বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিদের চাল, ডাল সোয়াবিন তেলসহ গরীব দুস্থদের ত্রাণ চুরি এবং জনপ্রতিনিধিদের কৃষকের ধান কেঁটে দেয়া ও ফটোসেশন নিয়ে লিখার জন্য খাতা, কলম, তথ্য, উপাত্ত, কম্পিউটারে সামনে বসলাম এমন সময় আমার বড় ভাগনী আসমাউল হুসনা টুম্পা বহু দূর আমেরিকা থেকে ভিডিও কলে আমাকে সেখানকার প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে আত্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে তার কথা শুনাচ্ছিল। প্রথমে এখানকার মানুষ তেমনভাবে গুরুত্ব দেন নি, সচেতন হননি, তাই বর্তমানে এর ভয়াবহতা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়, আমরা গত ১ মাস থেকে ঘরের বাইরে যাচ্ছি না, লক ডাউনে আছি, যারা যাচ্ছেন তাদেরকে প্রশাসন বাধা দিচ্ছেন, কেউ কোনভাবে যদি যান তবে রাস্তার সিসি ক্যামারায় ছবি দেখে জরিমানাও করছেন। মামা আপনি বাড়ীর বাইরে যাবেন না, অন্য সদস্যদের যেতে দিবেন না। খবরে দেখলাম বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের আঘাত শুরু হয়ে গেছে, মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন মারাও যাচ্ছেন। আমার এক বন্ধু মো: শফিকুল ইসলাম দীর্ঘ কয়েক বছর পূর্বে থেকে আমেরিকায় বসবাস করেন, তিনি বলেন এখানে মানুষ আসে সুস্থ্য হয়ে দেশে যায় লাশ হয়ে, সহজে কেউ এ দেশ ত্যাগ করতে চায় না। আরও বলেন, আমেরিকায় করোনা প্রকোপ খুব, বিপদর মধ্যে আছি। গত ৪২ দিন থেকে ঘরের বাইয়ে যায়নি, এক পরিচিত লোক এসে বাজার করে দিয়ে গেছেন আরও এক মাস চলবে। পারলে দেশের মানুষের ঘরে থাকার জন্য, সচেতন করার জন্য কিছু লিখেন, দেশের মানুষের যেন উপকারে আসে। আমাদের মত সাংবাদিকদের কী ঘরে বসে থাকা যায়। তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে করোনা ভাইরাসের উপর লিখা শুরু করলাম।
করোনা ভাইরাস কী? এটা এখন কারো অজানা নেই। করোনা ভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস যা এর আগে কখনও মানুষের মাঝে এভাবে ছড়াই নি। এ ভাইরাসের পোশাকি নাম কোভিড-১৯। এনসিওভি বা নভেল করোনাভাইরাস। এ রোগটিকে বিশ্ব মহামারি ঘোষনা করেছে বিশ্ব সংস্থা এই ভাইরাস যা মানুষের ফুসফুসের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে- যা পূর্বে বিজ্ঞানীদের অজানা ছিল- চীন থেকে এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের ১৩০ টি দেশে। শুক্রবারের দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকাসহ কয়েকটি পত্রিকা মারফত জানা গেল, গোটা বিশ্বে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে ৩২ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৪ জন এবং মারা গেছেন ২ লাখ ২৯ হাজার ৪২৮ জন, সুস্থ্য পরিবারে ফিরেছেন ১০ লাখ ১৬ হাজার ৯৭৮ জন।
শুক্রবার দুপুর ১ টায় বাংলাদেশের রাজধানীর মহাখালিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত মিডিয়া বুলেটিনে অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা জানান, গত ২৪ ঘন্টায় দেশে করোনায় কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে আরও ২ জন মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসে মারা গেলেন ১৭০ জন, নতুন আক্রান্ত হয়েছেন ৫৭১ জন, মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজার ২৩১ জন। সুস্থ্য হয়ে পরিবারে ফিরে গেছেন ২৩১ জন। এ পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশের অবস্থা খুব একটা ভাল নেই, সামাজিক দূরুত্ব না মানলে, সচেতন না হলে আরও খারাপ অবস্থা হতে পারে বলে সচেতন মহলের ধারণা। দেশের ডাক্তার, সাংবাদিক, পুলিশ শিল্পপতি, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, শিশু, কিশোর, ছাত্রী, ছাত্রী, শ্রমিক কেউ পার পাচ্ছেন না এ মরণব্যধি করোনা ভাইরাসের হাত থেকে। করোনাভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৬টি প্রজাতি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। তবে নতুন ধরণের ভাইরাসের কারণে সেই সংখ্যা এখন থেকে হবে সাতটি। নতুন ভাবে বাংলাদেশে এসে করোনা ভাইরাস জীন পরিবর্তন করেছেন ১১ বার, এ যেন চরিত্রহীন করোনা ভাইরাস। এ বছর ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিকভাবে নাম দেন কোভিড-১৯ যা 'করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯'-এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
রোগটির লক্ষণ কী? রেসপিরেটরি লক্ষণ ছাড়াও জ্বর, কাশি, শ্বাস প্রশ্বসের সমস্যাই মূলত প্রধান লক্ষণ।
এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত শুষ্ক কাশি ও জ্বরের মাধ্যমেই শুরু হয়। উপসর্গ, পরে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত রোগের উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচ দিন সময় নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪ দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে কিছুকিছু গবেষকের মতে, এর স্থায়িত্ব ২৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। মানুষের মধ্যে যখন ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেবে তখন বেশি মানুষকে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে তাদের। তবে এমন ধারণাও করা হচ্ছে যে নিজেরা অসুস্থ না থাকার সময়ও সুস্থ মানুষের দেহে ভাইরাস সংক্রমিত করতে পারে। "আমরা যখন নতুন কোনো করোনাভাইরাস দেখি, তখন আমরা জানতে চাই এর লক্ষ্মণগুলো কতটা মারাত্মক। এ ভাইরাসটি অনেকটা ফ্লুর মতো কিন্তু সার্স ভাইরাসের চেয়ে মারাত্মক নয়," বলছিলেন এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মার্ক উলহাউস।
কোথা থেকে এলো করোনাভাইরাস: ? অনেক সময়ই কোন একটি প্রাণী থেকে এসে নতুন নতুন ভাইরাস মানব শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা সাম্প্রতিক ভাইরাসটির উৎস কোনো প্রাণী। যতটুকু জানা যায়, মানুষের আক্রান্ত হবার ঘটনাটি ঘটেছে চীনের উহান শহরে সামুদ্রিক মাছ পাইকারিভাবে বিক্রি হওয়া এমন একটি বাজারে। এ ভাইরাসের সম্পর্ক রয়েছে চীনের উহানের দক্ষিণ সমুদ্রের খাবারের পাইকারি বাজারের সঙ্গে। যদিও বেশ কিছু সামুদ্রিক প্রাণী করোনাভাইরাস বহন করতে পারে (যেমন বেলুগা তিমি), ওই বাজারটিতে অনেক জীবন্ত প্রাণীও পাওয়া যেত, যেমন মুরগি, বাদুর, খরগোশ, সাপ- এসব প্রাাণী করোনাভাইরাসের উৎস হতে পারে। গবেষকরা বলছেন, চীনের হর্সশু নামের একপ্রকার বাদুরের সঙ্গে এই ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে। এই রোগে ৬% কঠিনভাবে অসুস্থ হয় - তাদের ফুসফুস বিকল হওয়া, সেপটিক শক, অঙ্গ বৈকল্য এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরি হয়। ১৪% এর মধ্যে তীব্রভাবে উপসর্গ দেখা যায়। তাদের মূলত শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা তৈরি হয়। ৮০% এর মধ্যে হালকা উপসর্গ দেখা যায় - জ্বর এবং কাশি ছাড়াও কারো কারো নিউমোনিয়ার উপসর্গ দেখা যেতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের কোনো ধরণের অসুস্থতা রয়েছে (অ্যাজমা, ডায়বেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ) তাদের মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চীন থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করে জানা যায় যে, এই রোগে নারীদের চেয়ে পুরুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা সামান্য বেশি। আক্রান্ত ব্যক্তি যেন শ্বাস প্রশ্বাসে সহায়তা পায় এবং তার দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যেন ভাইরাসের মোকাবেলা করতে পারে তা নিশ্চিত করা থাকে চিকিৎসকদের উদ্দেশ্য। টিভি সেটের পাশে, ফেসবুক, অনলাইন, স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকা খুললে সর্বত্র একই বিষয়, করোনাভাইরাস। বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাসের দ্বারা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে, ৩২ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত, মৃত্যুবরণ করেছে ২ লাখ ২৯ হাজাররেও বেশি।
আর আমাদের দেশের ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৬৩ টি জেলায়তেই মহামারি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে মানুষ। তবে দেশের একমাত্র জেলা হিসেবে এখনো করোনা মুক্ত রয়েছে রাঙামাটি। সর্বশেষ জেলা হিসেবে খাগড়াছড়িতে গত বুধবার করোনা শনাক্ত হয়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। আইইডিসিআর সর্বশেষ গত বুধবার যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে ৬২ জেলায় করোনা শনাক্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ৬৩ তম জেলা হিসেবে গত বুধবারই খাগড়াছড়িতে করোনা শনাক্ত হয় বলে স্থানীয় প্রশাাসন সূত্রে জানা গেছে।
পৃথিবীর তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্নত ও পরাশক্তিগুলোও এর আক্রমণ থেকে রেহায় পাচ্ছে না। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষও তাদের কোনো সুফল দিতে পারছে না অদৃশ্য এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে। এখনো করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বা সফল কোনো চিকিৎসাব্যবস্থা উদ্ভাবিত হয়নি। তুলনা করলে দেখা যায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের মানুষরাই বেশি বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। করোনার মতো প্রাণঘাতী রোগের প্রথম উৎপত্তি হয় চীনে। এতদিন এটাই শুনে এসেছি। কিন্তু সম্প্রতি এনিয়ে চীনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়েছে, এ রোগের আসল উৎপত্তি স্থল চীনে ছিল না, ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এনিয়ে বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উদীয়মান শক্তি চীনের মধ্যে ইতোমধ্যে তর্কযুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে। করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল নিয়ে সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরোধ-সম্পর্কিত বিভিন্ন সংবাদ। তবে করোনাভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী রোগের মূল উৎপত্তিস্থল চীন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে তর্ক আজ আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এ রোগ যে এখন সারা বিশ্বের জন্য মহা আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটাই বড় কথা। সুতরাং এই ভয়াবহ রোগের উৎপত্তি কেন ও কীভাবে হয় এবং কীভাবে এর প্রকোপ থেকে সমগ্র মানব জাতিকে রক্ষা করা যায় সেটা নিয়েই চিন্তা-গবেষণায় মনযোগী হওয়াটাই এখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক মনীষী- ইসলামি চিন্তাবিদ মনে করেন, করোনা ভাইরাস মানুষের কৃত কর্মের ফল দিচ্ছেন আল্লাহ। আধুনিক বিশ্বে মানুষ এত অধিক অন্যায় ও মানবতা বিরোধীকাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে যে, আল্লাহর কাছে দুনিয়ায় মানুষের প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে, মানুষের আর কোনই প্রয়োজন নেই বিশ্বপ্রতিপালকের কাছে। সে কথা হয়ত অনেকে বিশ্বাস করবেন না। বিশ্বের অনেক ক্ষমতাধর প্রধান মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি মসজিদে মসজিদে গিয়ে মুসাল্লীদের নিকট মাফ চাচ্ছেন, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে অনুরোধ করেছিন এ মহাবিপদ করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার জন্য।
এর আগেই করোনাভাইরাস আমাদের সামনে ভিন্ন বার্তা, ভিন্ন আশঙ্কা ও বাস্তবতা নিয়ে হাজির হয়েছে। এই মহামারীর গন্তব্য বা শেষ কোথায় তা এখনো অনিশ্চিত। আমরা কেউই এই মহামারীর আশঙ্কা থেকে মুক্ত নই।
পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। কোটি কোটি মানুষকে গৃহবন্দি করে রাখা এবং ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিংই করোনাভাইরাস থেকে এই মুহূর্তে বেঁচে থাকার একমাত্র কার্যকর প্রতিবিধান হিসেবে গণ্য হচ্ছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়লরা ট্রিলিয়ন ডলারের বেইল-আউট প্রোগ্রাম নিয়ে কোটি কোটি সদ্য বেকার মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেও এই ব্যবস্থা বেশিদিন চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কোনো দেশেরই নেই। এ কারণেই প্রতিদিন বিশ-পঁচিশ হাজার নতুন সংক্রমণ ও দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর মধ্যেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লকডাউন তুলে দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করার বিষয় চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিতদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর ভয়াল দৃশ্য দেখার পরও বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে লকডাউন ও সোশ্যাল ডিসটেন্সিং রক্ষা করা যাচ্ছে না। শ্রেফ পেটের দায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রুটি-রুজি বা ত্রাণের জন্য রাস্তায় বেরিয়ে আসছে হাজারো মানুষ।
সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর সংখ্যা এখনো ২শ’র কম। আক্রান্ত ৮ হাজারের বেশি। অন্য অনেক দেশের তুলনায় এ পরিসংখ্যান হয়তো স্বস্তিদায়ক। তবে করোনাকারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। করোনার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে রোগীরা প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না। সব হাসপাতালে করোনাবহির্ভূত জটিল এমনকি সাধারণ রোগীরাও স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। ঢাবির এক ছাত্র বিনাচিকিৎসা মারা গেছে, এজন্য প্রধান মন্ত্রী ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সদের