সারাবিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমরা সমগ্র দেশের মানুষ কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের সংক্রমনে এক দুর্বিসহ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যদিয়ে জীবনযাপন করছি। গুটি কয়েক শিল্পকারখানা স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে খোলা থাকলেও দেশের অধিকাংশ শিল্প কারখানা, সরকারী-আধাসরকারী কিংবা বেসরকারী অফিস, আদালত দীর্ঘ দুইমাসের অধিক সময় বন্ধ ছিল। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের কাজ চলছে। এই বছরের ২৪ মার্চ লকডাউন ঘোষনা করা হলেও জনগণের অসচেতনতা ও সরকারের অব্যবস্থাপনা সাধারণ মানুষকে করোনা ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়েছে যা বর্তমানে মহামারীতে রূপ নিয়েছে। দীর্ঘ সময়ের লাগাতার লুটপাট, দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্যখাতের বেহালদশা করোনার সুবাদে সাধারণ মানুষের কাছে স্পস্ট হয়ে উঠেছে। হাসপাতালগুলোর সক্ষমতার ঘাটতি, অপর্যাপ্ত করোনা টেস্ট কিট, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এন৯৫ মাস্ক ও পিপিই’র ঘাটতি, রোগ নির্ণয়কেন্দ্রগুলো অব্যবস্থাপনা ও রোগ নির্ণয়ে দীর্ঘ কালক্ষেপন, হাসপাতালগুলোর আসন সংখ্যার ঘাটতি, আইসিইউ ও ভেনটিলেটরের ঘাটতি সাধারণ মানুষকে করেছে শঙ্কিত। অন্যদিকে সাধারণ ছুটি ঘোষনা ও কর্মচ্যুত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্যাভাব প্রকট আকার ধারণ করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরাসরি নির্দেশনায় সরকারী উদ্যোগে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ চালু হলে যেমন প্রশংসিত হয়, তেমনই সেখানেও লুটপাট, চুরি, দুর্নীতির লঙ্কাকান্ড এদেশের সচেতন সমাজ অবলোকন করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যক্তিগত, প্রতিষ্ঠানগতভাবে খাদ্য উপহার নিয়ে এগিয়ে আসায় কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও দেশের অসংখ্য মানুষ এই সুবিধার বাইরে। কৃষিজাত খাদ্য শস্যের পরিবহন ব্যবস্থায় সিদ্ধান্তহীনতা ও অব্যবস্থাপনায় অসংখ্য কৃষককে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। সবকিছু মিলিয়েই নতুন ২০২০-২১ অর্থবছরকে কেন্দ্র মানুষ বাজেটের দিকে আশাবাদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় স্বাস্থ্যখাতে, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে শিক্ষাখাতে, খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কৃষিখাতে, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাত, প্রযুক্তি ও গবেষনা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ আশা করছিল।
বাজেট! প্রতি বছর জুন মাস এলেই পত্রপত্রিকা, টিভিতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বাজেট নিয়ে একটা সোরগোল পড়ে যায়। স্বাভাবিক! দেশের বাজেট মানেই তো দেশের সর্বস্তরের মানুষের পরবর্তী অর্থবছর জুড়ে জীবনের মান কেমন হবে তার প্রতিফলন। অর্থাৎ একটি দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিক্ষিত নামটাই বাজেট। যদিও আমাদের দেশের জাতীয় বাজেটে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। কিন্তু কি এই বাজেট? আমাদের দেশের কত শতাংশ মানুষ এই বাজেট সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা রাখেন? বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্যের নিরিখে গোল্ডেন টাইম পিরিয়ডের মধ্যদিয়ে অতিক্রম করছে। এই টাইম পিরিয়ডের স্থায়ীকাল প্রতি একশত বছরে মাত্র দশ বছর স্থায়ী হয়। এই সময়কে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রকে পিছিয়ে পড়তে হয় শত বছর পেছনে। সুতরাং দেশের কর্মক্ষম প্রায় ৬০ শতাংশ নারী-পুরুষের যেমন দায়িত্ব রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকার গতিকে সচল রাখা, তেমনই রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব জনগণের অর্থের সুষমবন্টনের মাধ্যমে তাদের জীবনকে সহজ, বৈষম্যহীন এবং আনন্দদায়ক করা। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন কিভাবে করছে, কোন নীতির উপরে দায়িত্ব পালন করছে তা বুঝতে হবে একজন নাগরিককে বাজেট সম্পর্কে সম্মক ধারনা থাকা জরুরি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষা, অল্পশিক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং অসচেতনতার কারণে এই বাজেট সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা রাখেন না। তাদের কাছে বাজেট মানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম হ্রাস কিংবা বৃদ্ধি। কিন্তু আমাদের শিক্ষিত তরুন প্রজন্ম! তারা কি বুঝতে সক্ষম হচ্ছে এই বাজেটকে? বাজেট বিষয়টিকে সহজভাবে আজকে শিশু-কিশোর-তরুনদের উপস্থাপন করা আবশ্যক হয়ে উঠেছে। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকা ব্যক্তিবর্গ ৯০ শতাংশের অশিক্ষা, অল্পশিক্ষা ও দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাদের বঞ্চিত করে স্বার্থ রক্ষা করে চলছে ১০ শতাংশের। এর অবসান হওয়া উচিত।
একটি রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোথায় কত ব্যয় হবে এবং সেই ব্যয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আয়ের উৎস কি নির্ধারণের নির্দিষ্ট পদ্ধতিগত পরিকল্পনাকেই আমরা বাজেট বলতে পারি। আরো সহজভাবে বললে বাজেট হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের পরবর্তী একবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নির্ধারণ করে। এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র যেমন রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট খাতে মোট ব্যয়ের পরিমান নির্ধারণ করে, তেমনই সেই ব্যয়ের অর্থ সংগ্রহের সোর্সগুলোকেও সুনির্দিষ্ট করে। এটা অনেকটা আমাদের পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মাসিক আয়ের সাথে সামঞ্জস্য বিধান সাপেক্ষে নির্ধারিত ব্যয়ের পরিকল্পনার মত, তবে বিপরীতমুখী। অর্থাৎ পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি তার উপার্জনের পরিমানের নিরিখে ব্যয় নির্ধারণ করেন। আর রাষ্ট্রীয় বাজেট নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, তারপরে আয়ের উৎস। আয় ও ব্যয়ের ধরনের উপর ভিত্তি করে বাজেটকে দুইভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। একটি অনুন্নয়ন বাজেট এবং অন্যটি উন্নয়ন বাজেট। অনুন্নয়ন বাজেটটি হচ্ছে সরকার পরিচালনার মোট ব্যয়। একে রাজস্ব বাজেটও বলা হয়ে থাকে। এই ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে দেশরক্ষায় ব্যয়, দেশের অভ্যন্তরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যয়, বিভিন্ন বেসামরিক সরকারি অফিস-আদালত পরিচালনায় ব্যয়, সুদ পরিশোধ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা পরিশোধের ব্যয়, যা বিগত কয়েক বছর থেকে তুলনামূলক বিপদজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতো গেলো ব্যয়ের কথা। রাষ্ট্রের আয়ের উৎস কি প্রশ্ন আসতেই পারে। রাষ্ট্রের আয়ের উৎস তিনটি- প্রত্যক্ষ কর, পরোক্ষ কর এবং করবহির্ভূত কর। করপোরেট কর, ভূমি রাজস্ব, আয় কর ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করের আওতায় পরে। পরোক্ষ করগুলো হচ্ছে আমদানী কর, আবগারী শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্ক ইত্যাদি। এর বাইরেও সরকারী হাসপাতাল, বিভিন্ন জরিমানা, পরিবহন, ইজারা ইত্যাদি থেকে রাষ্ট্রের অর্থ আয় করে। এগুলো করবহির্ভূত আয়ের আওতায় পড়ে। এই সকল আয়ের অর্থ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সমস্ত খরচ মিটিয়ে থাকে। এরপর অবশিষ্ট অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজগুলো করে। আর এই উন্নয়নমূলক কাজের জন্য সরকার যে অর্থ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তাকে উন্নয়ন বাজেট বলে। উন্নয়ন বাজেটের আওতায় পড়ে স্কুল-কলেজ নির্মাণ, ব্রিজ-কালভার্ট-রাস্তা নির্মাণ, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, হাসপাতাল নির্মাণ, গ্রামীন উন্নয়ন ইত্যাদি। উন্নয়ন বাজেট প্রণয়নে রাজস্ব উদ্বৃত্ত যথেষ্ট না হলে সরকার বৈদেশিক ঋণ গ্রহন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কিন্তু এই বৈদেশিক ঋণের বোঝা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মানুষের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। আয় ও ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধানের দিক থেকে বাজেট দুই ধরনের- সুষম বাজেট ও অসম বাজেট। যেই বাজেটে সরকারের আয় এবং ব্যয় সমান তাকে সুষম বাজেট বলে আর যেই বাজেটে আয় এবং ব্যয় সমান নয় তাকে অসম বাজেট বলে। অসম বাজেট আবার দুই প্রকার- উদ্বৃত্ত বাজেট ও ঘাটতি বাজেট। উদ্বৃত্ত বাজেটের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ব্যয়ের