মানব জাঁতি মানব সভ্যতার ধারাবাহিক ইতিহাসের ধারায় এমন কিছু দুঃখজনক ,বেদনাদায়ক, হৃদয় গ্রাহী ঘটনা সংযোজিত হয়েছে যা অধ্যয়ন করলে মন শুধু ব্যথিত ও মর্মহত হয়। আর এসব ঘটনা সংঘটনের নায়কদের উদ্দোশ্যে মন থেকে বেরিয়ে আসে নানা ধিক্কারজনক উক্তি। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় এমন কিছু মহাসন্তানের জীবন এই পূথিবীতে অকালে ঝরে গেছে, যাদের এই অপমৃত্য বিবেকই কোন্ অবস্থাতেই মেনে নিতে পারে না। মানব জাঁতি ও মনব সভ্যতার চিরকল্যানকামী এ রকম এক মহাসন্তানের নাম সক্রেটিস। এ বিশ্বে ও মহাবিশ্বে অনবরত সংঘটনরত নানা ঘটনা বলীর সাথে রয়েছে পরস্পরের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা কার্যকরন সম্পর্ক। এসব ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জগতের কিছু মানুষ তার জীবন, যৌবন, ধনমান, প্রান সবই দান করেছেন। যার পরিনামে কারো ভাগ্যে ঘটেছে বিপুল সন্মান আর কারো কপালে ঘটেছে স্বহস্তে বিষপান। সেই মহাসন্তান সক্রোটিসের ভাগ্যে ঘটেছিল এরকম চরম দুঃখজনক ঘটনা, যার জন্য বিশ্ব সভ্যতা আজও বিলাপ করে। তার জীবনের সেই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় লিখা আছে। যে দিনটিতে তিনি স্বহস্তে বিষ পান করে মৃত্যদন্ড পেয়েছিলেন সে দিনটিও ইতিহাসে স্মরনীয় হয়ে আছে।এথেন্সের বিচারকদের দ্বারা সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হওয়ার এক মাস পর তার জীবনের সেই অন্তিম দিনটিও ঘনিয়ে আসে তার এ দিনটিও ছিল স্বহস্তে বিষপান করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর ছিল এক বর্ণাঢ প্রস্ততির দিন। সক্রেটিসের শীষ্য ছিলেন প্লেটো। তার বিচারের সময় প্লোটো আদালতে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন। এ রকমই তিনি মোকদ্দমায় সমস্ত ঘটনার স্বাক্ষী কিন্তু সক্রেটিসের বিষ পানের দিন তিনি কারাগারে উপস্থিত ছিলেন না। তার কারণ তিনি তার পরম শ্রদ্ধাসম্পদ গুরুর বিচ্ছেদ বেদন সইতে পারবেন না বলে।’ফীডো'তে মৃত্যুদিনের সমস্ত দৃশ্যের কথা তার এক প্রিয় শিষ্য ফীডোর মতোই অমর হয়ে আছে। সক্রেটিসের বিষ পানের দিন ফীডো ও তার কয়েকজন সাথী, এথেন্স বাসী অ্যাভোলোডোরাস, কীটো, প্রমূখ এবং এথেন্সের বাইরে, থীবিস, মেগারা, ইত্যাদি স্থান থেকে সক্রেটিসের কিছু ভক্ত ও প্রশংসক খুব সকাল সকাল বন্দীগৃহে পৌঁছে গিয়েছিল। তারা সেখানে সক্রেটিসের স্ত্রীকে বাচ্চা কোলে নিয়ে কাঁদতে দেখেন। তাদের দেখে তিনি আরো জোরে কাঁদতে থাকেন। তখন কোন রকমে সক্রেটিস তাকে বাড়ী পাঠিয়ে দেন। এই রকমই সক্রেটিসের পতœী জেনথিপির ন্যায় উপস্থিত সকলেই ভারাক্রান্ত ছিলেন, একমাত্র সক্রেটিস ব্যতিত। তার চেহারা দেখে মনেই হচ্ছিল না যে, আজ তিনি মৃত্যুবরন করতে যাচ্চেন। মৃত্যুর প্রতি সক্রেটিসের এই ভয়লেশহীন উপস্থিত সকলকে রোমান্সিত করে তুলেছিল। তার প্রিয় শিষ্য ফিডো লিখেছেন, সে সময়ে তাকে অত্যন্ত নিভীক মনে হচ্ছিল, তার স্বভাবিক আচরণ ও বাণী আমাদের এতটা সত্য ও অভিজাত মনে হচ্চিল যে, তা দেখে আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, পরোলোকে পৌঁছে তিনি অবশ্যই প্রসন্ন হবে না। সক্রেটিস তার জীবনের অন্তিম দিনে এমন অবস্থাতেও নিজের শিষ্যদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে যেমন-আত্মার অবস্থান, ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করলেন। অন্তিমক্ষণের কাব্য চর্চাঃ কবি ইউলিস থেকে চর্চা শুরুহল। কেউ জানতে চাইল যে, ইউলিস জিঙ্গাসা করেছিল, সক্রেটিস তো সারা জীবনব্যপি এক পংক্তি কবিতাও লেখেননি। কিন্তু এখন অন্তিম সময়ে বন্দিগৃহে কিভাবে কবিতা লিখছেন ? একথার জবাবে সক্রেটিস জবাব দিলেন, ইউলি কে বলে দাও যে, অমি তার সাথে প্রতিযোগীতা করার জন্য ছন্দ রচনা করছিনা। আমি আমার এক পুরানো স্বপ্নাদেশ পালন করচ্ছি মাত্র। সাথে সাথে তিনি ইউলিসকে এই বলে সংবাদ পাঠালেন যে, তিনিও যেন মৃত্যুপথযাএীকে অনুসারন করার জন্য প্রস্তুত থাকেন। একথা শুনে কেউ একজন তাকে বললেন আপনি তো বড় অদ্ভুত কথা বললেন। আপনি তাকে কেন মৃত্যুপপথযাএীকে অনুসরনের জন্য পরামার্শ দিচ্ছেন ? তখন সক্রেটিস বললেন হাঁ জ্ঞানী ব্যক্তিদের জন্য এটাই পরামর্শ। এটাই জীবনের শেষ ঠিকানা। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, আত্মহত্যার মাধ্যমে তাকে এই পথের পথিক হতে হবে। অর্থাৎ সক্রেটিসের এ কথার উদ্দেশ্য ছিল যে, মৃত্যুর দরজায় এসে কড়া নাড়লে তাকে সসন্মানে অভ্যর্থণা জানাও। যেনতেন প্রকারে জীবন বাঁচানের প্রচেষ্টা মানুুষের এক বিরাট মূর্খতা। সে সাথে সক্রেটিস তার শিষ্য ও শুভানুধ্যয়ীাদের নানা প্রশ্নের জাবাব দিয়ে যেতে লাগলেন এবং নানা আলাপ আলোচনাও করতে লাগলেন। একবার জেল থেকে এক কর্মচারী এসে তাকে তাকে বলল, বেশী কথা বলবেন না, তাহলে মন শরীর মন গরম হয়ে যাবে এবং লোকেরাও উত্তেজিত হয়ে উঠবে। এ কথার জবাবে প্রয়োজনে দু’তিন দফাও বিষ নেয়া হবে- বলে সক্রেটিস পুনরায় কথাবার্তা শুরু করলেন। অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে তিনি তার আত্মার অমরত্ব সম্পের্কে প্রশ্নের সামাধান দিয়ে যেতে লাগলেন। সেই সাথে প্রশ্নকর্তাদের মনে এ বিশ্বাসও জাগিয়ে তুললেন যে, মৃত্যুর পর শরীর মাটিতে মিশে গেলেও আত্মার মৃত্যু নেই, তা মাটিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় না। মৃত্যুর পর প্রত্যেক আত্মার দেবদূতদের দ্বারা পরলোকে নীত হয়। সেখানে পূথিবতে কৃত তার র্কীতকর্মানুযায়ী তার ফয়সালা শুনিয়ে দেয়া হয়। কালান্তরে তাকে আবার মানবদেহ ধারন করতে হতে পারে। যিনি পুন্যত্ব হন তিনি জন্ম মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তি লাভ করেন।
সত্য পথে চলোঃ
