বাংলাদেশকে করোনা পরিস্থিতিতে দেশ ও মানুষের জন্য নিবেদিত থাকার প্রত্যয়ে অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু উন্নত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মত তো নয়ই; মধ্যম আয়ের দেশগুলোও যখন নিবেদিত জনগনের জন্য, তখন নিরন্ন মানুষগুলোকে করোনাকালে সহায়তার হাত না বাড়িয়ে অভূক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়াতে কাজ করছে হাজার-শত কোটি টাকার মালিকশ্রেণির দানবগুলো। যারা রাজনীতি-অর্থনীতিকে করোনা পরিস্থিতিতে তৈরি করে তুলছে অস্থির। এমন পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির। এতে ৫টি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- উৎপাদন, নির্মাণ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পরিবহন ও যোগাযোগ এবং সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা। এতে চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এবার ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি অর্জন হবে না। এছাড়া দরিদ্র ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ইতোমধ্যে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বেড়েছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য। এ অবস্থায় বাস্তবতার আলোকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে বলে আমি মনে করি। রাজপথে থাকা, কারাগারে থাকা, কালোহীন নিবেদিত আলোর পথে থাকার জন্য নিরন্তর আমি মানুষের জন্য বরাবরই কথা বলেছি, এখনো সেই ধারা অব্যহত রেখে এগিয়ে চলছি।
বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতিতে বাড়ি ভাড়া দিতে অপারগ কর্মহীন নিরন্ন মানুষদের বাড়ি ভাড়া সমস্যা সমাধানের জন্য ভর্তুকি দিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসার দাবীতে অনশন করেছি, রোডমার্চ করে স্মারকলিপি দিয়েছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর। গণপরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সমাবেশ করেছি এবং সর্বশেষ স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি বন্ধের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করেছি। বাজেট যেন গণমুখি হয়; সেই দাবীতে কর্মসূচী করেছি। এত কিছুর পরও যখন জেনেছি- চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে। এছাড়া আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। যা একেবারে অসম্ভব।’ তখন নিরন্ন মানুষের কথা ভুলে লোভি-দুর্নীতিবাজরা একের পর এক লুটতরাজের প্রজেক্ট দাঁড় করাচ্ছে এবং লুট করে যাচ্ছে ত্রাণ-সহায়তার অর্থ। এমন পরিস্থিতিতে কেবলই মনে হচ্ছে যে, স্বাস্থ্য খাত, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি এবং কর্মসংস্থান নিয়ে আন্তরিকতার সাথে অগ্রসর হতে হবে, সমাধানে নিবেদিত হতে হবে। এছাড়া রাজস্ব খাতের জন্য রাজস্ব আহরণে প্রণোদনা, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন, করফাঁকি ও অর্থপাচার রোধ এবং এ খাতের প্রয়োজনীয় নিশ্চিত করার জন্য নিবেদিত থাকতে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। করোনা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে থামবে, তা আমরা কেউ জানি না। এমনকি বিজ্ঞানীরাও বলতে পারে না। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। আমরা কামরাঙ্গিরচর সহ বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ দিতে গিয়ে গণমানুষের যে রুপ আমরা দেখেছি, সেই আলোকে বুঝতে পেরেছি যে, করোনার সময়ে দেশে বৈষম্য আরও বাড়ছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি ও দেশের বাইরের খাত অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। তবে বাজেট অর্থায়নের এক্ষেত্রে এবার বৈদেশিক খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
