মতি চাচা। চা বিক্রেতা। ষাটোর্ধ বয়স। চার ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। মেয়েকে বিয়ে দিয়েও টাকার জন্য জামাইয়ের সংসারে উঠাতে পারছেন না। উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে বাগমারা বাজারে তার চায়ের স্টল। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি চলে তার গরম চায়ের কাপে চামচের ঝাড়ির ঝঙ্কার। প্রতিদিনই জনসমাগম। এদিকে গোটা পৃথিবী কাঁপছে করোনাভাইরাসের মহামারিতে। এর সংক্রমণ প্রতিরোধে অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে সর্বত্র। ফলে বন্ধ রাখতে হবে মতি চাচার চায়ের দোকানটিও। যত দিন এই করোনাভাইরাসের প্রভাব থাকবে-ততদিন মতি চাচার পরিবারের ডাল-ভাতের দায়িত্ব নিলেন এএসপি মো. ফজলুল করিম। তার এই মহানুভবতার জন্য এলাকায় তিনি প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন।
এদিকে কুমিল্লার হোমনা- মেঘনা সার্কেলের সিনিয়রস সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফজলুল করিম জেলা পুলিশ সুপার মো. নূরুল ইসলামের (বিপিএম) বার, পিপিএম’র দিক নির্দেশনায় মানবিক দিক বিবেচনায় রেখে প্রতিদিনই ঘাম ঝড়াচ্ছেন সামাজিক দূরত্ব বাজায় রাখা এবং জনগণকে সচেতন করার অভিযানের মধ্য দিয়ে।
সবার মনে ভয়-উৎকণ্ঠা বিরাজ করলেও করেনার প্রভাব যেন পড়ে না মতি চাচার ওপর। পড়বেই বা কী করে! একদিন চা বানাতে না পারলে না খেয়েই দিনাতিপাত করতে হবে তিন ছেলে আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে। তারপরও দেশকে ও দেশের প্রতিটি নাগরিককে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে হলে কঠোর হতেই হবে এএসপি সাহেবকে। প্রতিদিনই তিনি লোক সমাগম হয় এমন স্থান; যেমন- হাট-বাজার, চায়ের স্টল, রাস্তা-ঘাট, খেলা-ধুলার মাঠে হাজির হয়ে বুঝিয়েসুজিয়ে ঘরে ফেরান মানুষকে। এতেও টলে সাধারণ মানুষ। টলে না মতি চাচাও। রীতিমতো পুলিশ দেখলেই ঝাপি নামিয়ে দেন, চলে গেলে আবার আলো জ্বলে উঠে দোকানে। জড়ো হয় মানুষ। এতে ঝুঁকি বাড়ে পরিবারের, সমাজের, দেশের। প্রতিদিনই মতি চাচাকে সতর্ক করে ছেড়ে দেন সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফজলুল করিম। “আর এমন ভুল হবে না। আজকের জন্য মাফ করে দেন স্যার...” ইত্যাদি ইত্যাদি বাক্য বলে কেঁদেকেটে পার হন।
এমনি আর কত দিন! এক দিন ঠিকই মতি চাচা তার চা-স্টল বন্ধ করে দিলেন। হঠাৎ কয়েক দিন পর আবার ওই রাস্তা ধরে বাগমারা বাজারে অভিযানে বের হন পুলিশের এএসপি। চোখ পড়ে মতি চাচার স্টলে। দেখেন দোকান বন্ধ। আচমকাই অজানা শঙ্কায় বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। কানে বেজে উঠলো- নচিকেতা’র সেই বিখ্যাত গান, " ছেলে আমার মস্ত বড় মস্ত অফিসার..... "। ড্রাইভারকে খোঁজ নিতে বলেই গাড়ি থেকে নেমে পড়েন এএসপি ফজলুল করিম। দেখেন, দোকান বন্ধ। তবে দোকানটি একেবারেই বন্ধ হোক তা তিনি চাননি। চেয়েছিলেন, যাতে লোক সমাগম না হয়। এ অবস্থায় পুলিশের কঠোর মনের ভেতরেও মহানুভব আরেকটি মানুষের বসবাস রয়েছে। সেটাই জেগে উঠলো এই সহকারী পুলিশ সুপারের মধ্যে। এক অপরাধবোধে কুকড়ে যান তিনি। এ নিয়ে তার নিজস্ব ফেইসবুক আইডিতে একটি পোস্টও দেন। তাতে তিনি বর্ণনা করেছেন এভাবে- এর কিছু অংশ তুলে দিলাম ঃ
“ওই দিন বিকেলে যাবার পথে দেখলাম চাচার দোকান বন্ধ। আসার পথে গাড়ি চাচার দোকান ক্রস করতেই ড্রাইভার মকবুলকে ঝাড়ি দিলাম, বললাম দাঁড়াও। বলল, স্যার চাচার দোকান বন্ধ। দোকানটা বন্ধ দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল, দোকান বন্ধ হোক এটা চাইনি, চেয়েছি আড্ডাটা বন্ধ হোক। একজন মুরুব্বি মানুষ, যার বেঁচে থাকার অবলম্বন শুধু চা বিক্রি, সে কিভাবে চলবে??? নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল, কোনভাবেই একটু শান্তি পাচ্ছিলাম না।”
চা বিক্রেতা মতি চাচাকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। পরের দিন তার বাড়িতে গিয়ে চাল, ডালের দুটি প্যাকেট দিয়ে এলেন মহানুভব এই পুলিশের কর্তব্যাক্তি। আর নিশ্চয়তা দিয়ে গেলেন, যত দিন এই করোনাভাইরাসের প্রভাব থাকবে-ততদিন মতি চাচার পরিবারের ডাল-ভাতের দায়িত্ব এএসপি ফজলুল করিমের।
এ বিষয়ে মহানুভব এএসপি ফজলুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি অত্য বিনয়ের সঙ্গে বলেন, কুমিল্লা জেলার সন্মানিত পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বিপিএম ( বার), পিপিএম মহোদয় অনুপ্রাণিত করেছেন এ সময় খেটে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। মতি চাচার মত আপনার-আমার আনাচে কানাচে শত শত মানুষ আছেন, যাদের জীবন অচল হয়ে গেছে। যাদের জীবন থেমে যাবে করোনা ভাইরাসে নয়; খাবারের অভাবে। তাদেরকে যতই মৃত্যুর ভয় দেখান, তারা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেই ঘর থেকে বের হয়। আসুন সবাই সমস্যা চিহ্নিত করি সমাধানের চেষ্টা করি। সমাজের বিত্তশালীদের অনুরোধ করছি আপনারা পাশে এসে দাঁড়ান এইসব মানুষদের, এখনই সময়।