মণিরামপুরে প্রশাসনের হাতে জব্দকৃত সরকারি সীলযুক্ত খাদ্য অধিদপ্তরের ৫’শ ৪৯ বস্তা ত্রাণের চাউল কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী) প্রকল্পের বলে চালিয়ে দেয়ার পায়তারা করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট ৪ পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি) ডিও’র বিপরীতে এ চাল ছাড় দেয়া হয়েছে বলে উপজেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা দাবি করেছেন। কিন্তু এসব পিআইসিরা অনেকেই এসব কিছুই জানেনা। ফলে জব্দকৃত চাউলের আসল রহস্য উদঘাটনে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচ্চতর তদন্ত প্রয়োজন বলে দাবী উঠেছে। অপর দিকে আটক চাতাল মালিক ও ট্রাক চালককে দু’দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে প্রেরন করা হয়েছে। এদিকে কাবিখারও নাটকিয়তা ঢাকতে রাতের আঁধারে ওই প্রকল্প এলাকায় মাটি ভরাটের অভিযোগ উঠেছে।
সূত্রমতে, শনিবার সন্ধ্যায় পৌর এলাকার যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক সংলগ্ন বিজয়রামপুর গ্রামে ভাই ভাই রাইস মিল এ- চাতালে ট্রাক ভর্তি সরকারি সীলযুক্ত এ চাউল খালাস করাকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানা পুলিশ জব্দ করে। এ সময় পুলিশ চাতাল মালিক আব্দুল্লাহ আল মামুন ও ট্রাক ড্রাইভার ফরিদ উদ্দীনকে আটক করে। এ ঘটনায় মণিরামপুর থানার এসআই তপন কুমার সিংহ বাদি হয়ে ওই রাতেই অজ্ঞাতনামা ২/৩ জনসহ আটক দু’জনের নামে মামলা করেন। যার মামলা নং-০৪।
অনুসন্ধানে জানাযায়, এই ৪ পিআইসি’র কয়েকজন জানেন না ডিও নিয়ে কি করা হয়েছে। ডিও’র অন্তর্ভূক্ত রাজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট প্রকল্পের সভাপতি রাজগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল লতিফ জানান, এ প্রকল্পের বিপরীতে ২৫ মেট্রিক টন খাদ্য (চাউল) বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্পের প্রধম ধাপের ৬.২৫০ মেট্রিক টন চাউলের ডিও’তে গত ১২ মার্চ স্বাক্ষর করেন তিনি। কিন্তু এর পরের ঘটনা তিনি কিছুই জানেন না। তবে, চাউল জব্দের ঘটনা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে রোববার গভীর রাত থেকে সোমবার সারাদিন রাজগঞ্জ মাধ্যমকি বিদ্যালয়ে মাঠ ভরাটের কাজ শুরু করা হয়। তবে সে কাজের বিষয়েও অভিযোগ উঠেছে। স্কুল মাঠের নিচ থেকে সরকারি বাওড়ের বাঁধের ক্ষতি করে মাটি কাটা হচ্ছে।
রাজগঞ্জ সার্বজনীন দূর্গা মন্দির সংস্কার প্রকল্পের সভাপতি ভীম কুমার সাধু গত ১০ মার্চ ডিও’তে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা গেছে সেখানেও কোন প্রকার মাটি ভরাটের কাজ হয়নি। তিনি প্রতিবেদকের নিকট কোন সদত্তর দিতে পারেননি। কেএইচএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট প্রকল্পের সভাপতি এবং ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মান্নান গত ২৩ মার্চ দ্বিতীয় ধাপের কিস্তির ডিও’তে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু সে কাজে ঘাপলা রয়েছে। মাটি ভরাটের কাজ না হলেও তিনি জানান, অতি দ্রুত মাঠে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করা হবে। বালিদহ পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট প্রকল্পের সভাপতি বিকাশ কান্তি এবং একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ২০ মার্চ ডিও’তে স্বাক্ষর করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের জানান, মাঠ ভরাটের কাজ শুরু না হলেও বরাদ্দের বিপরীতে ৬.২৫০ মেট্রিক টনের প্রথম ধাপের ডিও’তে স্বাক্ষর করেছেন। এরপর কি হয়েছে তা তিনি জানেন না। তবে উপজেলা প্রশাসনের হাতে ৪’ ৪৯ বস্তা চাউল জব্দ ঘটনা প্রচার হওয়ার পর ওই সকল প্রকল্পের সভাপতিরা নড়েচড়ে বসাসহ এবং বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন।
অভিযোগ হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ দিন পর পিআইও অফিস থেকে ছাড়কৃত এসব ডিও’র বিপরীতে গত শনিবার চাউল ছাড় দেয়া হয়েছে বলে ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা দাবি করেন। কিন্তু এসব প্রকল্পের পিআইসিরা ডিও’তে স্বাক্ষরের পর আর কোনদিন তাদের ডাকা হয়নি। তাদের ডিও নিয়ে কি করা হয়েছে তাও তারা জানেন না। সূত্র জানায়, ওই সকল ডিও’র সভাপতিদের নিকট থেকে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে তাদের নামকাস্তে কিছু অর্থ প্রতিষ্ঠানে দেওয়ার নামে চাউলগুলো একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কালোবাজারে বিক্রি করা হয়। তবে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এর সুষ্ঠ তদন্ত করলে কাবিখা এবং ত্রাণ প্রকল্পের আরো অনিয়নের তথ্যচিত্র উদঘাটন হবে বলে এলাকার সচেতন মহল দাবী করেন।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাজমা খানমের ভাষ্যমতে জব্দকৃত চাউলগুলো আসলে কাবিখা প্রকল্পের নয় বলে দাবী করেন। তিনি জানান, করোনা সংকটে ত্রাণ কার্যক্রম বাঁধাগ্রস্থ না হয়, এজন্য খুলনার মহেশ্বরপাশার মানিকতলা খাদ্য গুদাম থেকে আনা ৪ ট্রাক চাউলের মধ্যে একটি ট্রাক ওই দিন (শনিবার) উপজেলা খাদ্য গুদামে খালাস না করে ভাই ভাই রাইস মিল এ- চাতালে খালাস করতে নির্দেশ দেয় চাউল সিন্ডিকেটের প্রধান নিয়ন্ত্রক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান উত্তম চক্রবর্তী বাচ্চু। চউালগুলো দুর্যোগ তথা ত্রাণ কার্যক্রমের জন্যই আনা হয় বলে জোর দাবী তোলেন। চাতালে হাতে-নাতে এ চাউল ধরার পর কাবিখা প্রকল্পের মাল হিসেবে চালানোর অপকৌশল নেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ দুইজনকে আটক পূর্বক থানায় একটি মামলা করলেও চাউল চোরাকারবারীর মূল হোতারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিশেষ তদন্ত করলে এর আসল রহস্য উদঘাটন হবে বলে দাবী করেছেন।
উপজেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মুন্না ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা একে অপরের বিপরীতমূখী বক্তব্য পাওয়া গেছে। ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তার দাবি, ৪ পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি) ডিও’র বিপরীতে এ চাউল ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনার ২ থেকে ৩ সপ্তাহ আগে পিআইসদের দেয়া ডিও নিয়ে কি করা হয়েছে সেটা তারাই জানেন, এর দায় দয়িত্ব তিনি নিবেন না।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) সিকদার মতিয়ার রহমান জানান, আটক দু’জনের ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (মণিরামপুর) আদালতে হাজির করা হয়। বিজ্ঞ আদালত শুনানি শেষে আটক দু’জনের ২দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রোববার এবং সোমবার তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করে আসামীদের আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। তবে, সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে তিনি তথ্য সরবরাহ করতে অপারকতা প্রকাশ করেছেন।