একথা সত্য যে, সরকার বৈদেশিক অর্থায়নের জন্য ইতোমধ্যে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের চাহিদা দিয়েছে। এই অর্থ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে। আর প্রতি বছরই বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়। কিন্তু এবার এটি ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে রাখলেও সমস্যা নেই। করোনাকালে কেবল মনে হচ্ছে যে, আমরা এ বছরের জন্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করেছিলাম। প্রথম নয় মাস অর্থনীতি খুব ভালো চলেছে। সুতরাং আমাদের ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতেই পারে। তবে আমাদের হিসাবে ২ থেকে আড়াই শতাংশের বেশি হবে না। তবে একথাটিও মনে রাখতে হবে যে- আসন্ন বাজেটে রাজস্ব আদায়ে ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। এটি একেবারে অসম্ভব। কারণ স্বাভাবিক সময়ে রাজস্ব আয়ে প্রতি বছর ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। এর আগে ২০১২ সালে সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে সব খাতে যেখানে আয় কমছে, সেখানে কীভাবে এই প্রবৃদ্ধি হবে, তা বুঝে আসে না। স্বাস্থ্য খাতে ঝুঁকি কমাতে না পারলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। এ সময়ে বাজেটে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে মার্চের শেষদিক থেকে অর্থনীতি একটা ভিন্ন গতি-প্রকৃতিতে চলে গেছে। জিডিপিতে ১৫টি খাত থাকে। এর অধিকাংশই ক্ষতিতে পড়েছে। তবে কৃষি ওইভাবে প্রভাবিত হয়নি। কৃষির উৎপাদন মোটামুটি ভালো। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা যদি ধরে নিই অর্থবছরের বাকি যে সময় আছে তাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে, তারপরও প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি সম্ভব নয়। অর্থাৎ সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিও যদি আমরা এই বছরের জন্য চিন্তা করি, তাহলে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হবে না। এই অর্জনও যথেষ্ট খারাপ নয়। বিশ্বের অনেক দেশ এই সময়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে চলে গেছে। ভারতেও এই ধরনের আশঙ্কা করা হয়েছে। তার মতে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ প্রবৃদ্ধি সবকিছু নয়। আমাদের নীতিনির্ধারকরা প্রবৃদ্ধি গুরুত্ব দেন। কিন্তু বর্তমান সময় অত্যন্ত ভিন্ন ধরনের সময়। এই সময়ে আমরা প্রবৃদ্ধির ওপর বিশেষ জোর না দিয়ে, বরং আমাদের মানুষের জীবন বাঁচানোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফলে প্রবৃদ্ধি অবশ্যই এবারের জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামক হতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষ থেকে কথা বলতে চাই, যারা বেকারত্বের অভিশাপে লুটিয়ে পড়ছে। তাদের দিকে তাকিয়ে অন্তত সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। করোনার কারণে আমাদের দরিদ্রতার হার অনেক বেড়েছে। আগে আমাদের দরিদ্রের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর ইতোমধ্যে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে, তারা কবে ফিরে আসবে, তা অনিশ্চিত। পুরো বছরই আমাদের সম্পদ সংগ্রহ, ব্যাংকিং খাত এবং পুঁজিবাজার অত্যন্ত সমস্যায় ছিল। এরপর অর্থায়নের জন্য সব জায়গা থেকেই ব্যাংকের ওপর চাপ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এই টাকা দেয়ার জন্য ব্যাংকিং খাত প্রস্তুত কিনা তা বিবেচনায় নিতে হবে। লকডাউনের মধ্যে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ বাড়ছে না। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ অর্থ ইতোমধ্যে সরকার নিয়েছে। আগামী অর্থবছরেও এই মাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা পাবে না। এতে বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে। তবে টাকা ছাপানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে-বাংলাদেশের মানুষকে।