অবশেষে সক্রেটিস যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন ফ্রীডো তাকে জিঞ্জেসা করলেন, আপনি কি আমাদের পরিবার-পরিজনদের ব্যপারে কোন উপদেশ দেবেন? এবং অনুগ্রহ করে আরো বলুন, আমরা আপনার পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় কোন সেবাটা কিভাবে করতে পরি ? এ কথা শুনে সত্যপথের চিরপথিক সক্রেটিস তার চরিত্রধর্মানুযায়ী স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, নিজে নিজের প্রতি খেয়াল রাখ।আমার এবং পরিবারে শ্রেষ্ঠ সেবাটা তোমরা তখনই করতে পারবে, যখন তোমরা আমার কথামতো সঠিক পথে চলতে থাকবে।সক্রেটিসের এই করুন পরিনিতিতে সকলেই খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। ক্রুটো সক্রেটিসের বিশেষ বন্ধু ছিলেন এবং তার উপর সক্রেটিসের দাফন করার দায়িত্ব ছিল। তিনি সবচেয়ে বেশী বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন।এ কারণে সক্রেটিস সকলের কাছ থেকে প্রতিশ্রতি নিলেন এই মর্মে যে, আমার মৃত্যুতে ক্রিটো যেন বেশী উত্তেজিত ও বিচলিত না হয়। আমার শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ ও অন্তিম সৎকার পর্যন্ত সে যেন শান্ত থাকে। তাকে শান্ত রাখার দায়িত্ব আমনাদেরকে দিয়ে গেলাম।
বিষপানের প্রস্তুতিঃ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সক্রেটিস স্নান সমাপন করে বেরিয়ে এলেন।ইতিমধ্যে তার পরিবারও বেরিয়ে এলেন। তিনি তাকে তার অন্তিম আর্দেশ দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। এ সময় জেল দারগা এসে গেলেন এই সংবাদ জানিয়ে দেয়ার জন্য যে, তার জন্য বিষের পেয়ালা প্রস্তুত। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে সবার থেকে পৃথক হয়ে যেতে হবে। জেল দারগা হিসেবে এ ছিল তার দায়িত্ব, কারণ এটায় তার চাকুরী।কিন্ত এ খবর শুনাতে শুনাতে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। সক্রেটিস তা দেখে তার সহৃদয়তার প্রশাংসা করলেন। জেল দারগা প্র¯হানের পর তিনি পুনরায় তার সহৃদয়তার প্রশাংসা করে বিষের পেয়ালা নিয়ে আসার জন্য আর্দেশ দিলেন। কিন্তু সূর্য্যাস্থের তখনও কিছুটা বাকী ছিল। ক্রিটো বললেন, সূর্য এখনও পাহাড়ের উপরে। আরো অনেক কয়েদি তার অপেক্ষায় বিষ পান থেকে বিরত রয়েছে। তারা এসময়ে খওয়া দাওয়া ও জীবনের নানা ইচ্ছে পূরনে ব্যস্ত রয়েছে। তাড়াতাড়ির প্রয়োজন নেই, এখনও অনেক সময় আছে। এ কথার জবাবে সক্রেটিস বললেন, যাদের ব্যাপারে তুমি এ কথা বললে, তাদের নিজেদের ক্ষেত্রে এ আচরণ সঠিক। কেননা তারা ভাবছে, যতক্ষন বাঁচা যাবে ততটাই সুখ লাভ করা য়াবে। কিন্তু আমি ভাবচ্ছি না যে, এতটা দেরী করলে আমি তাদের অগোচরে থাকব। তাই আমি যা বলছি, তাই করো। আমার কথা প্রত্যাখ্যান করো না। ক্রিটো অত্যন্ত ভারাক্রান্ত চিত্তে তার এক সেবককে ইঙ্গিত করে বিষ আনন্তে বললেন। অল্প কিছুক্ষুনের মধ্যে জেল দারগা এক কর্মচারীর সাথে হেমলোকের পেয়ালা (বিষের নাম ) নিয়ে উপস্থিত হলেন। সক্রেটিস জিঙ্গেসা করলেন, প্রিয় বন্ধু আমার এখন বল কি করতে হবে ? ঐ কর্মচারী জবাব দিল, এটি এখন পান করুন এবং ততক্ষুন পর্যন্ত টহল দিন যতক্ষন না আপনার পদদ্বয় ভারি মনে হবে। তারপর আপনি শুয়ে পড়বেন। বাকি কাজ বিষই সম্পন্ন করে দেবে।
