দেশে বজ্রপাত এবং এতে মৃত্যুর হার দুটোই বেড়েছে। বিশে^র অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বেশি বজ্রপাতপ্রবণ। এখন আমাদের দেশে এটি বন্যার চেয়ে একটি বড় দুর্যোগ। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বন্যায় যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল দুই শতাধিক, সেখানে এই সময়ে দেশে বজ্রপাতে মোট নিহতের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। কিন্তু সে তুলনায় বজ্রপাত বিষয়ে আমাদের সচেতনতা কম। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫ সালে ২৭৪, ২০১৬ সালে ৩৮৭, ২০১৭ সালে ৩৭২ এবং ২০১৮ সালে ৪৪৯ জন মানুষ বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন। এতে বোঝা যায়, প্রতি বছরই এই দুর্যোগে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে যা উদ্বেগজনক। গত সোমবার দেশের চার জেলায় বজ্রপাতে সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর আগে রোববার কেবল সুনামগঞ্জেই বজ্রপাতে নিহত হয়েছিলেন চার যুবক। আর এর আগের দিন দেশের চার জেলায় নিহত হন ১১ জন। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় বজ্রপাতে এই সকল মানুষ মারা যান। সাধারণত দেশে বজ্রপাতের ঘটনা এপ্রিল-মে মাসে বেশি ঘটে থাকে। তাই এই সময় আমাদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
গত কয়েক দিনের বজ্রপাতের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিন পেশার মানুষের নিহতের হার বেশি। তারা হলেন- কৃষক, রাখাল ও ব্যবসায়ী। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের মহামারির কারণে বেশিরভাগ মানুষই আছেন হোম কোয়ারেন্টাইনে। কিন্তু এই তিন পেশার মানুষকে কাজের প্রকৃতিগত কারণে বাইরে থাকতে হয় বলে তারা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশেষত কৃষকদের কথা আলাদাভাবে বলতেই হবে। ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাঠে-ঘাটে কাজ করায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাহরাই বজ্রপাতের সহজ শিকার হয়ে থাকেন। গত দুই দিনে যে কৃষকরা প্রাণ হারিয়েছেন তারা ধানক্ষেতে নিড়ানি বা অন্য কাজ করছিলেন অথবা ধান কাটায় ব্যস্ত ছিলেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধি, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, বাড়ির দুর্বল অবকাঠামো প্রভৃতি কারণে বজ্রপাতের দুর্ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এটিতে মৃত্যুর হার বেশি। গ্রামগঞ্জে আজকাল তাল, নারিকেল, সুপারি, বটের মতো বড় বড় গাছের অভাব, বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা না থাকা, কৃষিতে ধাতব যন্ত্রপাতি ও আধুনিককালে মুঠোফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণেও বাড়ছে বজ্রপাতের হার। বিজ্ঞানীদের মতে, বর্ষার আগে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেলে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা আর্দ্র বায়ুর সঙ্গে উত্তরে হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে সৃষ্টি হয় বজ্রমেঘ, বজ্রঝড় ও বজ্রপাত। আর এসময় আমাদের অসচেতনতায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির অধ্যাপক ড. টমাস ডব্লিউ স্মিডলিনের ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যান্ড সোশ্যাল ভালনারেবেলিটি’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিশ্বে মোট বজ্রপাতের এক-চতুর্থাংশই ঘটে বাংলাদেশে। সুতরাং আমাদের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বজ্রপাতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। এই ব্যাপারে গবেষণা ও জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সাফল্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। তার পরও বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে আমরা কৃষিজমির ফাঁকে ফাঁকে তালগাছ ও খেজুরগাছ রোপণ, কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে বজ্রপাতের সতর্কবার্তা ঘনঘন প্রচার এবং বজ্রপাতনিরোধক যন্ত্র তথা আর্থিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। বজ্রপাতে প্রাণহানি রোধে সবাইকে, বিশেষ করে মাঠে কাজ করা কৃষক-শ্রমিকদের বজ্রপাতের সময় করণীয় সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝাতে হবে।