বর্তমানে দেশের মানবপাচারের অন্যতম রুট কক্সবাজার। কক্সবাজার থেকে দুঃসাহসিক এ অনিরাপদ নৌযাত্রা নতুন কোনো ঘটনা নয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে গত কয়েক বছরে সেটি হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী ও উপকূলীয় এলাকার মানবপাচারকারী চক্র হঠাৎ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রশাসনের তৎপরতার কারণে পাচারকারীরাও কৌশল বদলিয়ে বাংলাদেশিদের পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের টার্গেট করছে। মিয়ানমারে নির্যাতন এবং বাংলাদেশে শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবনযাপন ও জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়ার স্বপ্নে গোপনে ক্যাম্প ছাড়ছে রোহিঙ্গারা। স্বল্প খরচে নৌকায় মালয়েশিয়া নেওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছে দালাল চক্র। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকের মৃত্যুর খবর হলেও থামছে না এ ভয়ঙ্কর যাত্রা।
জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এখন ৪০ থেকে ৪৫টির মতো দালাল চক্র সক্রিয়। এ জন্য রোহিঙ্গারা ৩০ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দালালদের দিচ্ছেন। এভাবেই গত দুই বছরে অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ রাতের আঁধারে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছে। ছোট ছোট কাঠের নৌকায় বা ট্রলারে পাড়ি দিতে গিয়ে কারো সাগরে সলিলসমাধিও হয়েছেন।
সর্বশেষ গত সোমবার রাতে কাঠের নৌকায় করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন ১৩৮ জন রোহিঙ্গা। কিন্তু পথে ট্রলারডুবিতে ১৯ জনের মৃত্যু ও ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। যাত্রীদের প্রায় সবাই রোহিঙ্গা এবং তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এভাবে ট্রলারডুবিতে মৃত্যু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে দীর্ঘ কারাবাস, পথে পথে নানা বিপদ ও নির্যাতনের তোয়াক্কা করছে না অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে দেশত্যাগীরা। অনেকেই বিদেশের কারাগারে বছরের পর বছর বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। স্বজনরা জানেনও না তাদের জন্য উপার্জন করতে যাওয়া প্রিয়জনটি বিপদে কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা। তবুও কক্সবাজার উপকূল দিয়ে ট্রলারে চেপে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার থামছেই না।
আদালত সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারে দায়ের হওয়া মানবপাচারের কিছু মামলার নিষ্পত্তি হলেও সাক্ষ্যদানের অভাবে সেগুলোতে কোনো আসামিরই সাজা হয়নি। এখনো জেলার বিভিন্ন আদালতে ৩৯৮টি মানবপাচার মামলা বিচারাধীন। মামলার আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসে আবার মানবপাচারে জড়াচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের আইন মন্ত্রণালয় ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে গভীরভাবে ভাবতে হবে বলে আমরা মনে করি।
বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের এ মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমাদের প্রশাসনের বোধোদয় হওয়া উচিত। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছে। এরপরও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্বের জন্য রোহিঙ্গাদের মরিয়া ভাব প্রকট হয়ে উঠছে। আমরা যখন এ কথা লিখছি, তখনও হয়তো আরেকদল ট্রলারে উঠে বসছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে এভাবে যাওয়ার চেষ্টা ও প্রাণহানিতে নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। যা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই যে কোনো ভাবেই হোক এটি বন্ধে প্রশাসনকে আরও কঠোর ও তৎপর হতে হবে।