করোনা আতঙ্কের পর নগরীসহ জেলার প্রতিটি উপজেলার ওষুধের ফার্মেসি থেকে নাপা, অ্যান্টি-হিস্টামিন, অ্যান্টি-ম্যালেরিয়ার, ভিটামিন সি, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, গ্যাস্টিকের বিভিন্ন ওষুধ গায়েব করে দেয়া হয়েছে। ফলে ফার্মেসিগুলোতে এ জাতীয় ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। একইসাথে করোনা মোকাবেলার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহৃত মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, হেক্সিসল ও স্যানিটাইজার ফার্মেসি থেকে উধাও হয়ে গেছে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকার একাধিক ফার্মেসি মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্বজুড়ে মহামারি আকারে ছড়ানো করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বৃহস্পতিবার থেকে ১০ দিনের ছুটি শুরু হয়েছে। এই ১০ দিন বাড়িতে অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। প্রশাসনকে সহায়তা দিতে সশস্ত্র বাহিনী নামানো হয়েছে। এমন খবরে গত রোববার থেকে ফার্মেসিগুলোতে ওষুধ কিনতে ক্রেতাদের ভিড় বেড়ে যায়। সেই সাথে প্যারাসিটামল, নাপা, অ্যান্টি-হিস্টামিন, অ্যান্টি-ম্যালেরিয়ার, ভিটামিন সি, অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও গ্যাস্টিকের বিভিন্ন ধরনের ওষুধের বিক্রি বেড়ে যায়।
ফার্মেসি মালিকরা জানান, গত চারদিনে এসব ওষুধ যে পরিমাণে বিক্রি হয়েছে, গত চার মাসেও তা বিক্রি হয়নি। তাই চাহিদা দেয়া সত্বেও ওষুধ কোম্পানীর স্থানীয় বিক্রয় প্রতিনিধিরা ওষুধ সরবরাহ না করায় ওইসব ওষুধের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে নগরীর অধিকাংশ ফার্মেসিতে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, হেক্সিসল ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার নেই। হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যবহৃত এসব পণ্যসামগ্রী। তবে অধিকামূল্যে বেশ কিছু দোকানে এসব পণ্যসামগ্রী বিক্রি করারও প্রমান মিলেছে।
ফার্মেসি মালিকরা জানান, দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের পর হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বিক্রি বেড়ে গেছে। মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্রয় করার কারণেই হঠাৎ করে এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রয়োজন একটা সে কিনছে ১০টা। আগে যেখানে মাসে ৯০টা হেক্সিসল বিক্রি হতো না, সেখানে একদিনে তিন থেকে চার হাজার বিক্রি হয়েছে। মানুষের বাড়াবাড়ির কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা আরও জানান, সবকিছুতেই রাষ্ট্রের একটা ক্যাপাসিটি রয়েছে, অবস্থা স্বাভাবিক হতে আরও এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
নগরীর বটতলা বাজার সংলগ্ন নাফি ফার্মেসির মালিক মীর হাসান মোর্শেদ জানান, তার ফার্মেসিতে প্রায় চারশ’ ধরনের ওষুধ রয়েছে। তবে গত চারদিনে প্যারাসিটামল, অ্যান্টি-হিস্টামিন, অ্যান্টি-ম্যালেরিয়ার, নাপা, ভিটামিন সি, অ্যাজিথ্রোমাইসিন জাতীয় ওষুধ যে পরিমাণে বিক্রি হয়েছে, গত চার মাসেও তা বিক্রি হয়নি। একেকজন ১০ পাতা নাপা কিনেছেন। অতিরিক্ত চাহিদার কারণে ওষুধের সংকট চলছে। মীর হাসান মোর্শেদ জানান, তিনি খুচরা বিক্রেতা। পাইকারি দোকান থেকে কিনে এনে তিনি ওষুধ বিক্রি করেন। ওইসব ওষুধের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাকে আগের চেয়ে বেশি দামে ওষুধ কিনতে হয়। পাঁচদিন আগে নাপা ৫১০ পিস ট্যাবলেটের বক্স কিনেছেন ৩৫৮ টাকায়। বর্তমানে যার পাইকারী দাম রাখা হচ্ছে প্রায় চারশ’ টাকা।
নগরীর কাকলীর মোড় সিটি ফার্মেসির মালিক সুশান্ত কুমার বিশ্বাস বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো চাহিদামতো ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না। এ কারণে ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। নগরীর পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বিক্রির অন্যতম প্রতিষ্ঠান জেলখানা মোড় এলাকার বিষ্ণুপ্রিয়া ফার্মেসির মালিক হরিমোহন কর্মকার বলেন, অনেকেই অতিরিক্ত ওষুধ ক্রয় করে বাড়িতে মজুত রেখেছেন। প্রয়োজনে যেন তাকে ফার্মেসিতে আসতে না হয়। এজন্যই মূলত ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিক্রয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ওষুধ কোম্পানিগুলোতে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। তারা জানিয়েছেন ওষুধ তৈরির কাঁচামালের সংকট রয়েছে। এ কারণে তাদের সরবরাহ করতে সময় লাগবে। সরবরাহ না হলে আগামী ১৫ দিন পর এসব ওষুধ আর বাজারে পাওয়া যাবেনা বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মনোয়ার হোসেন বলেন, আবহাওয়ার পরিবর্তন হলে জ্বর-সর্দি-কাশি বা সামান্য গলাব্যথা হতেই পারে। এসব মানেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নয়। একবার ঠান্ডা লাগলে তা সারতে অন্তত এক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। কাশিতো আরও বেশ কয়েকদিন থাকতে পারে। এজন্য ভয়ের কিছু নেই। ভাইরাস জ্বরের পর জ্বর-সর্দি ভালো হয়ে গেলেও সাধারণত কাশি ভালো হতে চায়না। কয়েক সপ্তাহব্যাপী লেগেই থাকে। তিনি আরও বলেন, আমাদের অতিরিক্ত ওষুধ সেবনের প্রবণতা রয়েছে। অনেকেই চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ওষুধের দোকানির কাছে অ্যান্টিবায়োটিক চান, ব্যথার ওষুধ চান। যদিও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ও পেইন কিলার কেনাবেচা করা নিষিদ্ধ। কিন্তু এই নিষেধ রোগীরাও মানছেন না, ওষুধের দোকানিও মানেন না।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের বরিশাল কার্যালয়ের তত্ত্ববধায়ক অদিতি স্বর্ণা বলেন, প্যারাসিটামল, অ্যান্টি-হিস্টামিন, অ্যান্টি-ম্যালেরিয়ার, ভিটামিন সি, অ্যাজিথ্রোমাইসিন জাতীয় ওষুধ সংকটের কথা জানা নেই। তবে অ্যান্টি-ম্যালেরিয়ার ওষুধের সংকট থাকতে পারে। এ কারণে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে সংশ্লিষ্ট কোম্পনিগুলোকে অ্যান্টি-ম্যালেরিয়ার ওষুধ উৎপাদনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত দামে ওষুধ, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস ও স্যানিটাইজার বিক্রির ব্যাপারে জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, করোনাভাইরাসকে পূঁজি করে অতিরিক্ত মূল্যে যেকোন পন্য বিক্রি বন্ধে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে নগরীসহ জেলার প্রতিটি উপজেলার ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে অসংখ্য অসাধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ফার্মেসির মালিকদের জেল ও জরিমানা করা হয়েছে।