যৌনকর্মী! শব্দটি শুনলেই মানুষের মনে মাঝে স্বাভাবিক ভাবেই এ ধরনের ঘৃণার অবতারনা হয়। ঘৃনিত এই পেশার সৃষ্টিই হতো না যদি সমাজের ভদ্রবেশী মানুষগুলো তাদের খদ্দের না হতো। অথচ দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাসিন্দা এইসব যৌনকর্মীদের মৃত্যুর পর নদীতে ভাসিয়ে দেওয় বা মাটি চাপা দেওয়া হতো দীর্ঘ কাল ধরে। সেই প্রথা ভেঙে রোববার রাতে গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি আশিকুর রহমানের উদ্যোগে জানাযাসহ শরীয়া মোতাবেক দাফন সম্পন্ন করা হলো।
জানা যায়, দেশেরে বৃহত্তম যৌনপল্লী গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় দীর্ঘ কাল ধরে অবস্থিত। এখানে অন্তত ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার যৌনকর্মীর বসবাস। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে প্রথমদিকে পদ্মা নদীতে লাশ ডুবিয়ে দেয়া হতো। কয়েক বছর আগে তাদের জন্য পল্লীর পাশে গোরস্থন করা হয়। তবে মৃত ব্যাক্তিকে সেখানে জানাযা-কাফন ছাড়াই দেয়া হতো মাটি চাপা।
বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর আদিমতম পেশা হলো পতিতাবৃত্তি। নিষ্ঠুর-নির্মম অসম্মানজনক এই পেশা আজও পৃথিবীতে টিকে রয়েছে। নারীকে নানারকম ছলচাতুরী করে কিংবা ফাঁদে ফেলে পতিতাবৃত্তিতে নিয়ে আসা হয়। তবে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে সম্প্রতি বিভিন্ন অপরাধ ও জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার বিরুদ্ধে পুলিশ কড়া নজরদারি করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে মাদক, জোরপুর্বক দেহ ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রোববার বিকেলে পল্লীর বাসিন্দাদের সাথে মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়। গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশের সহযোগিতায় যৌনকর্মীদের সংগঠন অবহেলিত নারী ঐক্য নামের একটি সংগঠন এ মতবিনিময়ের আয়োজন করে। এই মত বিনিময় চলাকালেই মৃত্যুর খবর আসে ৬৫ বছর বয়সী পল্লীর প্রবীন বাসিন্দা হামিদা বেগমের। সেখানেই পল্লীর বাসিন্দারা নিহত হামিদা বেগমের জানাযাসহ দাফনের দাবি তোলেন। এ সময় গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি আশিকুর রহমান তাদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে নিহত ওই নারীর জানাযা, দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন। রোববার রাত ৯টায় অনুষ্ঠিত নিহত ওই নারীর জানাযায় ওসি ছাড়াও অংশগ্রহণ করেন দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান মন্ডল, স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল জলিল ফকীর প্রমুখ। জানাযার নামাজে ইমামতি করেন দৌলতদিয়া রেল মসজিদের ইমাম মৌলভী গোলাম মোস্তফা।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল জলিল ফকীর জানান, অতীতে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাসিন্দা কেউ মারা গেলে জানাযা করা হতো না। আসল কথা হলো কোন হুজুর জানাযা নামাজ পড়াতে রাজিই হতেন না। তাই বাধ্য হয়ে মৃত ব্যাক্তিকে মাটি চাপা দেয়া হতো। গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি সাহেব উদ্যোগ গ্রহন করায় আজ এটা সম্ভব হয়েছে বলে তিনি জানান।
দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাসিন্দাদের সংগঠন অবহেলিত নারী ঐক্যের সভানেত্রী ঝুমুর আক্তারের সভাপতিত্বে মতবিনিময়ে বক্তব্য রাখেন গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি আশিকুর রহমান, ওসি (তদন্ত) আব্দুল্লাহ আল তায়াবীর, গোয়ালন্দ প্রেসক্লাবের সভাপতি আজু শিকদার, সাধারন সম্পাদক শামীম শেখ, নিউজ ২৪ এর রাজবাড়ী জেলা প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম শামীম প্রমুখ।
মতবিনিময়ে একাধিক যৌনকর্মী পল্লীর অনৈতিক কর্মকা- ও তাদের সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরে কথা বলেন। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে যৌনপল্লীতে ইয়াবা, ফেন্সিডিল, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদক নিয়ন্ত্রণে পল্লীর বাসিন্দাদের সহযোগিতা কামনা করা হয়। এ ছাড়া যে কোন ধনের নির্যাতনের শিকার হলে পুলিশকে জানানোর আহবান করা হয়।
মৃত যৌনকর্মীর জানাযা সম্পর্কে গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি আশিকুর রহমান জানান, এই জানাযার নামাজে ইমামতি কারা জন্য হুজুর রাজি হচ্ছিলেন না। তার কাছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মাসালা জানতে চাইলে তিনি অনেকটা বাধ্য হয়েই রাজি হন। সফল ভাবে এই কাজটি করতে পেরে তিনি অনেক আনন্দিত জানিয়ে বলেন, ‘এরপর থেকে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীল প্রতিটি বাসিন্দার জন্য জানাযা-দাফন নিশ্চিত করা হবে।