করোনা ভাইরাসের কারণে ঘরবন্ধী মানুষের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে সরকার। সরকারের ত্রাণ কিংবা যেকোন সহায়তা বাস্তবায়ন করতে হলে তালিকা প্রস্তুত থেকে শুরু করে বিতরণ কার্যক্রমে বড় ভূমিকা পালন করেন সরকারের তৃণমুলের প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা।
করোনার আতঙ্কের প্রেক্ষাপটে সরকার উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে চাল বিতরণে অনিয়ম কিংবা চাল চুরির খবর বেরিয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যানদের এই অনিয়ম মুহুর্তের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। ত্রাণের চাল নিয়ে চালবাজির এই ধারাবাহিকতায় বরিশালের একজন ইউপি চেয়ারম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত, একজনের বিরুদ্ধে মামলা ও দুইজন আওয়ামী লীগ নেতাকে কারাদন্ডও দেয়া হয়েছে।
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ইউপি চেয়ারম্যান মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার আন্দারমানিক ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান কাজী শহিদুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি জেলেদের চাল আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়াও গত বুধবার জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার স্টীমারঘাট এলাকার একটি গোডাউন থেকে সরকারী চাল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় কেদারপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরে আলম বেপারীর বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
ইউপি চেয়ারম্যান নুরে আলম বেপারী জানান, কেদারপুর ইউনিয়নের ১, ২, ৩, ৪ ও ৫ নং ওয়ার্ড থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন। ফলে ওইসব ওয়ার্ডের সুবিধাভোগীদের জন্য সরকারী বরাদ্দকৃত চাল সুবিধাভোগীদের মাঝে বিতরণের জন্য অতীতের চেয়ারম্যানদের ন্যায় তিনিও জেলেদের সুবিধার্থে স্টীমারঘাট বাজারে ভাড়া করা গোডাউনে রেখে বিতরণ করে আসছিলেন। চাল আত্মসাতের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি আরও জানান, সামনে নির্বাচন তাই একটি প্রভাবশালী মহল তাকে (নুরে আলম) হেয় করার জন্য ষড়যন্ত্র করে আসছে। যা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সঠিকভাবে তদন্ত করলেই প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে।
জেলার গৌরনদী উপজেলার একাধিক ইউপি চেয়ারম্যানরা জানান, তাদের কাছ থেকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল উত্তোলনের ডিওতে স্বাক্ষর নেয়া হলেও তারা চাল হাতে পাচ্ছেন না। উপজেলা প্রশাসন থেকে তাদের পরিষদের নামে বরাদ্দকৃত চাল বিতরণ করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কোন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তাদের কাছে চাল বিতরনের মাষ্টাররোল চাইলে তারা কিছুই দেখাতে পারবেন না।
জেলার একাধিক ইউপি চেয়ারম্যানরা জানান, সরকারীভাবে বরাদ্দকৃত চাল বিতরণের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে সরকারী কর্মকর্তা ট্যাগ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত থাকেন। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের সচিবও সার্বক্ষনিক পরিষদের কাজগুলো মনিটরিং করেন। সেক্ষেত্রে চাল বিতরণে অনিয়ম কিংবা আত্মসাতের ঘটনা ঘটলে সচিব ও সংশ্লিষ্ট ট্যাগ অফিসারেরও দায়বদ্ধতা থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় শুধু ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের চাল চোর হিসেবে টার্গেট করা হচ্ছে।
তারা আরও জানান, অনেক সময় বরাদ্দের চেয়ে সুবিধাভোগী বেশি থাকেন। সেক্ষেত্রে তারা সমন্বয়ের মাধ্যমে চাল বন্টন করে থাকেন। যা কখনোই ফলাও হয়না। এ ছাড়া জনগনের সুবিধার্থে ইউনিয়নের যেকোনস্থানে বসে চাল বিতরণ করার নিয়ম রয়েছে। তারা আরও জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে চাল উদ্ধারের ঘটনাগুলোতে ঢালাওভাবে জনপ্রতিনিধিদের যেহারে চাল চোর হিসেবে সনাক্ত করা হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে ত্রাণ বিতরণে নিরুৎসাহিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন জনপ্রতিনিধিরা।
সূত্রমতে, বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি একেএম ইউসুফ আলীর গোডাউন থেকে ২৫৬ বস্তা সরকারি ‘কাজের বিনিময় খাদ্য কর্মসূচি’ (কাবিখার) চাল উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে আটককৃত ইউসুফ আলীকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করে কারাগারে পাঠানো হয়। বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিষ্ট্রেট শেখ আব্দুল্লাহ সাদীদ জানান, সরকারী বরাদ্দের চাল ক্রয় বিক্রয় আইনত দন্ডনীয় অপরাধ হওয়ায় ইউসুফ আলীকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউসুফ আলী ওই চাল ক্রয় করার অপরাধা দন্ডিত হলেও বিক্রেতা রয়ে গেছেন ধরাছোয়ার বাহিরে। এ ছাড়া কাজের বিনিময় খাদ্য কর্মসূচির আওতায় যেসব শ্রমিক কাজ করেন তারা কেহই চাল গ্রহণ করেন না। তাই ওই চালের ডিও বিক্রি করার পর শ্রমিকদের মধ্যে টাকা বিতরণ করা হয়। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জেনেও এখন না জানার ভান করছেন।
সরকারী চাল বিতরণ ॥ রোববার দুপুরে বাবুগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের আগরপুর বাজারে গিয়ে দেখা গেছে সরকারের ১০টাকা কেজি দরের চাল নেয়ার জন্য সুবিধাভোগী কার্ডধারীদের দীর্ঘলাইন। করোনা প্রতিরোধে সামাজিকদূরত্ব বজায় রেখে সুবিধাভোগী কার্ডধারীরা লাইনে দাঁড়িয়ে ১০ টাকা কেজি দরের চাল সংগ্রহ করছেন। এখানে ট্যাগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সহাদেব মুখার্জী। স্থানীয় ডিলার মোঃ হেলাল উদ্দিন জানান, ৬০১ জন সুবিধাভোগীর জন্য ৩০ কেজি করে মোট ১৮ টন ৩০ কেজি চাল তাকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গত ১৩ এপ্রিল থেকে তিনি চাল বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে ৫৮৩জন সুবিধাভোগী তাদের চাল নিয়েছেন।