উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাস, অবদান ও গুরুত্ব ইতিহাস সচেতনরা ভালো করেই জানেন। এ অঞ্চলের অনেক পন্ডিত, জ্ঞানী-মহাজ্ঞানীর জন্ম দিয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা। ধর্ম, নৈতিকতা ও আধুনিকতার সমন্বয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা এগিয়েছে সগৌরবে। বিশেষ করে শুরুর দিকে এ দেশের মাদ্রাসাগুলি ব্যক্তি ও সমষ্টিগত উদ্যোগে গড়ে উঠলেও পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে এসব মাদ্রাসা রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য পেয়েছে। যে সব মাদ্রাসার সুনাম-সুখ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে এমনই একটি মাদ্রাসা হচ্ছে সিলেটের জকিগঞ্জের বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসা। দেশের মানচিত্রে পাখির ঠোঁটের মতো বাড়তি স্থানটি সীমান্ত এলাকা জকিগঞ্জের এ মাদ্রাসাটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে ২০২০ সালে শতবর্ষকে স্পর্শ করেছে। দীর্ঘ শতবর্ষের পথচলায় সিলেট অঞ্চলের ধর্মীয়, নৈতিক, মানবিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও শৈক্ষিক পরিবেশকে প্রভাবিত করেছে এ মাদ্রাসাটি। কিংবদন্তীতুল্য বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসার সৌরভ ও গৌরব ঈর্ষণীয়। ধর্মপ্রাণ এলাকাবাসীর উদ্যোগে ১৯২০ সালে মক্তব হিসেবে যাত্রা করলেও পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে ছড়িয়েছে তার ডালপালা ; বেড়েছে তার পরিধি। একপর্যায়ে এ মাদ্রাসাটি উপমহাদেশের আধ্যাতিœক জগতের বটবৃক্ষ আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা লাভ করে। ছাহেব কিবলাহর নিজের শ্রম, ঘাম, মেধা, অর্থের পাশাপাশি তাঁর ভক্ত মুরিদানগণ এ মাদ্রাসার উন্নয়নের চাকাকে সচল রেখেছেন। ফুলতলী মাদ্রাসার শতবছরের ইতিহাস ঐতিহ্য মূলত গত ৫০ বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য। কারণ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী প্রায় ৫০ বছরের প্রাতিষ্ঠানিক প্রমাণাদি, দলিল দস্তাবেজ ও কাগজপত্র তেমন পাওয়া যায়নি। এলাকার প্রবীণ সচেতন ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পরবর্তী ছাত্র শিক্ষক ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠার প্রায় চার দশক পরে ১৯৫৯ সালে বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসাটি বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের দাখিল পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করে। মাদ্রাসার সুবর্ণ জয়ন্তীর পাঁচ বছর পর ১৯৭৫ সালে এ মাদ্রাসার হাল ধরেন আল্লামা ফুলতলীর সুযোগ্য সন্তান মাওলানা নজমুদ্দিন চৌধুরী। ২০১৫ সাল পর্যন্ত একটানা ৪০ বছর তিনি নৌকার দক্ষ মাঝির মতো চালিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটি। ১২ বছর পরে ১৯৮৭ সালে তাঁর সাথে এ মাদ্রাসায় যুক্ত হন বর্তমান অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুর রহিম। যোগদানের পর থেকেই ছায়া হয়ে অধ্যক্ষ নজমুদ্দীনের প্রতিটি কাজে বুদ্ধিদীপ্ত সহযোগিতা করেন মাওলানা আবদুর রহিম।
মাদ্রাসাটিতে ১৯৭৭ সালে আলিম, ১৯৮৯ সালে ফাজিল, ১৯৯৪ সালে কামিল(হাদীস) ২০০১ সালে কামিল তাফসীর ও ২০১০ সালে অনার্স কোর্স চালু হয়। ১৯৭৭ সালে মাদ্রাসায় একটি পাঠাগার গড়ে তোলা হয়। যেখানে বইর সংখ্যা অনুমান ১০ হাজার। ১৯৮৯ সালে লতিফিয়া ছাত্রাবাস নামে ছাত্রদের আবাসিক হল প্রতিষ্ঠা করা হয় মাদ্রাসায়। যেখানে বর্তমানে প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী অবস্থান করে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করছে।
দেশী বিদেশী বহু শিক্ষানুরাগীর সাহায্য সহযোগিতায় এলাকাবাসীর আন্তরিকতায় ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর বদান্যতায় ফুলতলী মাদ্রাসায় ফুটেছে শত ফুল। বহু ত্যাগী ও প্রাজ্ঞ শিক্ষক দীর্ঘ সময়ে সিলেটের সবুজ শ্যামল নিভৃত পল্লী ফুলতলীতে জ্ঞানের মশাল জালিয়েছেন। প্রায় তিন একর জায়গার উপর গড়ে উঠা ক্যাম্পাস প্রয়োজনের তুলনায় ছোট হলেও ক্যাম্পাসের বাইরে মাদ্রাসার প্রায় ১৭ একর অর্থাৎ ৫১ বিঘা জমি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৪ একর জমি আল্লামা ছাহেব কিবলাহ একাই দান করেছেন। মাদ্রাসার ৫টি ভবনের মধ্যে ইউ আকৃতির মূল অ্যাকাডেমিক ভবন, একটি পরীক্ষার হল, ৩টি ছাত্রাবাস রয়েছে।
বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ধর্ম শিক্ষার অন্তপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ছাহেব কিবলাহ ২০০৮ সালে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত মাদ্রাসার সার্বিক দিকের প্রতি যতœবান ছিলেন। মাদ্রাসার ছাত্রাবাসের গরীব শিক্ষার্থীদের জন্য আমৃত্যু তিনি ভর্তুকি দিয়ে গেছেন। বর্তমানে ফুলতলী মাদ্রাসায় প্রায় ১৫শ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। ২৯জন শিক্ষক ও ৫জন কর্মচারীর একান্ত প্রয়াসে প্রতি বছরই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসা বোর্ড ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই অবস্থান করে ছাহেব কিবলাহ প্রতিষ্ঠিত লতিফিয়া এতিমখানায়। এতিমখানায় অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয় বহনে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখছেন এতিম অনাথদের আপনজন আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ। এ পর্যন্ত এ মাদ্রাসা থেকে মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি কামিল(এমএ) পাস করেছেন প্রায় ১৩শ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া প্রতি বছরই এখান থেকে দাখিল, আলিম, ফাজিল পাস করে অন্যত্র ভর্তি হচ্ছে। বিশেষ করে আলিম পাস করার পর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে এ মাদ্রাসার ছাত্ররা। বিগত দিনে এ মাদ্রাসা শুধু আলিম উলামাই তৈরী করেনি এ মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে পরবর্তীতে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিসিএস কর্মকর্তা, আইনজীবি, পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যাংকার, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী কিংবা প্রবাসী হিসেবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন অনেকেই। ফুলতলী মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষার্থী কোহেল তাপাদার রুপচাঁদা সুপার সেফ-২০১৯ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশ সেরা হিসেবে ৫ লক্ষ টাকা জিতে নিয়েছে। এভাবে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এ মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষার্থীরা। ২০১৪ সালে এ মাদ্রাসায় প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন আল্লামা ছাহেব কিবলাহর সুযোগ্য নাতি সাবেক অধ্যক্ষ নজমুদ্দিন চৌধুরীর মেধাবী পুত্র মাওলানা মাহমুদ হাসান চৌধুরী রায়হান। ২০১৬ সালে বর্তমান অধ্যক্ষ আবদুর রহিম অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় উপাধ্যক্ষের শূন্য পদে মাহমুদ হাসান চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। মাহমুদ হাসান চৌধুরী মাদ্রাসায় যোগদান করে মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়নের দিকে নজর দেন। ইতঃপূর্বে মাদ্রাসায় রজতজয়ন্তী, সুবর্ণজয়ন্তী, প্লাটিনাম জুবিলি পালিত না হলেও মূলত মাহমুদ হাসান চৌধুরীর আগ্রহে ফুলতলী ছাহেব বাড়ীর সকলের আন্তরিক সদিচ্ছার কারণেই এবার শতবর্ষের অনুষ্ঠানটি হচ্ছে ২০ ফেব্রুয়ারি। অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, দেশী বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন।
আল্লামা ফুলতলীর কারণে ফুলতলীর পরিচিতির পরিধি দেশজুড়ে-বিশ্বজুড়ে। রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি,মন্ত্রী, এমপি, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ দেশী বিদেশী বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির আগমনে ফুলতলী মাদ্রাসার প্রাঙ্গণ ধন্য হয়েছে ; পেয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
বাতির নিচে অন্ধকার থাকে। ১০০ বছরের পুরনো ফুলতলী মাদ্রাসায়ও রয়েছে কিছু সমস্যা। এর মধ্যে শিক্ষক আবাসিক নেই। শিক্ষার্থীদেরও আবাসিক সংকট রয়েছে। নেই পর্যাপ্ত সৌচাগারও। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে এখানে এখনো কম্পিউটার ল্যাব হয়নি।দুর্বল গতির ইন্টারনেটের কারণে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণি কক্ষও চালু করা যাচ্ছে না পুরোপুরি। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র মিলনায়তন এবং মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন নেই এখানে। শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক ও কর্মচারীর অভাব রয়েছে এ মাদ্রাসায়।
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আশা করছেন সরকারীভাবে নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন চারতলা বিশিষ্ট একাডেমীক ভবনটি নির্মিত হলে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মাদ্রাসার অ্যধক্ষ আবদুর রহিম ও ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ মাহমুদ হাসান চৌধুরী জানিয়েছেন আগামীতে মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিভাগ ও ভাষা শিক্ষার বিশেষ কোর্স চালুসহ মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। ‘শতবর্ষে জেগেছে প্রাণ, ঐতিহ্যে অম্লান’ হ্যাঁ। স্মৃতি আয়নায়, ইতিহাসের পাতায়, ঐতিহ্যের ধারায় ফুলতলী মাদ্রাসা অনন্য। জকিগঞ্জ,সিলেট, দেশ তথা বিশ্বে আলো ছড়াতে ফুলতলী মাদ্রাসা ঠিকে থাকুক অনন্তকাল। ধর্মের প্রচার প্রসার, দেশের উন্নতি সমৃদ্ধি, মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হোক বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসা। আরো ৫০ বছর পরে মাদ্রাসার সার্ধশতবর্ষ আরো বড়ো আয়োজনে আরো প্রাপ্তির উজ্জ্বল্যে দীপ্তিমান হবে সে প্রত্যাশা রাখছি। জয়তু ফুলতলী মাদ্রাসা।