অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান এই কবিতা যখন লিখেছিলেন, তখন দেশে স্বৈরাচার ছিলো, আর এখন দেশে স্বৈরাচার নয়; পাপাচার চলছে। পাপাচারের রাজত্ব তৈরি হয়েছে। যে কারণে সারাবিশ্ব যখন করোনায় আশাহত; তখন নিয়ম করে বার খোলা খোলা হচ্ছে, নিয়ম করে ক্যাসিনো খোলা হচ্ছে, অভিজাতদের বারবি কিউও চলছে। বন্ধ কেবল মধ্যবিত্তশ্রেণির রুটি-রুজি-জীবন সংগ্রাম। শুধু এখানেই শেষ নয়; অর্থনৈতিক বড় ঝড় আকাশে যখন জমছে, তখন পাবনা সদর উপজেলার মালঞ্চি ইউনিয়নের গোবিন্দপুরে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতার নাম রুহুল আমিন খান হৃদয় (২২)। তিনি মুলাডুলি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। গোবিন্দপুর গ্রামে তার নানাবাড়িতে অবস্থানকালে একদল দুর্বৃত্ত তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের দুর্বৃত্তরা এ হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা।
মদবাজী-সন্ত্রাসী-চান্দাবাজী যখন স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলছে, চলছে খুন-ধর্ষণ-নির্যাতন; তখন সরকারি ছুটির কষাঘাতে জর্জরিত সাধারণ মানুষের জীবন। এক করোনাকে ঠেকানোর নামে মনের পর মন চাল লোপাটের রাজনীতি চলছে; চলছে দুর্নীতির রাজনীতি আর প্রশাসননীতি। সাধারণ মানুষরা তখন বন্দী দশায় ঘরে। বাইরে রুটি-রুজির যন্য যেতে তারা না পারলেও যাদের দ্বারা করোনা ছড়ানোর সম্ভাবনা খুব বেশি, সেই প্রবাসে আসা-যাওয়াকারী রাজনীতিক-ব্যবসায়ীরা ঠিকই সকাল-দুপুর রোড কাঁপিয়ে দামি গাড়ি নিয়ে বেরুচ্ছেন। আমার এক বন্ধু কলাম লেখেন, তিনি খুব ‘করোনা করোনা’ করে চিল্লাচ্ছেন, আছেন হোম কোয়ারান্টাইনে। কিন্তু তিনিই ভাবতে পারেন নি যে, যারা করোনার সংক্রমিত বাংলাদেশে, তারা অধিকাংশই প্রবাসী। অর্থাৎ ৪ ভাগের ৩ ভাগই প্রবাসী- বিদেশ ফেরত। বাকিরা বৃদ্ধ এবং প্রবাসী স্বজন-প্রিয়জন-চিকিৎসক।
করোনাভাইরাসে সরকারি বন্ধের প্রভাবে মধ্যবিত্ত অসহায় হয়ে ঘরে বসে কাঁদছেন। তাদের না আছে কারো কাছে চাইবার সুযোগ, না আছে সরকারী অনুদান পাওয়ার সুযোগ। মধ্যিখানে নিদারুণ জীবনযাপন চলছে। এমন অবস্থায় ছুটি আরো দীর্ঘায়িত হলে তারা বেশি বিপদে পড়বেন। তার চেয়েও দুঃখজনক বিষয় হলো- মধ্যবিত্তদের পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে। আমি মনে করি- করোনার মোকাবেলায় নিম্নবিত্তরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা পেলেও মধ্যবিত্তদের বড় একটি অংশই অসহায়। স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ থাকায় তাদের আয়-রোজগার নেই। ফলে একদিকে খাবার কিনতেও পারছেন না, অপরদিকে সামাজিক মর্যাদার কারণে কারও কাছে চাইতেও পারছেন না। নীরবেই কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। ৫টি মৌলিক চাহিদার ৪টি নিয়ে চিন্তিত তারা। বিশেষ করে খাবার ও বাসা ভাড়া নিয়ে তারা খুবই দুশ্চিন্তায়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বর্তমানে মধ্যবিত্ত যে পর্যায়ে আছে, তা হয়তো সহনীয়। কিন্তু অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে এরাই সবচেয়ে বিপদে পড়বেন। তাদের মতে, দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য আছে। তবে বণ্টন ব্যবস্থা খুবই খারাপ। আর মধ্যবিত্তদের কোনো পরিসংখ্যানও সরকারের কাছে নেই। ফলে এদের কাছে খাবার পৌঁছানো খুব কঠিন। বরাবরের মত আমার কাছে এখন মনে হচ্ছে যে, এটি খুব স্বাভাবিক ঘটনা যে মধ্যবিত্তরা বিপদে পড়েছে। এক্ষেত্রে তাদের চিহ্নিত করার জন্য সরকারের সে ধরনের পরিসংখ্যানও নেই। তিনি বলেন, এই শ্রেণির মানুষকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ৫ টাকায় চাল বিতরণের ব্যবস্থা করলে ভালো হতো, তারও বা সুযোগ কই, দেখা গেলো টিসিবির কর্মকর্তারা সেই চাল লুট করে ঘরে ঘরে মজুদ করে রাখবে। এক্ষেত্রে তারা যদিত একবারের জন্যও ভাবতো- বাংলাদেশটা, অর্থাৎ এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আমাদের ঘর, আর এই ঘরের বাসিন্দা সকল মানুষ; সেক্ষেত্রে তাদের দুর্নীতি থামতো। কেননা, ঘরের সদস্যদের কারো কোন বিপদ হলে, সবাই তার পাশে থাকে। সেভাবে বাংলাদেশকে ভালোবেসে, সকল মানুষকে ভালোবেসে সবাই যদি ‘বাংলাদেশ পরিবার’ ভেবে এগিয়ে যেতো, তাহলে খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হতো। ধর্মীয় অনুশাসন মানলেও আমার বিশ্বাস সকল সমস্যা সমাধানে পথ তৈরি হতো। আমি বিনীত অনুরোধ জানাবো- ‘বাংলাদেশ পরিবার’ এই চিন্তায় সবাই এগিয়ে চলুন নিরন্তর...
