শ্রদ্ধাভাজন ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী কি সত্যি ভুলের পাত্র! তিনি কি ভুল করেছেন বাংলাদেশ নামক দেশটিতে জন্ম নিয়ে? নাকি ভুল করেছেন একাত্তরে লন্ডনে পড়াশোনা স্থগিত রেখে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিতে দেশে ফিরে এসে? তিনি কি ভুলরীতি অনুসরণ করেই বৃদ্ধা বয়সে আবারও কি ভুল করলেন মহামারী করোনাযুদ্ধের অস্ত্র ‘টেস্ট কীট’ আবিষ্কার করে!
জনাব জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভুলের খতিয়ান কি সত্যি নাতিদীর্ঘ? তিনি কি সেই ১৯৭১ সালে দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার বলিদান করে লন্ডনে নিজের পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলে ভুল করা শুরু করেছিলেন? ফলশ্রুতিতে কি ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক’ হিসেবে ভারতের আগরতলায় ট্রেইনিং নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসে জীবনবাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভুল করেছিলেন? নাকি ১৯৭১ সালে জাতির ভয়াবহ সঙ্কট মূহুর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের পরামর্শক্রমে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘ফিল্ড হাসপাতাল’ গড়ে তোলে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভুল করেছিলেন? অথবা সেই থেকেই কি জনাব জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তার ভুলজীবনের যুদ্ধ শুরু করেছিলেন? এভাবেই কি নিজের ৩১ একর জমি দান করে স্বাধীন দেশে ‘গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র’ গড়ে তোলে তিনি ভুল করেছিলেন? নাকি প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তাঁর নামে আগে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ খেতাব না লিখে ভুল করেছেন? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৩০ বছরের টগবগে যুবক আজকের ৭৮ বছরের বৃদ্ধ শেষ জীবনেও মানুষের জন্য লড়ে জনাব জাফরুল্লাহ চৌধুরী সত্যি কি ভুল করেই যাচ্ছেন?
প্রখ্যাত স্বাস্থ্যযোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরী এসব ভুল খতিয়ে দেখতেই আজকের এ নিবন্ধের শুভ সূচনা। চারিদিকে, ‘করোনা! করোনা!! শুধু করোনা!!! ,
বলা যায়, চলমান বিশ্বকে যেনো ওই করোনা আটকে দিয়েছে। ফলে মনে হচ্ছে, ব্যাক গিয়ারে চলছে যেনো এগিয়ে যাওয়ার বিশ্ব! চীনের উহান শহর থেকে উৎপত্তি মরণব্যাধি নোভেল করোনা তথা কোভিড-১৯ নামক ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে পুরো দুনিয়া দিশাহারা। ইতোমধ্যে করোনাঘাতে মানবতার শহরখ্যাত ইতালি বাঁচার আকুতি নিয়ে অঝরে কাঁদছে আকাশপানে, বাণিজ্যিক দেশ চীন বিধ্বস্ত, অসহায় হয়ে পড়ছে ওষুধের শহর সুইজারল্যান্ড, নিরুপায় প্রযুক্তির শহর জার্মানি, টালমাটাল হয়ে পড়ছে ক্ষমতার দাম্ভিকতার আমেরিকা, নিঃসঙ্গ হয়েছে শক্তিধর কানাডা, বাঁচার কোনো পথ পাচ্ছেনা ব্রিটিশের দেশ ইংল্যান্ড, লাশের স্তুবে বেদশায় স্পেন, নিস্তব্ধ হয়েছে অস্ত্রের রাজাখ্যাত রাসিয়া-ফ্রান্স, প্রাসাদ ছেড়ে বাঁচার আকুতি করছে রক্ষণশীল সৌদির বাদশাহি মন্ত্রীসভা, ইরান- ইরাক-পাকিস্তানও কাহিল, পোশাকের বাংলাদেশও সামান্য ধাক্কায় অমানিশায় নিমজ্জিত।
অদৃশ্য করোনাঘাতে ফিকে হয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের বাহাদুরি। ব্যর্থ বিজ্ঞান। স্তমিত সভ্যতার আস্ফালন। পরাজিত ক্ষমতার দম্ভ। রুদ্ধ মুক্তির সকল পথ। সবমিলে দুনিয়ার বসবাসিদের ফুরিয়েছে সকল কারামতি, একমাত্র আকাশে উপরের অধিপতির নিকট প্রার্থনা, আমাদের রক্ষা করো হে জগত মালিক। তুমি সহায় হও আমাদের উপর।
বলা বাহুল্য যে, করোনা জর্জরে যখন বিধ্বস্ত তামাম দৃনিয়া, ঠিক এমন ক্লান্তিকালে করোনাযুদ্ধের অস্ত্র ‘কীট’ আবিষ্কার করা হয়েছে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
সবশেষ খবর অনুযায়ী এখনও গণস্বাস্থ্যের তৈরি কীট নিয়ে সিদ্ধান্ত জানায়নি ওষুধ প্রশাসন। যদিও বলা হয়েছে র্যাপিট টেস্ট কীট বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দেয়নি। জনমনে কৌতূহল তাহলে কী হতে পারে? ওই কীট নিয়ে আশাবাদ সর্বত্র। বিশেষত দেশের বাহির থেকে যখন কীট আমদানি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাপেক্ষ। সেখানে নিজ দেশের আবিষ্কৃত কীট নিয়ে আশার আলো দেখেছেন চিকিৎসা সংশ্লিষ্টসহ সাধারণ মানুষ। করোনা মহামারিতে ব্যাপকহারে পরীক্ষার জন্য কীটের বিকল্প নেই। কিন্তু নিজ দেশের কীট না নিয়ে অধিক মূল্যে ভিন দেশের কীট আনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র। গত ২৫ এপিল গণস্বাস্থ্যের সংবাদ সন্মেলনে সরকারের কোনো প্রতিনিধি অংশ নেননি।
এমন কি ওষুধ প্রশাসন এ নিয়ে নানাবিধ টালবাহানা করছে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অভিযোগ করেছেন, ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করতেই থার্ড পার্টির মাধ্যমে উদ্ভাবিত কীট পরীক্ষার কথা বলছেন সরকারি কর্তৃপক্ষ। যদি ওষুধ প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নিতে গাফিলতি হয়, তাহলে কীট বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কী করবেন?
গণমাধ্যমে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাফ জানিয়েছেন, আমরা সবশেষ অনুরোধ করেছি ওষুধ প্রশাসনকে এটি বিএসএমএমইউ হোক, আইইডিসিআর হোক, আইসিডিডিআর হোক বা সিএমএইচ হোক তাদের মাধ্যমে এই কীটের কার্যকারিতা পরীক্ষা করাতে। কথা হচ্ছে, এর জন্য ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে আমাদের কাছে চিঠি লিখতে হবে। আমরা নিজেরা কাউকে দিয়ে কীট পরীক্ষা করাতে পারি না। এটা ওষুধ প্রশাসনের দায়িত্ব। তিনি আরও জানিয়েছেন, আমরা সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করছি। কিন্তু সরকারি কর্তৃপক্ষ বা ওষুধ প্রশাসন কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যদি সিদ্ধান্ত না নেয় তবে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখব। তার কাছে সময় চাইব। তিনি সময় দিলে আমরা কীটের আদ্যপান্ত তার কাছেই বলতে চাই।
স্বাধীন দেশে হতে পারতেন দেশসেরা সার্জন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন চিকিৎসাখাতের প্রধান ব্যবসায়ী। কিন্তু ভিন্নধাতুতে গড়া এক লড়াকু মানুষ জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেকে গণমানুষের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে নিয়োজিত করে কি ভুল করেছেন?
প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মী করে, জনকল্যাণধর্মী চিকিৎসানীতির মাধ্যমে দেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি প্রণয়ন, জাতীয় শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে অগ্রসর শিক্ষা নীতি প্রণয়ন ও নারী উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে কি ভুল করেছেন? সরকার ও রাষ্ট্রের, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি বুকচিতিয়ে দাঁড়িয়ে ভুল করেছেন?
দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত, অনিশ্চিত তখনই বিবদমান পক্ষের মাঝখানে সমঝোতার সেতুর ভূমিকা নিয়ে ভুল করেছেন? রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকে একজন ব্যক্তিমানুষের পক্ষে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য সর্বোচ্চটাই করে ভুল করেছেন? কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনে অবস্থান নিয়ে কি ভুল করেছেন? নাকি ব্যক্তিত্বের শিখরস্পর্শী এক উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ভুল করেছেন?
যুদ্ধ যখন বিস্তার লাভ করে যুদ্ধক্ষেত্রে হতাহত যোদ্ধা, উদ্বাস্তু ও নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নর-নারীর জরুরি চিকিৎসাসেবায় প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় একটি হাসপাতালের। মুক্তিযুদ্ধের ২ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম জিএস ডা. এমএ মবিনকে নিয়ে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জের মেলাঘরে হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানে জাফরুল্লাহ চৌধুরী গড়ে তোলেন প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল- ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামে ফিরে গিয়ে স্বাস্থ্যযুদ্ধ শুরু করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতালটি গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র নামে গড়ে তুলেন কুমিল্লায়। পরে সেটা স্থানান্তর করেন ঢাকার অদূরে সাভারে। এ ‘গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র’ নামটি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৯ সাল থেকেই তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিটির ও নারী কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশে শিক্ষা ও নারীনীতি প্রণয়নে। তবে গণস্বাস্থ্যের পর তার ম্যাগনাম ওপাস হচ্ছে ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষুধ নীতি। স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্যখাতে যেটাকে বিবেচনা করা সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে। তাঁর প্রচেষ্টায় আমদানি ওষুধের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২২৫ টিতে। বর্তমানে ৯০ শতাংশ ওষুধই দেশে তৈরি হচ্ছে এবং বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে একটি ওষুধ রপ্তানিকারক দেশে। অথচ জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ১৯৯২ সালে তার সদস্যপদ বাতিল করেছিল বিএমএ। বিনা বিচারে তাঁর ফাঁসি চেয়ে পোস্টারও সাঁটিয়েছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনের লক্ষ্যে প্রথম বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভুল করেছেন? নাকি ভুল করেছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধানের পদ ছেড়ে দিয়ে? বিভিন্ন সরকারের সময়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে কি ভুল করেছেন? বঙ্গবন্ধুকে বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতির বিষয়ে অবহিত করে সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে ঔষুধ আমদানিতে অনুপ্রাণিত করে কি ভুল করেছেন? নাকি বাকশালে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করে তিনি ভুল করেছিলেন?
ভুল কোথায় জানেন? জাফরুল্লাহ সাহেব ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন ওই কীটের মূল্যে ৩০০ টাকার বেশি হবে না। তাহলে আমাদের প্রশাসনের হুমরাচুমরা চোরেরা বিল-ভাউচার করে শত কোটি চুরি করবে কীভাবে? জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন ফর্মুলা উন্মুক্ত করবেন, তাহলে চোরেদের বন্ধু রক্তচোষা ব্যবসায়ীরা ফর্মুলা নিয়ে চড়া দামে ওই ‘কীট’ বাজারে আনবে কী করে? তাই তারা প্রটোকল আর কাগজপত্রের মার দেখিয়ে এটাকে আটকাতে চায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কীট।
এদেশে গুনিজনের কদর নেই, বরং গুনির জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলার সংস্কৃতি বিদ্যমান। যেমনটা কদিন আগে গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দমিয়েছিল। যিনি তার এলাকা এবং সারা দেশের জন্য ৭০ হাজার টেস্ট কীট আর পিপিই এনেছিলেন। তিনি অনুমোদন ছাড়া এসব এনেছেন বলে এসব ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ অথচ তিনি নিজের টাকায় এসব এনেছেন। এর আগে ডেঙ্গু থেকে বাঁচাতে ২৫ টন কীটনাশক এনেছিলেন। এই লোকগুলোকে দমিয়েই রাখা হবে!
মোদ্দা কথা, জার্মান রাজনীতিবিদ আডলফ হিটলার ভুল করেছিল সোভিয়েত দখল করে। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ভুল করেছিল কুয়েত দখল করে। জনাব, জাফরুল্লাহ সাহেব কি ভুল করেছেন কীটের গায়ে কোনো গোষ্ঠী কিংবা বিশেষ কোনো ব্যক্তির ছবি না দিয়ে!
অথবা জিয়াউর রহমান মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিলে বিএনপিতে স্বাধীনতাবিরোধী থাকায় চার পৃষ্ঠার চিঠির মাধ্যমে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী কি ভুল করেছিলেন। নাকি ভুল করেছিলেন হুসেনই মুহম্মদের এরশাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব উপেক্ষা করে?।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে রেখে, কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমানের প্রতি অকুণ্ঠ সম্মান দেখিয়ে জনাব ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী টানা ভুল করেই যাচ্ছে?
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক)