দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) কর্মরত কর্মচারীদের জীবনযাপনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস গত ১৬ মার্চ থেকে বন্ধ হলেও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে ২০ মার্চ। ফলে মার্চ মাসে মাস্টাররোলের এসব কর্মচারীরা সাপ্তাহিক ছুটি বাদে মাত্র ১৬ দিনের বেতন পেয়েছেন।
চলতি এপ্রিল মাসে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কোন সম্ভাবনা না থাকায় ওইসব কর্মচারীরা এখন অর্থ সংকটে পরিবার-পরিজন নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় পরেছেন। একদিকে রমজান শুরু হয়েছে। সামনে ঈদ। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় না খুললে এসব কর্মচারীদের জীবনযাপনে চরম দুর্দশা নেমে আসার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রত্যেক কর্মচারীরা।
তারা বলেছেন, বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার কারণে তারা কারও কাছে হাতও পাততে পারছেন না। আবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও কোন সহায়তা পাওয়ার আশ্বাস মেলেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ববিতে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কর্মরত কর্মচরীর সংখ্যা ৭১ জন। এরমধ্যে ১০ জন নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করেন। এই ১০ জন ছুটিতেও কাজ করছেন। তাই তারা নিয়মিত মজুরিও পাবেন। আর কাজ না থাকায় মজুরি পাবেন না বাকি ৬১ জন কর্মচারী। ববি’র দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কর্মরত কর্মচারীদের নিয়োগ পাওয়ার প্রধান শর্তই হচ্ছে কাজ নেই তো বেতনও নেই। সাপ্তাহিক এবং সরকারি ছুটির দিনেও তারা বেতন পান না।
সূত্রে আরও জানা গেছে, করোনার প্রাদুর্ভাব রুখতে প্রায় এক মাস যাবৎ বন্ধ প্রতিষ্ঠানটি। কবে খুলবে সে ব্যাপারেও নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না কেউ। তাই দীর্ঘদিনের জন্য সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েছে এসব কর্মচারীরা। জমানো টাকায় বেশ কয়েকদিন চলার পর ঘরে যখন চাল শূন্য হয়ে পরেছে তখন সহায়তার আশায় কয়েকজনে গিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে। কিন্তু আইনি বাধ্য বাধকতায় তাদের জন্য কিছু করা সম্ভব নয় বলে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই পরিবার পরিজন নিয়ে আধপেটা খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করেই বেঁচে থাকার কঠিন পথ পাড়ি দিচ্ছেন ওইসব কর্মচারীররা।
সামাজিক সম্মানহানির ভয়ে তারা পারছেন না আশেপাশের কারও কাছে কিছু চাইতে। এমনকি সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য তথ্য চাইলে সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের নাম গোপন রাখারও অনুরোধ করেছেন তারা। কারণ খবরে নাম প্রকাশ পেলে নাকি চাকরি চলে যাবার সম্ভাবনা আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের ল্যাব সহকারী বলেন, অস্থায়ী ভিত্তিতে তিনি সেখানে চার বছর যাবৎ কর্মরত রয়েছেন। বিয়ে করার পর এটাই তার প্রথম ঈদ। স্বপ্ন ছিল এবারের ঈদে নিজের বাবা-মাসহ শ্বশুর বাড়ির সবাইকে নতুন কাপর কিনে দেয়ার। কিন্তু এখন সে স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। করোনা সংকটে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন উপার্জনহীন হয়ে পরেছেন। এমন অবস্থায় ঈদতো দূরে থাক পরিবারের দৈনন্দিন জরুরী খাদ্য সামগ্রী সংকটে পরেছেন।
তিনি বলেন, প্রায় এক মাস যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। কবে নাগাদ খুলবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। জমানো অল্প কিছু টাকায় এতোদিন কষ্টে চলেছি। তাও শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, কারো কাছে লজ্জায় সহায়তা চাইতে পারছি না। লজ্জা শরম ফেলে যদি কারও কাছে চেয়েও বসি সেখান থেকে শুনতে হচ্ছে চাকরির খোঁটা। কারণ সকলের বিশ্বাস বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার সুবাদে আমি খুব ভালো আছি। এ ছাড়া সবার ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার সুবাদে সেখান থেকেই আমি সহায়তা পাব। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন সহায়তার আশ্বাস মেলেনি।
একই কথার পুনরাবৃত্তি করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শাখায় কর্মরত অপর এক কর্মচারী বলেন, পাঁচ বছর যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি করছি। স্থায়ী হবো এই আশায় অপেক্ষা করতে করতে অন্য কোথাও প্রবেশের বয়স শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এই বিপদের দিনে ঘরে যখন খাবারের মতো কিছু নেই, তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও আমাদের জন্য কিছুই করলো না। তিনি আরও বলেন, গত ১৫ এপ্রিল কয়েকজনে মিলে বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মরতদের জন্য সাহায্য চাইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানকার দায়িত্বরতরা আমাদের কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করেননি। দৈনিক মজুরি ভিত্তিক অস্থায়ী কর্মচারীরা বলেন, তাদের সবার ঘরেই ইতোমধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সামনের দিনগুলো তারা কিভাবে চলবেন তা নিয়ে সবাই দিশেহারা হয়ে পরেছেন।
এ ব্যাপারে ববি’র দায়িত্বপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মুহসিন উদ্দিন বলেন, দৈনিক মজুরির কর্মচারীদের নিয়ে উপাচার্যসহ শিক্ষক নেতাদের সাথে কথা হয়েছে। এসব কর্মচারীদের বাড়তি কোন আর্থিক সুবিধা দিতে হলে অর্থ কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু এখন অর্থ কমিটির বৈঠক করা কিংবা এসব কর্মচারীদের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে তা ছাড় করানো কঠিন। সে কারণেই এসব কর্মচারীদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। তবে মানবিক বিবেচনায় উপাচার্য মহোদয়সহ শিক্ষক এবং কর্মকর্তারা দৈনিক মজুরির কর্মচারীদের জন্য কিছু একটা করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, সরকারি ব্রজমোহন কলেজসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কর্মরত কর্মচারীদের সবার ভাগ্যেই এখন একই প্রকারের। তারা না পাছেন আয় করতে। আর না পারছেন সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতে।