প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললে যে খবরগুলো মন খারাপ করে দেয় তার মধ্যে একটি হলো ধর্ষণ। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ বা গণধর্ষণ অথবা ধর্ষণের পর হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। এই কুৎসিত খবরটি আমাদের সমাজে কুৎসিত মানুষগুলো ঘটিয়েই চলেছে। প্রতিদিন একই চিত্র। তারা আইনের আওতায় আসছে, বিচার হচ্ছে কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। কোনো বয়সী নারীই আজ নিরাপদ নয়। কোথাও এবং কারও কাছেই নয়। মোট কথা দেশব্যাপী নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ২০১৯ সালে মোট ৪ হাজার ৬২২ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৩৭০ জন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩৭ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৭ জনকে এবং ধর্ষণের কারণে আতœহত্যা করেছে ১৯ জন। অথচ ২০১৮ সালে মোট নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয় ৩ হাজার ৯১৮ জন। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৯৪২ টি। গণধর্ষণের শিকার হয় ১৮২ জন। এক বছরেই ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। কোনোভাবেই যখন ধর্ষণ রোধ করা যাচ্ছে না তখন দাবি উঠছে এর শাস্তি আরও দ্রুত এবং কঠোর করার। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেবল আইনের কঠোরতা কি ধর্ষণ রোধ করতে পারবে? সমাজের যে নৈতিক অধঃগতি তা রোধ করারও প্রয়োজন রয়েছে। দীর্ঘ সাত বছর পর নির্ভয়াকান্ডে দোষীদের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এদেশের নির্ভয়ারাও নির্ভয়ে থাকতে পারে না। নির্ভয়াদের মতো আমাদের তিশা,তনুদেরও এক অবস্থা। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। কখন, কোথায় কিভাবে নির্যাতনের শিকার হবে তা কেউ বলতে পারে না। আমাদের নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুরা তালিকাও ক্রমেই বাড়ছে। থামছে তো না উপরন্তু প্রতিটি ঘটনাই বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সবাই যখন উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত ঠিক সেই সময়েও কেউ না কেউ ধর্ষিত হচ্ছে। কে যে ধর্ষক আর কে যে মানুষ তা নির্ধারণ করা আজ আর সম্ভব নয়। নতুন বছরের কয়েকদিন পেরোতেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। বিকৃত মানসিকতার মানুষেরা তাদের বিকৃত কাম চরিতার্থ করতে শুরু করেছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। পত্রিকার পাতায় সে খবর আমরা পাই। এরই মধ্যে কোনো কোনো ঘটনায় দেশের শুভ চেতনার মানুষ রাস্তায় নামে। প্রতিবাদ জানায়। তারপও আবার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এই চলছে গত কয়েক বছর ধরেই। অদৃশ্য দানব চেপে বসছে আমাদের মাঝে। ধর্ষকদের আইনেরও আওতায় আনাও হচ্ছে। শাস্তিও হচ্ছে। তাও যেন কোনোভাবেই ধর্ষণের ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। এটা এখন মানসিক বিকৃতির চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে। ঘরে, রাস্তায়,দোকানে,চাকরিতে,স্কুল-কলেজে কোথাও তারা নিরাপদ নয়। প্রশ্ন হলো তাহলে কি উপায়ে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো অপরাধ সমাজ থেকে কমিয়ে আনা যায়। আইনের যথাযথ প্রয়োগের সাথে সাথে সমাজের মানসিক উন্নয়ন করা প্রয়োজন। তাছাড়া প্রযুক্তিও ধর্ষণ ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক দেশেই ধর্ষণ প্রতিরোধে অ্যাপস ব্যবহৃত হচ্ছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে কিছু অ্যাপস ডিভাইসও তৈরি হয়েছে। যেহেতু এখন প্রত্যেকের হাতে অ্যান্ড্রয়েট চালিত মোবাইল ফোন তাই প্রযুক্তি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কতৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারে। যেকোনো উপায়েই আমাদের দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধ কমাতেই হবে। একটি সমাজ তার নিজস্ব গতিধারায় চলে। ইতিহাস স্বাক্ষী আছে সেই ধারায় সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে নারীরা। আজও যতই অধিকারের কথা বলা হোক অবস্থার উন্নতি খুব বেশি হয়নি। মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারিনি। সমাজের সেই গতিধারা ইতিবাচক না নেতিবাচক হবে তা নির্ভর করবে সেই সমাজের মানুষের ওপর। আমাদের মানবিক গতিধারা এখন নেতিবাচকভাবেই প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা সেই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছি। কিন্তু এর থেকে উত্তরণের উপায় কি? ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন যে ঘটনাই ঘটুক আমরা তা প্রতিরোধ করতে পারছি না। তার কারণ আমরা এটাই জানি না আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর কে কতটা মানবিক বা কার ভেতর কখন সেই নিষ্ঠুর দৈত্য জেগে উঠবে তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। ফলে আমরা তা ঠেকাতে পারছি না।
অনেক ক্ষেত্রেই পরোক্ষভাবে ধর্ষিতার দিকেই অভিযোগের আঙুল তোলা হয়। আসলে সাপ যাকে কোনদিন দংশন করেনি সে কি পারে বিষের যন্ত্রণা অনুভব করতে। যে পরিবারের একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয় সেই পরিবারই যন্ত্রণা বোঝে। মেয়েটির যন্ত্রণার সাথে সাথে তা পুরো পরিবারকে যন্ত্রণা দেয়। আসলে কেবল পরিবার নয় প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনা দেশের প্রতিটি প্রতিবাদী মনকেই যন্ত্রণা দেয়। যন্ত্রণা দেয় একটি ধর্ষণের ঘটনা থামাতে না পারার কারণে, যন্ত্রণা দেয় নৈতিকতার অবক্ষয় দেখার কারণে। সমাজটা বড় অদ্ভূত। ধর্ষিতাকেই নানা কটু কথা শুনতে হয়। আবার ধর্ষকদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার লোকেরও অভাব হয় না। মেয়েটার কত দোষ চোখে আঙুল দিয়ে বের করে দেয়। এই সাফাই গাওয়ার প্রবণতা ধর্ষকদের উৎসাহ দেওয়ারই নামান্তর। কিন্তু আমরা তো একটা ধর্ষণকারী মুক্ত সমাজ চাই। ধর্ষণ তো কামের কুপ্রবৃত্তির চুরান্ত রূপ। কামের বশবর্তী হয়ে ওরা যে সমাজটাকেই ধর্ষণ করে চলেছে তার খবর ওরা রাখে না। সভ্য সমাজে অসভ্য হায়েনার নাচ আর কতকাল দেখতে হবে কে জানে। অবশ্য সভ্যতার দোহাই দিয়ে আজকাল আমরা যা করছি তাতে আর নিজেদের সভ্য বলা যায় কি না ভেবে দেখতে হবে। যারা ধর্ষক বা অত্যাচারকারী বা নির্যাতনকারী তাদেরও কি বোন নেই। তারাও কি তার ভাইয়ের মত অন্য কাউকে ভয় পায়। সে কি আদৌ জানে তার পরিচিত মুখ কতটা ভয়ংকর। অনেক পরিবারে মেয়ে জন্ম হলে যেন পরিবারে আনন্দিত হবার বদলে কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা যেত এবং আজও যায়। কন্যাশিশু জন্ম হওয়াতে পরিবারের সবার কপালে এই ভাঁজ পরতো। মেয়েদের ক্ষেত্রে ছিল পদে পদে নিষেধাজ্ঞা। তাদের পৃথিবী ছিল ছোট। আজ তাদের চলায় সেসব বাধা নেই। তবে চলার পথ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বিপদের শংকাও বেড়েছে বহুগুণ। আগে মেয়েদের এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না। এখানে মেয়েদের থাকা ঠিক না বা মেয়েরা এ কাজ করতে পারে না। তাদেরকে নানাভাবে ছোট করা হয়েছে, বানানো হয়েছে পুতুল। আগেই বলেছি পোশাকে হয় না, সভ্যতা হয় মনে। মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন অসম্ভব। মেয়েদের ভোগের বস্তুর দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার আগে একবার নিজের পরিবারের দিকে তাকাই।
একটি ইতিবাচক পরিবর্তন প্রয়োজন। একটি সুস্থ সমাজ গঠনের আন্দোলন প্রয়োজন। ধর্ষণ সহ সবরকম নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে একাট্ট্রা হওয়া প্রয়োজন। কারণ নারীর পূর্ণ শক্তি কাজে লাগাতে হলে তাদের সেই পথ দিতে হবে। নারী অসুর বিনাশক। নারী-পুরুষ দ্বৈত শক্তিই পারে সমাজের কুলষ দূর করে সমাজকে শুদ্ধ করতে। যে সমাজ হবে সবার জন্য নিরাপদ। যে সমাজে কোনো শিশুকে পাশবিকতার শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে না। এর থেকে স্থায়ী প্রতকিার পেতে হলে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। বিবেকহীন,নিষ্ঠুর,হিং¯্র মানুষ যে সমাজ থেকে একেবারে নির্মুল করা সম্ভব হবে তা বলা যায় না। শরীরে যেমন রোগের জীবাণু থাকবেই, তার যেমন প্রতিষেধক আছে তেমনি ধর্ষণ নামক এই ব্যাধীরও প্রতিষেধক আছে। তা খুঁজে বের করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ধর্ষণ নামক সামাজিক এই ব্যাধী সমাজ থেকে তাড়াতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে সুন্দর সুষ্ঠ সমাজ গঠনের বিকল্প নেই।
লেখক- শিক্ষক ও কলামিষ্ট