রাজশাহীর চারঘাটের ঐতিহ্যবাহী খয়ের শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছে। বাংলাদেশের খয়ের উৎপাদনের একমাত্র প্রসিদ্ধ স্থান রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা। প্রয়োজনীয় উপকরনের মুল্য বৃদ্ধি এবং উপকরনের অভাবে সেই খয়ের শিল্প আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। চারঘাটের উৎপাদিত খয়ে দিয়ে প্রায় সারা দেশের পান খাওয়া চলেতো। শুধু তাই নয়, এই খয়ে থেকে তৈরী হয় খয়েরী রং।
এলাকার প্রবীন ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকে চারঘাটে খয়ের উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়। তারা আরো জানায়,পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই খয়ের শিল্পের উৎপত্তি স্থল। তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের চারঘাট থেকে খয়েরের উৎপাদন শুরু হলে এখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর করাচীসহ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে রপ্তানী হতো। আর এর কদরও ছিল তখন ভীষণ। খয়ের উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় তুলনায় খয়ের গাছ বর্তমানে তেমন পাওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু চারঘাটের এই খয়ের শিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য চারঘাটের তৎকালিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মরহুম ডঃ নুর ইসলাম ইউসুফপুর পদ্মার চরে প্রায় ২০ হাজার খয়ের গাছের চারা রোপন করেন। এর পর থেকে সরকারি ভাবে কোনো খয়ের গাছ লাগানো কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রথমে খয়ের গাছের উপরের চামড়া (ছাল) তুলে ফেলা হয়। তারপর গাছটি কুচি কুচি করে কেটে মাটির পাতিলে করে বিশেষ চুল¬ীতে জাল (ফুটিয়ে) করে রস বের করে নেয়া হয়।
এরপর বড় ড্রামে করে রস জাল করে গাঢ় করা হয়। বড় মাটির পাতিলে ঢেলে রাখলে তা জমে যায়। যাকে বলা হয়, লালী খয়ের বা কাচা খয়ের। এই লালী খয়ের একমাত্র চারঘাটের হাটে কেনা-বেচা হয়ে থাকে। যা বাংলাদেশের আর কোথাও কেনা-বেচা হয় না। স্থানীয় খয়ের ব্যবসায়ীরা এই লালী খয়ের ক্রয় করে পূর্ণরায় আগুনে জাল করে। একটু ঠান্ডা হলে মেশিনের সাহায্যে চাপ দিলে বের হয়, চার কোণা আকৃতি খয়ের। গুটি করে কেটে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঠান্ড স্থানে শুকাতে হয়।
কারন-রোদে শুকালে খয়েরের দানা নষ্ট হয়ে যায়। খয়েরের গুটি শুকাতে ২থেকে ৩ মাস সময় লাগে, যার কারনে খয়ের ব্যবসায়ীদের তিনগুন পুজী (টাকার) প্রয়োজন হয়। গুটি শুকানোর পর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা গুটি খয়ের ঢাকা, খুলনা যশোর রংপুর সৈয়দপুর জামালপর শেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তাণী করে থাকেন। তবে অনেক ব্যবসায়ীরা আড়তদারদের কাছ থেকে খয়েরের টাকা ঠিক সময় না পাওয়ায় কারণে ব্যবসায় ভাটা পড়ে যায়। আবার অনেক ব্যবসায়ী দেশের বিভিন্ন স্থানে খয়ের টাকা বাকী পড়ে যাওয়ায় মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে।
চারঘাট সদরের খয়ের ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করলে তারা দুঃখ করে বলেন, আমার বাবার আমল থেকে প্রায় ৪০/৫০ বছর থেকে আমরা এই খয়ের ব্যবসার সাসে জড়িত। আগের মতো এখন আর খয়ের ব্যবসা তেমন লাভ নেই। বর্তমানে চারঘাটের এই ঐতিহ্যবাহী খয়ের ব্যবসায় চরম মন্দাভাব চলছে। এই ব্যবসায় অনেক সময় ব্যবসায়ীক কারণে বিভিন্ন মোকামে টাকা পড়ে থাকে। এ কারণে খয়ের ব্যবসায় তিন গুন টাকার প্রয়োজন হয়।
যার জন্য স্থানীয় খয়ের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে আছে। বর্তমানে চারঘাটে কাচা লালী খয়ের ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা মণ এবং শুকনা গুটি খয়ের থেকে ৩০ হাজার টাকা মণ মুল্য বেচা-কেনা হচ্ছে। চারঘাটের বিশিষ্ট খয়ের ব্যবসায়ী আব্বাস আলি শেখ জানান, তার বাবা মৃত ওমর আলি শেখ দীর্ঘ দিন থেকে এই খয়ের ব্যবসা চালিয়ে এসেছেন। আমি ব্যবসার ক্ষতি হলেও বাবার ব্যবসাটির ঐতিয্যে ধরে রেখেছি। আগে বিভিন্ন এলাকায় অনেক খয়ের গাছ হতো কিন্তু এখন এই খয়ের গাছ পাওয়া যায় না বললেই চলে।
এখন বিভিন্ন এলাকা থেকে চারঘাটের শনিবার ও বুধবার সপ্তাহে ২ দিন চারঘাটের হাটে এই খয়ের গাছ কেনা-বেচা হয়। খয়ের ব্যবসায় যেমন এখন আগের তুলনায় লাভ কমেগেছে তেমনি এখন খয়ের গাছ না পওয়ায় এই খয়ের গাছও কিনতে হচ্ছে দ্বিগুন দামে। দেশের ভেতর একমাত্র চারঘাটের খয়ের গুলি ভেজাল ছাড়া। বাকি দেশের বিভিন্ন স্থানে যে খয়ের পাওয়া যায় সেগুলি কেমিক্যালযুক্ত দিয়ে তৈরি করা খয়ের। চারঘাটের খয়ের ব্যবসায়ীরা এখানকার ঐতিহ্যবাহী এই খয়ের শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে আসছেন ।