একই সাথে খাদ্যমন্ত্রীর মত এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে ঘরে বসে থঅকলে চলবে না, পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে করে মানুষের সমস্যা কেটে যায়; অভূক্ততার দিন শেষ হয়। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা এবং ন্যূনতম কর হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা উচিত। মনে রাখতে হবে- আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ওইভাবে বাড়বে না। কারণ মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে সঞ্চয় কমবে। এতে সামগ্রিকভাবে সরকারের অর্থায়ন চ্যালেঞ্জে পড়বে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে প্রশাসনিক দক্ষতায় ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। এই সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে; তা না হলে ভেঙ্গে পড়বে বাংলাদেশের সকল সম্ভাবনার ভিত। যা আমাদের কারোই কাম্য নয়। যদিও করোনা মহামারীকে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য মারাত্মক আঘাত হিসেবে অভিহিত করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস। মহামারী কয়েকশ’ কোটি মানুষের জীবিকার ভয়াবহ ক্ষতি করবে। এছাড়া কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয় এক দশক পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে বলে ধারনা করছি; এমতবস্থায় অগ্রসর হতে হবে সততার সাথে সকল মন্ত্রীকে-এমপিকে-সচিবকে। তা করার বদলে ক্রমশ সমস্যার দিকে এগিয়ে চলছে অন্ধকারের মানুষেরা।
আমি মোমিন মেহেদী রাজপথে যেমন থাকি, তেমন থাকি কলাম লেখার মত কাজের সাথেও। গত ২৫ বছরের পথচলার পথ ধরে বলতে চাই- বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞানুযায়ী সেসব ব্যক্তিই ‘চরম দারিদ্র্যের’ আওতায়, যারা এক দশমিক ৯০ ডলারের চেয়েও কম অর্থে দিন কাটান। মহামারীর কারণে ৬ কোটিরও বেশি লোককে দিনে এক পাউন্ডেরও কম অর্থে জীবনযাপন করতে হতে পারে। মহামারী ও শাটডাউনের যৌথ প্রভাবে কয়েকশ’ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা বিঘিœত হচ্ছে। অনেকেরই রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। এগুলোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যজনিত ও সামাজিক প্রতিক্রিয়াও নির্মম হবে। এটা উদ্বেগজনক। যাদের সামর্থ্য যত কম, তারাই তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও সতর্ক করছি। কেননা, বাংলাদেশের মানুষ কেবল দরিদ্রই হবে না, হবে বেকারও। এমনকি অনানুষ্ঠানিক খাতেও কাজ পাচ্ছে না। এর পরিণতি দশককাল ধরে থাকতে পারে বলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে ও বুঝতে পারছি। আর তাই বলতে চাই- এখন একটাই শ্লোগান হোক করোনা থেকে মুক্তি পেতে মানবতায় হবে যেতে। তা না হলে মানবতার পথে না থাকলে শুধু মানুষ নয়; অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সমস্যার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে; যা কখনোই চাই না। তাই আজ আরো একটি বিষয় সবার সামনে নিয়ে আসছি। আর সেটি হলো- করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবা সব সেক্টরকেই গ্রাস করছে। লকডাউন ও ছুটির ফাঁদে পড়ে অন্যান্য সেক্টরের ন্যায় ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি দেশের বস্ত্র খাত। পুনরায় মিল-কলকারখানা চালু হলেও কোনো শিল্প ইউনিট ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। সক্ষমতার বিপরীতে অর্ডার নেই। বড় জোর ৩০ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী দিয়ে মিল ফ্যাক্টরি চালানোর সুযোগ আছে। তাও কতদিন চলবে- তা অনিশ্চিত। এ হিসাবে কমপক্ষে বস্ত্র সেক্টরের ৭০ শতাংশ কর্মীর চাকরি হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু গার্মেন্ট সেক্টরেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১ কোটি লোকের কাজ থাকবে না।
আমি মনে করি বাংলাদেশ একটি ঘর। আর এই ঘরের বাসিন্দা ১৮ কোটি মানুষ। সেই সকল মানুষ মিলে ‘বাংলাদেশ পরিবার’। আর তাই মনে রাখা চাই- সবাই সবার জন্য নিবেদিত না হলে বড় ধরনের ধ্বসের মুখে পড়া অর্থনীতিকেও আর রক্ষা করতে পারবো না হয়তো। তাই দুর্নীতি- দেশের বাইরে টাকা পাচার সহ সকল অন্যায় প্রতিরোধের পাশাপাশি সরকারী, বিরোধী, সাবেক বিরোধী, বামাতি-জামাতি যারাই দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে-আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, সবাইকে চিহ্নিত করুন। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে করোনা পরিস্থিতিতেও তারাই ঠকিয়েছে চাকরি-ব্যবসা বন্ধ করেছে; সকল কিছুর দাম বৃদ্ধি করে আমাদেরকে সর্বশান্ত করেছে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি