উত্তরাঞ্চলের হতদরিদ্রদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশ এখন দরিদ্র্যদের মূর্তিমান আতঙ্ক। হতদারিদ্র সদস্যদের সঞ্চয়ের অর্থ লোপাট, ভুয়া ঋণ দেখিয়ে হয়রানীমূলক মামলা, অধিক মুনাফায় ঋণ বিতরণ, ঋণ পরিশোধে বিলম্ব হলে সদস্য নির্যাতনসহ কর্মীদের পাওনা পরিশোধ না করে অন্যায়ভাবে ছাটাই ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় তাদের হয়রানীর মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। সম্প্রতি এসব অভিযোগের বিচার চেয়ে ‘আরডিআরএস কর্মী ও সদস্য নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি’র ব্যান্যারে লালমনিরহাটে মানববন্ধন ও কুড়িগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ভূক্তভোগীরা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময় সমাজ সেবার ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় রংপুর দিনাজপুর রুরাল সার্ভিস(আরডিআরএস)। প্রথমে বেশ কিছু সামাজিক কাজ করে সাধারণের আস্থা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও পরবর্তীতে সংস্থাটি শুরু করে সুদের ব্যবসা। চালু হয় ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচী। আর এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে বেছে নেয় উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে দারিদ্রপীড়িত প্রত্যন্ত এলাকাগুলো। প্রথমে তাদের দারিদ্রতা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে নামমাত্র সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ করে। ঋণ গ্রহণের দু’এক মাস যেতে না যেতেই সুদের বোঝা টানতে ক্লান্ত হন হতদরিদ্র এসব মানুষ। শুরু হয় সংস্থাটির অস্বাভাবিক চাপ ও নির্যাতনের খড়গ। ব্যক্তির অসুস্থ্যতা, পরিবারের কোনো সদস্যের চিরবিয়োগ কিংবা কোনো আর্কষ্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনো কিছুতেই রক্ষা মেলে না ঋণের কিস্তি দেওয়া থেকে। গেল বছরের ভয়াবহ বন্যায়ও সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সংস্থাটি দেশের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল কুড়িগ্রামের রাজারহাট, লালমনিরহাটের মহিষখোঁচা, হাতীবান্ধা এলাকার বন্যা কবলিতদের কাছ থেকে জোর করে কিস্তি দিতে বাধ্য করেছে। এছাড়াও অতিত ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ঋণ গৃহিতা টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের বসতবাড়ির ঘর ভেঙে নেওয়া, গৃহপালিত পশু নিয়ে যাওয়ার মতো জঘন্য কাজও করেছে সংস্থাটি। যদিও পরবর্তীতে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি লাগাম টেনে ধরায় আরডিআরএসসহ কতিপয় এনজিও’র এমন বেপরোয়াপনায় কৌশলগত ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
আরডিআরএসে কর্মরত কয়েকজন কর্মী, সদস্য ও নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র দাবি করে, সদস্যরা সেই অবস্থা থেকে মুক্তি পেলেও কর্মীদের ওপর অমানসিক নির্যাতন শুরু হয়। প্রতি মাসের হিসাব ক্লোজিং- এর নামে শতভাগ আদায় দেখাতে ভালো সদস্যদের অজান্তে তাদের সঞ্চয়ের টাকা উত্তোলন করে অনায়াদি সদস্যের নামে জমা করতে কর্মীদের বাধ্য করা হত। আর পরবর্তীতে চাকরিচ্যুত কর্মী ওই টাকা আত্মসাৎ করেছে মর্মে মামলা দায়ের করা হত তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও সরকারের কঠোর পদক্ষেপে সংস্থাটি কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে সদস্যদের মাঝে ঋণ প্রদানের স্বাক্ষরযুক্ত তিনটি ফাঁকা চেকের পাতা গ্রহণ আর কর্মী নিয়োগের সময় ফেরতযোগ্য