যদিও বলা হচ্ছে- দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য আছে। কিন্তু আমাদের বণ্টন ব্যবস্থায় যথেষ্ট সমস্যা। দুর্নীতিগ্রস্থ দেশে এটি কাটানোও সম্ভব নয়। যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যে, তারাই মধ্যবিত্ত। এ হিসাবে তাদের মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে। তবে আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সামাজিক মর্যাদা, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধাকেও মানদন্ডে আনতে হবে। ওই বিবেচনায় বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৪ কোটির মতো। তবে উল্লেখযোগ্য অংশই নিম্নমধ্যবিত্ত। এরা ছোট বেসরকারি চাকরি, ছোট ব্যবসা এবং দৈনন্দিন কাজের ওপর নির্ভরশীল। করোনার কারণে দেশ লকডাউন হওয়ায় বর্তমানে এদের বড় অংশের আয়-রোজগার বন্ধ। এতে খাবার ও বাসা ভাড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা। কিন্তু সামাজিক সম্মানের কারণে কারও কাছে টাকা-পয়সা বা খাবার চাইতে পারে না। নীরবে দিন পার করতে হচ্ছে তাদেরকে। এমন অনেকেই আছেন, যারা প্রতিদিন আয় করতেন প্রায় ৮ শ থেকে ১০০০ হাজার টাকা। মাসে বাসা ভাড়া দেন ১১ হাজার টাকা। এরপর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালোই চলে যাচ্ছিল দিন। কিন্তু লকডাউনের গত ২৪ মার্চ থেকে তার কাজকর্ম বন্ধ। ফলে তাদের আয় নেই। তারা সবচেয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন এ মাসের বাসা ভাড়া নিয়ে। এভাবে ঢাকা শহরেও লাখ লাখ মধ্যবিত্ত অসহায়। চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা। সরকার প্রধানের সেদিকে খবর নেই, খবর নেই গণপূর্ত মন্ত্রীর, খবর নেই বাণিজ্য বা খাদ্যমন্ত্রীরও। মেয়রদের অধিকাংশই স্ব স্ব শরীর আর সম্পদ নিয়ে আছেন নিরাপদ দূরত্বে। তবে বরাবরের মত অবিরত তারা পার্সেন্টিস-এর সময় ভাগ বসাচ্ছেন লোক পাঠিয়ে। এমন একটা দেশে জন্মেছি, যে দেশে মাত্র সত্তর বছর আগেও মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য জীবন দিয়েছিলেন এদেশেরই মানুষ, মাত্র ৪৯ বছর আগে ঘরের কথা না ভেবে বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানের কথা না ভেবে ভয়াবহ যুদ্ধে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন ত্রিশ লক্ষ মানুষ; সে দেশে আজ যখন করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর ছড়ালো লোভি-স্বার্থপরের মত অবিরত ঘরে গিয়ে বেেস সবচেয়ে মজার রেসিপিটি বউকে দিয়ে বললো- রাধো।
যাদের সামর্থ আছে, তারা বলছে হোম স্টে করো। যাদের সামর্থ নেই, তারা বলছে- সুযোগ দাও কাজ করার। গার্মেন্টশ শ্রমিকরা কাজে নেমেছে, ছাত্ররা ঘরে আটকে গেছে। মধ্যিখানে আতেলদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমি চিনলেও, গণমাধ্যমের ভাষায়- গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিপোর্টে বলা হয়েছে- দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ রয়েছে। বর্তমানে দেশে খাদ্য মজুদের পরিমাণ প্রায় ১৮ লাখ টন। গত বছরের চেয়ে যা দেড় লাখ টন বেশি। এ অবস্থায় সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে খাবার পৌঁছাতে পারলে খাদ্যের সংকট হওয়ার কথা নয়।
যদি এত বড় লেকচার মারতে পারেন, জনগনের পাশে দাঁড়াতে পারেন না? কেন পারেন না? নিজেদের পেট অভূক্ত থাকবে এই ভয়ে? আমার বিশ্বাস যে, করোনায় এই ছুটি বন্ধ না করলে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ধ্বসে পড়বে বাংলাদেশ। যা উত্তরণের কোনরকম সাহস বা শক্তি আমাদের নেই। তাই চাই, অনবিলম্বে বলে দেয়া হোক কাজ স্বাভাবিক চলবে, তবে- বাইরে বেরুবার সময় মাস্ক বাধ্যতামূলক ব্যবহার করতে হবে, পাশাপাশি শ্রমিক মেহনতি মানুষের জন্য পরিবহন ও বাড়ি ভাড়া কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি সকল দ্রব্যমূল্য কমাতে টিসিবিকে ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। অবশ্য সেই সাথে এই সিদ্ধান্তও নিতে হবে- এয়ারপোর্ট ততদিন বন্ধ থাকবে, যতদিন বিশ্বব্যাপী এই মহামারি নির্মূল না হবে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি