শুষ্ক মৌসুমে আবাদি জমিতে কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি। বর্ষাকালে তো এলাকাটি নদীর রূপ নেয়। ফলে কৃষককে প্রতি বছরই আবাদকৃত ফসলের কাক্সিক্ষত উৎপাদনের খুবই নগণ্য অংশ পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বছরের পর বছর ধরে চলে এ পরিস্থিতি।
রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার চৈত্রকল বিলের হেক্টরের পর হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতার কারণে কৃষক এ ভোগান্তি পোহাতেন। কিন্তু গেল অর্থবছরে (২০১৮-১৯) প্রায় ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসির) রংপুর সাড়ে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল খনন করে। এ খালের সুফল এরইমধ্যে ভোগ করতে শুরু করেছেন ১নং চৈত্রকল ইউনিয়নের ১৪ গ্রামের ১২ হাজারের বেশি মানুষ। এরইমধ্যে আমন মৌসুমে ভালো ফলন পেয়ে উচ্ছ্বসিত কৃষক কোমরবেঁধে বোরো মৌসুমে ধানের জমি পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন।
চৈত্রকল ইউনিয়নের মোট আয়তনের প্রায় ৮০ শতাংশজুড়েই এ বিল। তবে পানি অপসারণ না হওয়ায় বিলটির ২ হাজার ২০০ হেক্টর জমির মধ্যে ১ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে সব সময় জলাবদ্ধতা লেগে থাকত। এ বিলের আশপাশে অনেক বছর ধরে কয়েকশ পরিবারের বসবাস। এসব পরিবারের উপার্জনের মাধ্যম কৃষিকাজ। তারাই সরকারের কাছ থেকে কৃষিকাজের জন্য জমি লিজ নিয়েছেন। কিন্তু জলাবদ্ধতার জন্য আমন ও বোরো মৌসুমে কেউই কাক্সিক্ষত ফসল ঘরে তুলতে পারছিলেন না। এতে লিজ নেওয়া জমির তেমন সুফল পাচ্ছিলেন না তারা।
সরেজমিন চৈত্রকল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খালের চারদিকে সারি সারি ধানের জমি। কোথাও কৃষক ট্রাক্টর দিয়ে জমি তৈরি করছেন, আবার কোথাও চারা রোপণ শেষ হয়েছে, আবার কোথাও চারা রোপণ চলছে। এ ছাড়া সুবিধাভোগীরা একত্র হয়ে পানির প্রবাহ ঠিক রেখে সদ্যখননকৃত খালে মাছ চাষ শুরু করেছেন। আবার খালকে ঘিরে চলছে হাঁস পালন। এ ছাড়া কেউ কেউ ছাগল ও ভেড়া পালন শুরু করেছেন।
জমি পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, খাল খননের ফলে এবার প্রথম আমন মৌসুমে ছয় একর জমিতে আবাদ করেছেন। ভালো ফলনও পেয়েছেন। সব মিলিয়ে ধান পেয়েছেন ১৬০ মণ। খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘খাল খননের আগে আমন মৌসুমেও এখানে জলাবদ্ধতা থাকায় আমরা ইচ্ছে করে অধিকাংশ জমি ফেলে রাখতাম।’ কৃষক সিদ্দিকুল ইসলাম জানান, তার চার একর জমি একটু উঁচুতে অবস্থিত। তারপরও আগে বোরো মৌসুমে যে অল্প জমিতে বোরো ধান করতেন, অনেক সময় ফলন ঘরে তোলার বিষয়টি ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হতো। বৃষ্টিপাত শুরু হলে ফলন ঘরে তুলতে শ্রমিকদের যে টাকা দিতে হতো, তাতে ব্যয় বেড়ে যেত অনেক। অনেকে শ্রমিক ধরে ধানও তুলতে চাইতেন না। এবারই প্রথম তারা বোরো ধান রোপণ শুরু করেছেন। কারণ খননকৃত খালের পানি থেকে সেচ দেওয়ায় উৎপাদন খরচ যেমন কমবে, খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন হওয়ায় বর্ষার সময় জলাবন্ধতা সৃষ্টি হবে না। ফলে ফলন ঘরে তুলতে কোনো সমস্যা হবে না বলে তিনি আশাবাদী।
আবাদের পাশাপাশি কৃষক নুর জামাল খালে ১২ হাঁস এবং কৃষক নুরু ৮০০ হাঁস পালন শুরু করেছেন। এদের দেখাদেখি অনেকেই শাকসবজি রোপণ, ছাগল-ভেড়া পালন এবং মাছসহ বিভিন্ন আয়বর্ধক রোজগারে ঝুঁকছেন।
১নং চৈত্রকল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান সবুজ বলেন, জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য স্পিকার এবং পীরগঞ্জের সংসদ সদস্য শিরীন শারমিন চৌধুরীকে অবগত করলে তিনিই উদ্যোগী হন। এতে অনেক বছরের পুরোনো সমস্যার দূর হয়েছে।
তার ইউনিয়নের ১৪ গ্রামের প্রায় ১২ হাজার মানুষ উপকৃত হয়েছেন উল্লেখ করে চেয়ারম্যান বলেন, চৈত্রকল বিলের যে জায়গাটিতে জলাবদ্ধতার জন্য এতদিন আবাদ হতো না, এখন পুরোদমে আবাদ শুরু হলে এখানকার উৎপাদিত চাল দিয়ে পীরগঞ্জবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠ চাহিদা পূরণ হবে।
রংপুর বিএডিসির নির্বাহী প্রকৌশলী এএইচএম মিজানুল ইসলাম বলেন, প্রায় ১ হাজার ৪০০ হেক্টর এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য খাল কেটে করতোয়া নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হওয়ার পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুমে ফসলের সেচ হিসেবে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার নিশ্চিত হয়েছে। এতে ভূগভীরস্থ পানির ব্যবহার কমার ফলে পানির স্তর ঠিক থাকবে। এ ছাড়া কৃষিকাজের পাশাপাশি কৃষক মাছ এবং হাঁস পালনসহ বিভিন্ন আয়বর্ধক উৎপাদনের মাধ্যমে তাদের আয়রোজগাড় বৃদ্ধি করতে পারবেন।