সেবা বঞ্চিত রোগীদের বিক্ষোভ করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। রোগীদের সাথে ডাক্তার ও নার্সদের মানবেতর আচরণের অভিযোগসহ নানাবিধ অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশের অগোছালো, প্রস্তুতিহীন অবস্থা সম্পর্কে শুরুতেই বিশ্ব সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল। দুই মাস পেরিয়ে এসেও করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্ততিহীনতার চিত্রই প্রকট। এখনো দেশে গড়ে প্রতিদিন করোনা পরীক্ষা হচ্ছে ৪-৫ হাজার মাত্র। যেখানে শুধুমাত্র গড় জানুয়ারি মাসেই ৬ লক্ষাধিক মানুষের বিদেশ ভ্রমণের রেকর্ড আছে। বিদেশ ফেরত এসব মানুষ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে সামাজিক সংক্রমণ সৃষ্টি করেছে। এ কারণেই লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করা না গেলে মে মাস নাগাদ বাংলাদেশে করোনা মহামারী ভয়াল রূপ ধারণ করার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
করনোভাইরাসের মহামারী দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে পশ্চিমাবিশ্বে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দা একটি বিশ্বমন্দায় রূপ নিতে পারে। ইতালি, আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মন্দা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি খাতকে সরাসরি আঘাত করছে। জ্বালানি তেলের মূল্যে ধস, সউদি আরব, সিঙ্গাপুর বা আরব আমিরাতের মন্দা বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে চলেছে। এর মানে হচ্ছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রকোপ যেমনই হোক, এর বৈশ্বিক প্রভাব দেশের অর্থনীতিকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। এজন্য বাংলাদেশ সরকার সীমিত আকারে পোশাক শিল্প খুলে দিয়েছেন। অন্যদিকে কোন দেশ করোনাভাইরাস মহামারী কীভাবে মোকাবেলা করেছে, কোন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সামাজিক নিরাপত্তার অবস্থা সম্পর্কে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন আগামীদিনে রাষ্ট্র হিসেবে দেশগুলোর সমৃদ্ধি ও মর্যাদার মানদন্ড হিসেবে গণ্য হতে পারে। ইউরোপ-আমেরিকায় যখন প্রতদিন হাজার হাজার মানুষ করোনাভাইরাসে মারা যাচ্ছে, এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফএম গ্লোবাল-এর গ্লোবাল রেজিলিয়েন্স ইনডেক্স-১৯’এ বিশ্বের ১৩০টি দেশের করোনাভাইরাস দুর্যোগ মোকাবেলা সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৬ তম। আর আর গত সপ্তাহে প্রকাশিত জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপি এশিয়া প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৮টি দেশের জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান সবার পেছনে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গ্লোবাল রিজেলিয়েন্স ইনডেক্সে শতাধিক দেশের পেছনে থাকার তিন সপ্তাহ পর ইউএনডিপির জরিপে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর তো বটেই, ইরান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনেরও ধারে কাছে নেই আমাদের বাংলাদেশ। এমনকি ভারত, পাকিস্থন, শ্রীলঙ্কা বা নেপালও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকার চিত্র উঠে এসেছে ইউএনডিপির রিপোর্টে। জরিপে ব্যবহৃত ৮টি সূচকের মধ্যে থাইল্যান্ড, ইরান ও ফিলিপাইন ৭টি খাতে নাগরিকদের সুরক্ষার উদ্যোগ নিতে সক্ষম হয়েছে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর ৬ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে দ্বিতীয় সারিতে অবস্থান করছে, ৫ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে জাপান, মালয়েশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া ও ভারত তৃতীয় সারিতে অবস্থান করছে। দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা চারটি এবং নেপাল ও পাকিস্থান তিনটি পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। বয়স্ক ও প্রতিবন্দীদের ভাতা দেয়া ছাড়া আর কোনো সূচকেই বাংলাদেশের পদক্ষেপ নেই বলে ইউএনডিপির রিপোর্টে বলা হয়েছে।
