স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মাত্র ১১ মাস খুব কাছ থেকে নিজ চোখে দেখেছি। তার অনেক স্নেহ ও ভালবাসা পেয়েছি। তিনি যে কতোটা উদার মনের মানুষ ছিলেন, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
এ দেশের মানুষকে তিনি যে কতোটা ভালবাসতেন, কতোটা বিশ্বাস করতেন, তা যারা বঙ্গবন্ধুর সানিধ্য পেয়েছেন তারা ছাড়া কেউ বুঝবেন না। নিঃস্বার্থ, নিলোর্ভ, দেশপ্রেমিক বঙ্গবন্ধুকে যে এ দেশের নরপিচাশদের হাতে জীবন দিতে হবে, এত তাড়াতাড়ি যে বঙ্গবন্ধুকে হারাতে হবে তা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। এদেশে এখনো কিছু মানুষের শরীরে মীরজাফর ও পাকিস্তানী গোলামের রক্ত বইছে। তাই ওইসব মীরজাফরদের বংশধররা বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি।
স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পর বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের টানা মেয়াদের সময়ে এদেশের মানুষ কেবল স্বাধীনতার সুফল ভোগ করা শুরু করেছে। পুরোপুরি স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। মীরজাফর ও গোলামদের রক্ত যেদিন এদেশের মাটি থেকে চিরদিনের জন্য মুছে যাবে, তখন থেকেই মানুষ স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল ভোগ করা শুরু করবে। এজন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেন পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তা হায়াতে তাইয়্যেবা দান করেন, তাকে যেন সুস্থ্য রাখেন এই দোয়াই করছি।
আবেগাপ্লুত হয়ে জনকণ্ঠর সাথে একান্ত আলাপনে কথাগুলো বলছিলেন, কর্মজীবনের শেষপ্রান্তে এসে বঙ্গবন্ধুর সময়কার (১৯৭৫ সালে) গণভবনের সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করা সেনাবাহিনীর ল্যান্স কর্পোরাল মোঃ ওয়াজেদ আলী শরীফ (৭৮)। চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের পর তিনি নিজ গ্রাম বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার বেলুহার এলাকায় একটি ছোট্ট চায়ের দোকান খুলে বসেন। বর্তমানে বয়স বেড়ে গেলেও তিনি চাকরির অবসরকালীন ভাতা (পেনশন) ও চায়ের দোকান থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই কোনমতে নিজের সংসারের হাল ধরে রেখেছেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সকল স্মৃতি আজো আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেকদিন সেইসব স্মৃতির কথা প্রজন্মের কাছে বলতে চেয়েছি কিন্তু আমার কথা শোনার মানুষ নাই। তাই আমার মৃত্যুর পূর্বে মুক্তিযুদ্ধের স্ব-পক্ষের পত্রিকা দৈনিক জনকণ্ঠ’র মাধ্যমে আমি আমার মনের কথাগুলো বলে যেতে চাই।
তিনি আরও বলেন, মাত্র ১১ মাস কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যেভাবে দেখেছি, তাতে তার কর্ম, আদর্শ ও আচারনবিধি নিয়ে আমি দুই থেকে তিনশ’ পৃষ্টার বই লিখলেও শেষ হবেনা। ওয়াজেদ আলী বলেন, ১৯৭৫ সালের ঈদণ্ডউল ফিতরের দিন সকাল বেলা আমাদের সিকিউরিটিদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশ দিয়েছিলেন আজ গণভবনের ১নং গেট দিয়ে কোন গাড়ি কিংবা কোর্ট, টাই পরা কোন ব্যক্তি ঢুকবেনা, শুধু সাধারণ মানুষ প্রবেশ করবে। ওইদিন ঈদের নামাজের পর থেকে বঙ্গবন্ধু একটানা বিকেল চারটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে গণভবনে আসা গরীব, অসহায়, দুঃস্থ ও ভিক্ষুকদের বুকে জড়িয়ে নিয়ে কুশল বিনিময় করেছেন। দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকা সত্বেও একটি বারের জন্যও বঙ্গবন্ধু ক্লান্ত বোধ করেননি। পরবর্তীতে তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমি শুধু বড়লোকের না গরীবেরও বন্ধু।
দীর্ঘ নিঃস্বাস ছেড়ে ওয়াজেদ আলী শরীফ বলেন, বাঙালির জীবনে ভাল কিছু বেশিদিন জুটলো না। যে ছেলে হয়ে বাবাকে (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু) মারতে পারে সেই কুলাঙ্গর সন্তানরা কোনদিনই মানুষ হতে পারেনা।
সূত্রমতে, বেলুহার গ্রামের আবদুল কাদের শরীফের দুই পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে ওয়াজেদ আলী ছিলেন সবার বড়। ১৯৬৯ সালে শোলক ভিক্টোরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেনীতে অধ্যায়নরত অবস্থায় সেনাবাহিনীর ওয়ালেস অপারেটর হিসেবে চাকরি নেন ওয়াজেদ আলী। পরবর্তীতে একমাস ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়ে সেনাবাহিনীর গাড়ির চালক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে তিনি (ওয়াজেদ) সেনাবাহিনীর ল্যান্স কর্পোরাল হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। চাকরির পর পরই ওয়াজেদ আলী শরীফকে পশ্চিম পাকিস্তানে পোস্টিং করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে তাকেসহ (ওয়াজেদ) এদেশের অসংখ্য সেনা সদস্যদের পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘ ২৩ মাস আটক করে রাখা হয়। সেসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও কারাগারে বন্দি ছিলেন।
ওয়াজেদ আলী শরীফ বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটক থাকার পর যে জীবন নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসতে পারবো তা আমিসহ পরিবারের কেউ ভাবিনি। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর সিমলা চুক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে টানা ১১ মাস স্বাধীন বাংলাদেশের গণভবনের সিকিউরিটি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সেনাবাহিনীর ল্যান্স কর্পোরাল ওয়াজেদ আলী শরীফ।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট স্ত্রীর অসুস্থ্যতার কারণে ছুটি নিয়ে আমি বাড়িতে আসি। ১৫ আগস্ট সকালে রেডিওতে আমি খবর শুনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং আমাদের (ওয়াজেদ) প্রতিবেশী বঙ্গবন্ধুর বোনজামাতা মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে হত্যা করা হয়েছে।
সূত্রমতে, এখবর পেয়ে ওইদিনই শোকে কাতর ওয়াজেদ আলী পাঁচদিনের ছুটি থাকা সত্বেও ঢাকায় ফিরে তার কমান্ডিং অফিসারের সাথে দেখা করেন। ওয়াজেদ আলীর শোকের চেহারা দেখে তার কমান্ডিং কর্মকর্তা পূর্ণরায় তাকে সাতদিনের ছুটিতে পাঠিয়ে দেন। ছুটি শেষে পূর্ণরায় ইউনিটে যোগদান করেন ওয়াজেদ আলী শরীফ। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। বর্তমানে স্ত্রী, ৩ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানকে নিয়েই তার (ওয়াজেদ আলী) সংসার।