নিরাপত্তার টাকা(সিকিউরিটি মানি), শিক্ষাগত যোগ্যতার মূল সনদ ও স্বাক্ষরযুক্ত ফাঁকা চেকের পাতা গ্রহণ। যা পরবর্তীতে নানা অযুহাতে কর্মীদের ছাটাই করে সেসব ফেরত না দিয়ে ওইসব কাগজপত্র ও চেকের পাতা ব্যবহার করে অর্থ আত্মসার্থের মামলায় হয়রানিসহ মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয় সংস্থার পক্ষ থেকে। আর সদস্যদের নামে হরহামেশায় করা হয় চেক জালিয়াতির মামলা। সুত্রগুলোর তথ্য মতে, রংপুরের আট জেলায় কর্মী ও সদস্যদের নামে এমন মামলার সংখ্যা হাজারেরও বেশি। যা টাকার অংকে শত কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
সংস্থাটির নীলফামারী জেলার ডোমার সদর শাখার প্রাক্তন সিনিয়র শাখা ব্যবস্থাপক নিতাই চন্দ্র কর্মকার জানান, প্রায় ১২বছর আরডিআরএসের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের পর তার পাওনা বুঝিয়ে না দিয়ে হঠাৎ-ই চাকরিচ্যুত করে তার বিরুদ্ধে ৪৯লক্ষ টাকা আত্মসাতের হয়রানিমূলক মামলা করেছে এনজিওটি। ১৫দিন হাজত বাস করার পর তিনি এখন মানসিকভাবে বির্পযস্থ। বিষয়টি নিয়ে সরকারের একাধিক দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো সুরাহ মেলেনি তার।
একই অভিযোগ কুড়িগ্রামের ধরনীবাড়ি শাখা ও হবিগঞ্জ সদর শাখা থেকে অব্যাহতি নেয়া আরডিআরএস’র মাইক্রো ফাইন্যান্স অর্গানাইজার মোস্তাফিজুর রহমানের। তিনি বলেন ‘দুটি শাখা থেকেই ক্লিায়ারেন্স নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে এসেছিলাম; অথচ ছয় মাস পর চাকরির সময় আমার কাছ থেকে নেওয়া স্বাক্ষরযুক্ত ফাঁকা চেকে অঙ্ক বসিয়ে ব্যাংকে ডিজঅনার করে আমার নামে ১১লক্ষ ৩৪হাজার টাকার আত্মসাতের মামলা করেছে’। তিনি এই হয়রানির ন্যায্য বিচার চান।
নিতাই ও মোস্তাফিজের মতো রংপুরের আট জেলায় প্রায় ৮শতাধিক কর্মী ও তিন শতাধিক সদস্যের নামে এমন চেক ডিজওনার করে মামলা করেছে সংস্থাটি। এসব মামলায় স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়া যুবকদের অনেকেই বাড়ি ছাড়া, কেউ কারাভোগ করছেন, কেউবা সর্বস্বটুকু বিক্রি করে হয়রানি থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করছেন। তবে ভুক্তভোগী এসব মানুষ দীর্ঘদিন চাকরির পর নিজের পাওনা বুঝিয়ে না পেয়ে উল্টো হয়রানি হওয়ায় পরিবার নিয়ে এখন মানবেতর ও বির্পযস্থ জীবন যাপন করছেন।
এমন প্রায় ৬৫টি মামলার বাদী সংস্থাটির প্রাক্তন প্রোগ্রাম ম্যানেজার মাহফুজ জামিলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আরডিআরএস এসব কাজ আমাদের দ্বারা করতে বাধ্য করেছে। বর্তমানে তিনি আরডিআরএসে না থাকায় মামলাগুলোর বাদী পরিবর্তন করা হচ্ছে এখন।
এদিকে হয়রানিমূলক মামলার শিকার হওয়া কয়েকজন ভুক্তভোগী সদস্যের সাথে কথা বললে বেড়িয়ে আসে লোমহর্ষক আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনেকেই ঋণ না করলেও মামলার শিকার হয়েছেন, কারো আবার দীর্ঘদিনের জমানো সঞ্চয়ের টাকা খোঁয়া গেছে, আবার কেউ ঋণের বেশিভাগ টাকা পরিশোধ করলেও তার নামে মামলা হয়েছে পুরো টাকার।
নীমফামারীর ডোমার উপজেলার সোনারায় বাজার এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “পাঁচ হাজার টাকা থেকে ঋণ নেয়া শুরু করে সবশেষ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আরডিআরএস এর ঋণ গৃহিতা আমি; একাধিক বার ঋণ নেয়ার সুবাদে আরডিআরএস আমার কাছ থেকে জনতা ব্যাংকে দুটি এবং সোনালী ব্যাংকের দুটি স্বাক্ষরযুক্ত ফাঁকা চেকের পাতা নেয়; যা কখনোই আর আমাকে ফেরত দেয়নি; ঋণের কয়েকটি কিস্তি দেয়ার পর পরবর্তী কিস্তি দিতে দেড়ি হলে আমার একটি চেকে মনগড়া অঙ্ক বসিয়ে ডিজওনার করে আমার নামে অন্যায়ভাবে তিন লক্ষ টাকার-ই মামলা করেছে; আমি এই হয়রানি থেকে মুক্তি চাই এবং আরডিআরএসের বিচার চাই”।
তবে কুড়িগ্রামের ধরনী বাড়ি গ্রামের তরু বালার গল্প একেবারে ভিন্ন। দুই লক্ষ টাকা ঋণের আবেদন করেছিলেন তিনি। স্বাক্ষরযুক্ত ফাঁকা চেকের পাতা সকল কাগজপত্রও জমা নেয় আরডিআরএস। তরুবালার ঋণ মঞ্জুর না হলেও কাগজপত্র রেখে দিয়েছিলো সংস্থাটি। পরবর্তীতে সেই চেকের পাতা ব্যবহার করে তার নামে দুই লক্ষ টাকার মামলা করে। এছাড়াও অনেক সদস্য অভিযোগ করেন, তাদের জমাকৃত সঞ্চয়ের টাকা আরডিআরএস ফিরিয়ে না দিয়ে পূর্বে কর্মী পকেটস্থ করেছে মর্মে অযুহাত দিয়ে আত্মসাৎ করছে।
দরিদ্রদের সাথে সংস্থাটির এমন আচরণ ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। ফলে আস্থাহীনতায় সংস্থাটি এই অঞ্চল থেকে নিজেদের কাজকর্ম গুটিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বলে নাম গোপন রাখার শর্তে আরডিআরএসে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
এসব বিষয়ে আরডিআরএস কর্মী ও সদস্য নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক, লালমনিরহাটের মিজানুর রহমান জানান, ‘সংস্থাটির অনিয়ম ও দুর্নীতি ও অন্য এনজিও’র স্বাক্ষর জালিয়াতির কারণে ইতোমধ্যে লেবার মাইগ্রেশন নামের একটি প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। অতিতে আরডিআরএস বাংলাদেশের সুনাম ছিল, তাই সেখানে চাকরি নিয়েছিলাম; কিন্তু সংস্থাটির ক্রেডিট প্রোগ্রামে যে পরিমাণ অনিয়ম- তা অকল্পনীয়’। তিনি এসব তদন্তে দুদকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। আর কমিটির সভাপতি হারুণ অর রশীদের দাবি, বিভিন্ন সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে প্রমানাদিসহ লিখিত অভিযোগ ও আন্দোলন করেও কোনো কাজে আসছে না। আরডিআরএস থেকে ছাটাইকৃত কর্মহীন বেকাররা সংস্থাটি থেকে নানাভাবে হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। শিক্ষিত যুবক ও হতদরিদ্রদের রক্ত চুষে খেয়ে আরডিআরএস এখন পালানোর পরিকল্পনায় আছে বলে দাবি তার। দরিদ্র এ জনপদের মানুষের স্বার্থ সুরক্ষায় আরডিআরএসের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ চান তিনি। এছাড়াও সংস্থাটির ক্রেডিট প্রোগ্রামের পরিচালক আরএম ফুয়াদকে দায়ী করে তিনি বলেন, তার কারণেই এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সুত্রপাত হয়েছে। হাজার হাজার কর্মী ও সদস্য হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
যদিও এসব বিষয়ে অভিযুক্ত ক্রেডিট প্রোগ্রামের পরিচালক আরএম ফুয়াদের সাথে রংপুর কার্যালয়ে দেখা করা হলে তিনি এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হননি বরং দ্রুত কার্যালয় ত্যাগ করেছেন।
এ অবস্থায় বিষয়গুলোকে গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ড. মোর্শেদ হোসেন। তিনি এনজিওগুলোর দিকের কঠোর নজরদারির জন্য মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি ও সরকারের কঠোর নজরদারির সুপারিশ করেন।
এ ব্যাপারে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক এনামুল কবিরকে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি প্রতিবেদকের পরিচয় প্রদানপূর্বক মোবাইলের ক্ষুদে বার্তায়ও সাড়া দেননি।
তবে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি(এমআর)’র সিনিয়র সহকারী পরিচালক ফরিদুল হক মুঠোফোনে অভিযোগ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, তদন্ত চলৎ রয়েছে। সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হবে।