফলে মুখোরিত হয়ে উঠতে শুরু করেছে মধুকবির জন্মভূমি সাগরদাঁড়ি।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মধুপল্লীর দত্তবাড়ির দায়িত্বে থাকা কাস্টডিয়ান ফজলুল করিম জানান, মধুমেলায় প্রতি বছর ৮০ থেকে ৯০ হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে থাকে। এতে বছরে ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকার রাজস্ব আয় হয়। নানা সমস্যার কারণে পর্যটকরা এখানে আসতে আগ্রহী হয় না। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানাবিধ সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছে। তবে মধুপল্লীতে ইতোমধ্যে ছাদ বাগান ও পাখির বাসা স্থাপণ করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে মাই কবিতা পাথরগুলোর পাশে স্থাপণসহ ‘সময় রেখা’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর জীবনী সংম্বলিত প্লাকার্ড বসানো হয়েছে।