বিষ পানঃ সক্রেটিস অত্যন্ত শান্তভাবে হেমলোকের পেয়ালাটি হাতে উঠিয়ে নিলেন এবং প্রদানকারীর প্রতি কোন রকমের অভিযোগহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন আমি যদি কোন দেবতার নাম নিয়ে এই বিষ পান করি তাহলে কেমন হবে ? আমি কি তা করতে পারি ??জেল দারগা বললেন, সক্রেটিস আমরা ততটাই বিষ তৈরী করি, যতটা প্রয়োজন। বুঝলাম - সক্রেটিস বললেন, কিন্তু আমি আমার দেবতাদের উদ্দেশ্য অবশ্যই প্রার্থনা করব যাতে আমার পরলোক যাত্রা শুভ হয়। এ কথা বলে সক্রেটিস বিষের পেয়ালা মূখে ধরলেন এবং ধীর স্থিরভাবেভাবে পূরো বিষটাই পান করলেন। সে সময়েও তার চেহারায় দুঃখতাপের কোন নাম নিশানা পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়নি। উপস্থিত সকলেই রুদ্ধশ্বাস দৃষ্টিতে এ দৃশ্য অবলোকন করেন। সক্রেটিসের বিষপান শেষ হওয়া মাএই উপস্থিত সকলের চোখ দিয়ে অশ্রধারা বয়ে যেতে লাগল। একমাত্র সক্রেটিসই সেখানে শান্ত হয়ে বসে ছিলেন। সবাই কে এভাবে কাঁদতে দেখে তিনি বললেন বন্ধুগন এ তোমরা কি করছ ? আমি মহিলাদের বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে ছিলাম যেন এসব না হয়। যে কোন ব্যাক্তিকে শাস্তি ভাবে উচিৎ। এখন তোমরা ধর্য ধর, শান্ত হয়। এরপর সক্রেটিস উঠে টহল দিতে লাগলেন। তিনি ততক।ততক্ষন পর্যন্ত টহল দিতে লাগলেন যতক্ষন না পদদ্বয় ভারাক্রান্ত না হয়ে উঠে। তারপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। তখন ঔই বিষ প্রদানকারী কর্মচারী তার মা দুটো চেপে টিপতে টিপতে বলল,,কি কিছু অনুভাব হচেছ ? তা শুনে সক্রেটিস বললেন, না, তারপর তার পায়ের উপরিভাগও টিপলেও এবং উপস্থিত লোকদের দেখালো যে, তা শীতল ও কঠিন হয়ে গেছে। তখন সক্রেটিস নিজেই শরীর ঝাঁকালেন। তারপর বললেন, বিষ আমার হৃৎপিণ্ড়ে পৌঁছেলেই আমি মরে যাব।
শেষ বাক্য ঃকিছুক্ষণ পর সক্রেটিস তার মূখের উপর থেকে কাপড়টি সরিয়ে দিলেন এবং বিড় বিড় করে বললেন, এিুটো আমি ..... স্বাস্থ্যের দেবতা .......... এসক্লেডিয়োমের নামে ....... এক মুরগী .... মানত করে ছিলাম ....... তা ....পুরন ....... করো। ক্রিটো অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আগ্রহ ভরে জিঞ্জেসা করলেন, আর কিছু ওদিক থেকে কোন উত্তর এল না। এটাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকের শেষ বাক্য। প্লে¬টো তার মহান গুরুর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গিয়ে লিখেছন, এই ভাবে আমাদের এক মহান বন্ধুর জীবনাবসান হল, যিনি সমকালের সমস্ত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান, ন্যায়পরায়ণ ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন।
লেখক:
মোঃ হায়দার আলী, প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, ও সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা গোদাগাড়ী উপজেলা শাখা, রাজশাহী