রিপোর্টে বাংলাদেশের ব্যাপারে যাই আসুক না কেন? মাদার অফ হিউম্যানিটি, প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে আছেন। তিনি বিভিন্ন বিভাগের সচিব, মন্ত্রী,এমপি, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, ইউএনওসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাঝে মাঝে ভিডিও কনফারেন্স, বার্তা পাঠাচ্ছেন, সার্বক্ষুনিক যোগাযোগ রাখছেন। মিডিয়ায় প্রকাশিত সাংবাদের গুরুত্ব দিচ্ছেন, দেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কোচিং, প্রাইভেট, বন্ধ করেছেন, পরিবহন বন্ধ রেখেছেন, দফায় দফায় সরকারী ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি করছেন, এইচএসসি মত পাবলিক পরীক্ষা স্িিথগত হয়ে আছে, এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলও প্রকাশ করা সম্ভাব হয়নি। করোনা প্রস্ততি ভাল না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ব্যপারে তিনি আগাম নির্দেশনা দিয়েছেন। জুমা, তারাবিসহ সকল নামাজ বাড়ীতে পাড়ার নির্দেশনা দিয়েছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়। লকডাউন চলছে সারা দেশে, হাট, বাজার সামাজিক দূরুত্ব বজায় রেখে নদীর ধারা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠেসহ বিভিন্ন ফাাঁকা জায়গায় বসানো হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ দেখবাল করছেন। সরকার প্রর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করছেন। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগঠন, জনপ্রতিনিধিরা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সমিতি, সমাজের অর্থশালি ব্যক্তিরা নিজস্ব অর্খায়নে গরীবদের নিকট ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু অত্যন্ত দু:খজনক হলেও বাস্তব সত্য কথা কিছুকিছু অসৎ জনপ্রতিনিধি ও নেতা ত্রাণের চাল, ডাল, সোয়াবিন তেল চুরি করা অব্যাহত রেখেছেন যা মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। প্রধান মন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করায় তার বহিস্কার হয়েছেন, তাদের জেল, জরিমানা হয়েছে, তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে তবুও থামছেনা ত্রাণ চুরি।
এ অবস্থায় অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ববাস্তবতার আলোকে ভাইরাস, মহামারী, যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বৈশ্বিক উদ্যোগ দেখা যেতে পারে বলে রাজৗনৈতিক বিশ্লেকরা প্রত্যাশা করেছেন। প্রথম মহাযুদ্ধের দুই দশকের মধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার ব্যবহারসহ কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানী ঘটলেও লিগ অব নেশনস থেকে জাতিসংঘ পুনর্গঠন এবং পারমাণবিক বোমা বিরোধী ননপ্রলিফারিং ইনিশিয়েটিভসহ আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগ ও সম্মিলিত পদক্ষেপের কারণে গত ৭৫ বছরেও বিশ্বকে আর কোনো বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়নি। করোনাভাইরাস নিয়ে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে ব্লেইম-গেইম ও ঠান্ডা লড়াইয়ের আলামত পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমা ইউনিপোলার সাম্রাজ্যবাদের মূল শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতদিন ধরে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ প্রায় সব বিশ্ব সংস্থাকে নিজেদের সুবিধামত পরিচালনা করে এলেও এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেজেগোবুরে অবস্থায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উপর চীনের পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার চাঁদা ও অনুদান বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। করোনাভাইরাস মহামারী পরবর্তী বিশ্বে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতি মানুষের প্রত্যাশা, দায়িত্ব ও ভূমিকা অনেক বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশে করোনার প্রকট যায় হউক না কেন দেশের শিক্ষা, কৃষি, শ্রমবাজারসহ সকল সেক্টরে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। দেশের মাত্র ১০ ভাগ উচ্চবিত্তের হাতে প্রায় ৯০ ভাগ সম্পদ। এই উচ্চবিত্তরা নিজের আরাম আয়েশের জন্য ইউরোপ আমেরিকা, দুবাই সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াতে গড়ে তুলেছেন সেকেন্ড হোম, এরাই আসলে বাংলাদেশের মানুষের রক্ত শোষন করে নিচ্ছেন। যারা বিভিন্ন অজুহাতে বিদেশে সেকেন্ড হোম গড়েছেন তাদেরকে করোনা ভাইরাস থেকে শিক্ষা গ্রহন করে সরকারের পাশাপাশি বাংলাদের গরীব মানুষ গুলো পাশে দাঁড়াতে হবে তা হলেই গরীব মানুষ বাঁচবে। আসুন সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে গরীব দু:খী মানুষকে সাহাস্য করি। মানুষ বাঁচলে দেশ বাাঁচবে। আর করোনা ভাইরাস যুদ্ধে জয় লাভ করে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের আগেই উন্নত, সমৃদ্ধ হবে ইনশাল্লাহ।