তুলনায় আয় বেশি থাকা। আর ঘাটতি বাজেটে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি থাকে। আমরা মূলত ঘাটতি বাজেটের সাথে সমধিক পরিচিত। সাধারণত একটি দেশের জিডিপির ৫ শতাংশ ঘাটতি সহনশীল হিসেবে মেনে নেয়া যায়। এর বেশি হলে বাড়তে থাকলে বুঝে নেয়া হয়ে দেশ বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘাটতি পূরণের উৎসগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে- বৈদেশিক খাত ও অভ্যন্তরীন উৎস। অভ্যন্তরীন উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত উৎস। ব্যাংক বহির্ভূত উৎস বলতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিকে বোঝায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার সাধারণ মানুষের কাছে ঋণ নেয় সরকার। এই ঋণ অধিক হলে সরকারের সুদ পরিশোধের হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারী বিনিয়োগ কমে যায়।
এবার বাজেট পর্যালোচনা করা যাক। শুরুতেই বলে নেয়া দরকার, এবারের বাজেট অন্যান্য বারের থেকে অনেক গুরুত্ব বহন করে। তাই গতানুগতিক বাজেট এবার কারোর জন্য কাম্য নয়। করোনা মহামারী কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক মন্দা, স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে টেকসই স্বাস্থ্যখাত প্রতিষ্ঠা, প্রতি আপদকালীন সময়ে দেশের নিম্ন-নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের জন্য আর্থিক ও খাদ্য সহযোগীতা করা, বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের ধারাবাহিকতায় সম্ভাব্য দেশের অভ্যন্তরের খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কৃষি ব্যবস্থা, মুখ থুবড়ে পড়া শিক্ষা কর্মসূচিকে অব্যাহত রাখা, শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষন এবং প্রযুক্তির বিকাশ, গবেষনা খাতের উন্নয়ন, করোনা পরবর্তীতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি আগাম প্রস্তুতি, দুর্যোগকালীন সীমিত প্রস্তুতি, গ্রামীন অর্থনীতির প্রসার, পল্লী উন্নয়নের মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে এবারের বাজেট প্রণয়নে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল আমাদের। বাজেট প্রস্তাবনাতেও সেই কথাই বলা হয়েছে গুরুত্ব সহকারে। কিন্তু বাজেট পর্যালোচনা করলে সেই প্রত্যাশার পূরণ কতটা হয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বরং প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণ মানুষকে বোকাবাক্সে ঢুকিয়ে সীমিত আকারে বোকা বানানোর চেষ্টা বেশ স্পষ্ট।
দেশের বর্তমান মোট জিডিপির পরিমান ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮’শ কোটি টাকা, গত অর্থবছরে এর পরিমান ছিল ২৮ লাখ ৫ হাজার ৭’শ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মোট ব্যয়ের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে এর পরিমান ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১’শ ৯০ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে যা ৫ লাখ ১ হাজার ৫’শ ৭৭ কোটি টাকায় গিয়ে দাড়ায় যা ছিল জিডিপির ১৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ প্রায়।
আগামী অর্থবছরে সরকার পরিচালনা সহ বিভিন্ন খাতে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮’শ ৫৫ কোটি আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি খাতে ২ লাখ ৫ হাজার ১’শ ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার পরিমান ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে এনবিআর (প্রত্যক্ষ) উৎস থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, নন-এনবিআর (পরোক্ষ) উৎস থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং করবহির্ভূত উৎস থেকে ৩৩ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে এই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল যেখানে এনবিআর (প্রত্যক্ষ) উৎস থেকে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬’শ কোটি টাকা, নন-এনবিআর (পরোক্ষ) উৎস থেকে ১৪ হাজার ৫’শ কোটি টাকা এবং করবহির্ভূত উৎস থেকে ৩৭ হাজার ৭’শ ১০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় এবারের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা মাত্র ১৯০ কোটি টাকা বেশি। গতবছর দেশের অর্থনীতিতে যখন সুবাতাস ছিল, সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির পথে চলছিল অর্থনীতি তখনই যেখানে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে হিমশিম খেতে হয়েছিল। সরকারকে বাধ্য হতে হয়েছিল বাজেট সংশোধন করে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনতে। সেখানে আজকের করোনার আপদকালীন সময়ে রাজস্ব আয়ের এই বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রা আমাদের শঙ্কিত করে বটে। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ যা বিগত অর্থবছরেও একই ছিল। অন্যদিকে গত অর্থবছরের তুলনায় দশমিক ১ শতাংশ কমিয়ে এই বছরের মূল্যস্ফিতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু দেশের এই ক্রান্তিকালীন সময়ে যা আকাশকুসুম স্বপ্ন সদৃশ মনে হয়েছে। ইতিমধ্যে বাজেট প্রস্তাবনার পরদিন শুক্রবারের অনলাইলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তাফা কামাল জানিয়েছেন টাকা কোথা থেকে আসবে সে চিন্তা তারা করেনি। তার কথা থেকে মনে হয়েছে তারা কেবল “মানুষকে বাঁচাতে হবে, কর্মসংস্থান করতে হবে, গ্রামের অর্থনীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করতে হবে” বিষয়কেই প্রধান্য দিয়েছেন। তার আবেগকে শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে কেবল আবেগ নয় আর বাস্তবতাও থাকা জরুরি। তিনি বলেছেন “অর্থ যাই লাগবে সেটা জোগাড় করা হবে” কিন্তু সেই জোগাড়ের যে খাতগুলোকে তিনি গতানুগতিকভাবে আমলে নিয়েছেন তিনি নিজেও জানেন সেই খাতগুলোও করোনার প্রাদুর্ভাবে বিপদজনক অবস্থায় আছেন। তিনি যে জেগে স্বপ্ন দেখছেন তা বেশ লক্ষনীয়। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে তিনি হাটলেন কি, প্রশ্নটা সেই জায়গাতে। বিভিন্ন খাতের বরাদ্দের দিকে তাকালেই সেই প্রশ্নই জ্বলজ্বল হয়ে উঠবে। অন্যদিকে বিশাল ঘাটতি বাজেটের চাহিদা মেটাতে সরকারকে দারস্ত হতে হবে দেশের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীন ঋণের দিকে। সহজ শর্তে কম সুদে সেই ঋণ হলে কিছুটা সময় নিলেও পুসিয়ে নিতে পারবে কিন্তু অধিক সুদে ঋণ গ্রহন করলে তার চাপ পড়বে দেশের জিডিপির উপরেই।
নতুন প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমান ১ লাখ ৯০ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও মোট জিডিপির ৬ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল বাজেটে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫’শ ১৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ ছিল। গত বছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের মোট জাতীয় বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৬ হাজার ৪’শ ২৩ কোটি টাকা এবং শতাংশের হিসেবে তা ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। অন্যদিকে ঘাটতি পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬ হাজার ৪’শ ৮৭ কোটি টাকা যা প্রস্তাবিত বাজেটের ৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। বাজেটের ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক উৎস থেকে ৮০ হাজার ১৭ কোটি টাকা, অভ্যন্তরীন উৎস থেকে ১ লাখ ৯ হাজার ৯’শ ৮৩ কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল তার বাজেট প্রস্তাবনায় অভ্যন্তরীন উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৮৪ হাজার ৯’শ ৮৩ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব রেখেছেন। গত অর্থবছর আর করোনাকালীন সময়ে নতুন অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আমি তেমন কোনো পার্থক্য দেখতে পেলাম না। যেখানে সারাবিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির উপর দাড়িয়ে অর্থমন্ত্রীর একটা মনগড়া, কাল্পনিক রাজস্ব আয় সংগ্রহের ঘোষণা আমার কাছে দিবাস্বপ্ন ছাড়া অন্যকিছুই মনে হয়নি। অন্যদিকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সরকারের ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিনিয়োগে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও কল্যাণ বার্তা নয়। দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে এই ক্রান্তিকালে সেটাও কিছুটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু এরপরেও কি দেশে মানুষের জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ন খাতগুলোতে কি পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে?
আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রস্তাবিত বাজেটে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের পূর্বেই স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অগ্রাধিকারের ঘোষণা মোটা দাগে দেয়া হয়েছে। ঘোষণা দেয়া হলেও উক্ত খাতগুলোর বরাদ্দের সাথে গত বছরের বাজেটের তুলনামূলক যৎসামান্য পার্থক্যই চোখে পড়েছে। একনজরে সেগুলো দেখে নেয়া যাক-
নতুন বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সার্বিক স্বাস্থ্যখাতে ২৯ হাজার ২’শ ৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা প্রস্তাবিত মোট জাতীয় বাজেটের ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ছিল ২৩ হাজার ৭’শ ৩২ কোটি টাকা, যা ঐ অর্থবছরের প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় প্রস্তাবিত বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ হাজার ৫’শ ১৫ কোটি টাকা, যা বিদায়ী বাজেটের শতাংশ হিসাবে মাত্র দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে কৃষিখাতে ২৯ হাজার ৯’শ ৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা মোট বাজেটের ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। বিদায়ী বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার ২৩ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ ছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে টাকার পরিমান বাড়লেও শতাংশের দিক থেকে কৃষিখাতকে বঞ্চিতই করা হয়েছে। অর্থাৎ টাকার হিসেবে বর্তমান সময়ের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এই খাতটিতে বরাদ্দ ২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা বাড়লেও, মোট বাজেটের শতাংশ হিসাবে কমেছে দশমিক ১১ শতাংশ বরাদ্দ। বর্গাজমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করা প্রান্তিক কৃষকরা কিভাবে এই বাজেটের সুবিধা পাবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা নেই। কৃষকের নিকট হতে ধান ও চাল সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে অতি সামান্য বলেই মনে হয়েছে। সার, বীজ, কীটনাশক দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ফলে এসব কিনতে কৃষককে পূর্বের মত কড়া মূল্য গুনতে হবে।
এই বাজেটে সকল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রত্যাশার বড় জায়গাটি ছিল শিক্ষাখাতে। কৃষির মত শিক্ষাখাতের বরাদ্দেও টাকার পরিমান বাড়লেও শতাংশের দিক থেকে গত অর্থবছরের তুলনায় কমেছে দশমিক ১৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা। বাজেট বড় হলে কম শতাংশেও যে বেশি টাকা বরাদ্দ হতে পারে সেটা বুঝতে রকেট সাইন্স জানা দরকার হয় না। সাধারণ মানুষ আশা করেছিল এবার অন্তত শিক্ষাখানে ১৫%-২০% বরাদ্দ দেয়া হবে। কিন্তু সেই আশার মুখে ছাঁই ঢেলে দিয়ে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৬ হাজার ৪’শ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১.৬৯ শতাংশ হবে। বিদায়ী অর্থবছরে যা ছিল ৫৯ হাজার ৩’শ ৮৭ কোটি টাকা, যা গতবারের মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ ছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৯ হাজার ৩’শ ৬০ কোটি টাকা। করোনার কারণে বন্ধ থয়ে থাকা খাত পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন বাজেট সংকোচিত করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ আরো বৃদ্ধি করা যেত। কিন্তু সেটা করা হয়নি। অন্যদিকে বাড়ানো হয়েছে ইন্টারনেট ও মোবাইলের খরচ। এতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস না করেও বেতন, সেমিস্টার ফি দেয়ার পরেও অনলাইনে ক্লাস করার জন্য শিক্ষার্থীদের চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হবে বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানীগুলোর কাছে। অন্যদিকে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের ৪৩ হাজার ১’শ ৫৬ কোটি টাকাই চলে যাবে পরিচালনা খাতে, বাকি যা থাকবে তা খরচ করা হবে উন্নয়ন খাতে। তাই শিক্ষা খাতের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অর্থের সংকট এবারেও রয়েই গেল। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী জাতীয় আয়ের নূন্যতম ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার কথা থাকলেও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কখনোই এই খাতে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা হয়নি। এবারও শিক্ষায় বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ০২ শতাংশে গিয়েই আটকে গেল। এই খাতটিকে বঞ্চিত করার পাশাপাশি সুকৌশলে এই খাতটির বরাদ্দের সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের বরাদ্দকে যুক্ত করে দিয়ে বেশি বরাদ্দ দেখিয়ে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, “বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় রেখে শিক্ষাখাতের বিভিন্ন পরিকল্পনা সাজিয়েছি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষাখাতে সম্পদ সঞ্চালনের উদ্যোগ নিয়েছি।” আমাদের জানা নেই এত অল্প বরাদ্দ দিয়ে তিনি কিভাবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় নিয়ে শিক্ষাখাতের কোন কোন পরিকল্পনা সাজিয়ে চলেছেন।
পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামোতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৪ হাজার ৫’শ ৮০ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে যা ছিল ৬৪ হাজার ৮’শ ২১ কোটি টাকা যা ঐ বাজেটের ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ ছিল। সেই হিসাবে বরাদ্দ ২’শ ৪১ কোটি টাকা কমলেও এবং শতাংশের হিসাবে বেড়েছে ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। বরাদ্দের ২ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যয় হবে পরিচালনা খাতে, বাকিটা উন্নয়ন খাতে। সারাবিশ্ব যেখানে উন্নয়নকে স্থগিত রেখে দেশের শ্রমশক্তিকে রক্ষায় নিয়োজিত, তখন আমাদের দেশে শ্রমশক্তিকে অনিরাপদ রেখে পরিবহন ও যোগাযোগের উন্নয়নে বিশাল পরিমান অর্থ বরাদ্দ রেখেছে। আমরা যে সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি সেসময় দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান গবেষনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা উপেক্ষিত হয়েছে অনেকাংশেই। স্বাস্থ্য গবেষনায় মাত্র ১০০ কোটি টাকা দিয়েই দায় সাড়া হয়েছে। বিশে^র উন্নত রাষ্ট্রগুলো যেখানে করোনা মোকাবেলায় লাখ লাখ ডলার খরচ করছে, সেখানে করোনা মোকাবেলায় আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত ১০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ যে ভাগ্যবিধাতার কাঁধে ভর দিয়ে বগল বাজানো তা কি আর বুঝতে কষ্ট হয়?
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ, যা টাকার হিসাবে ২৬ হাজার ৭’শ ৫৮ কোটি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের যা ছিল ২৬ হাজার ১’শ ৫৪ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ২১ শতাংশ। এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ ৬’শ ৪ কোটি বাড়লেও মোট বাজেটের শতাংশের হিসাবে কমেছে দশমিক ৫ শতাংশ।
দুর্যোগ, ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রমে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার ৮’শ ৩৬ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গেল অর্থবছরের যা ছিল ৯ হাজার ৮’শ ৭২ কোটি টাকা যা ঐ অর্থবছরের ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ ছিল। সেই হিসাবে এই খাতে বরাদ্দ কমেছে ৩৬ কোটি টাকা যা শতাংশের হিসাবে দাড়ায় দশমিক ২৪ শতাংশ।
সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ৯৫ হাজার ১’শ ৫৫ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ শতাংশ। পূর্বের অর্থবছরে যা ছিল ৭৪ হাজার ৩’শ ৬৭ কোটি টাকা যা ছিল ঐ বাজেটের ১৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এইখাতে কিছুটা আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটলেও বরাদ্দ বেড়েছে ২০ হাজার ৭’শ ৮৮ কোটি টাকা আর শতাংশের হিসাবে ১ দশমিক ৯২ শতাংশ। আমরা আশা করেছিলাম করোনাকালীন সময়ের বিবেচনায় কর্মহীন কিংবা স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী হতদরিদ্রদের জন্য এই খাতে জিডিপির নূন্যতম ৪ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তবে দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ নিম্ন আয়ের বা কর্মহীন মানুষের জন্য এই বরাদ্দ পর্যাপ্ত না হলেও তারা এতে টিকে থাকার যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়ার শক্তি ও সাহস পাবে কিছুটা।
স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ৩৯ হাজার ৫’শ ৭৩ কোটি যা মোট বাজেটের ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গেল অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৭ হাজার ৮’শ ৮৬ কোটি টাকা ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এই খাতে বরাদ্দ টাকার হিসাবে বেড়েছে ১ হাজার ৬’শ ৮৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের তুলনায় মোট বাজেটের শতাংশ হিসাবে কমেছে দশমিক ৫৮ শতাংশ।
জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে গত অর্থবছরের তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে। প্রতিবারের মত এবারও এই খাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, যার আওতায় রয়েছে পুলিশ, বর্ডার গার্ড, কোস্টগার্ড এবং আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। জননিরাপত্তা বিভাগের জন্য নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২২ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা, যা গতবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের সুরক্ষা বিভাগের জন্য ৩ হাজার ৮’শ ৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৯.২ শতাংশ বেশি। এছাড়াও জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতের ভেতরে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জন্য ২’শ ২৩ কোটি টাকা, আইন ও বিচার বিভাগের জন্য ১ হাজার ৭’শ ৩৯ কোটি টাকা, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের জন্য ৪০ কোটি টাকা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন প্রস্তাবিত বাজেটে।
প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৪ হাজার ৮’শ ৮২ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৬ দশমিক ১৬ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে যা ছিল ৩৩ হাজার ১’শ ৬ কোটি টাকা। বরাদ্দ বেড়েছে ১ হাজার ৭’শ ৭৬ কোটি টাকা।
বাজেটের আয় পরিকল্পনা এমন হওয়া উচিত যাতে তুলনামূলক ধনীরা অধিক হারে দায়িত্ব নেবে ও আয়কর দেবে। একইভাবে তুলনামূলক দরিদ্ররা কম দায়িত্ব নেবে। ব্যয় পরিকল্পনা এমন হওয়া উচিত যাতে বাজেটের বরাদ্দকৃত সুযোগ-সুবিধা সমাজের একবারে তলানীর হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছেও পৌছাবে। কিন্তু আমাদের দেশের বাজেট পরিকল্পনার চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে পুঁজিপতিদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে সর্বাগ্রে। ফলে বাজেট ঘোষনা পরবর্তী একটা দৃশ্য বেশ সামনে ভেসে আস্ েআর সেটা হচ্ছে- দেশের নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত অর্থনৈতিক অবস্থার মানুষেরা হতাশা বা ক্ষোভ প্রকাশ করে। বিরোধীতা করে। অন্যদিকে উদীয়মান ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, কোটি কোটি টাকার ঋণখেলাপী, পুঁজিপতি এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সেই একই বাজেটকে সাধুবাদ জানিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। এরাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে আর রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাসীনরাও এদের স্বার্থ রক্ষা করেই চলে; করোনা কিংবা ইবোলা তাতে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না, পারবে না। এবারের বাজেটে অনেক পজিটিভ দিক থাকলেও এই ব্যাপারটি আবারও সত্য প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিবারের মত এই বাজেটেও শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিশেষ কোনো আশার আলো নেই। নেই তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের আশ্বাস। রয়েছে ব্যবসায়ীদের জন্য সুখবর। কৃষিতে বর্গাচাষী, ক্ষেতমজুরদের জন্য বিশেণ সুখবর। কৃষি ঋণ প্রণোদনার মুখরোচক প্রতিবেদন থাকলেও আসল চিত্র হচ্ছে জমি যা ঋণ তার। ফলে জমিহীন প্রকৃত কৃষকরা সরকারের এই ঋণ প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হবে। কৃষি ঋনের সুযোগ-সুবিধা গিয়ে উঠবে জমির মালিকের পকেটে। স্বাস্থ্যখাতে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও গবেষনা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে নামমাত্র। ডাক্তার সহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকি ভাতা বৃদ্ধি, নিরাপদ আবাসন ও যাতায়াত ব্যবস্থার ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতা উজ্বল হয়েছে বাজেট প্রতিবেদনে। কালো টাকা সাদা করতে দেয়ার কৌশল কালো টাকার মালিকদের আরো উৎসাহিত হবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি হচ্ছে বিশাল ঘাটতি বাজেট নিয়ে তৈরী এই বাজেট বাস্তবায়ন একেই দুরহ ব্যাপার। ব্যাংক ঋণের দিকে যেভাবে ক্রমশ চাপ বাড়ছে তাতে বিনিয়োগ কমার সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, তেমনই আগামী অর্থবছরে বিশাল সুদ গুনতে হবে সরকারকে। এর থেকে বরং বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন বরাদ্দকে সংকোচন করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, বিদ্যু ও জ্বালানী, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ, গবেষনা খাতে বরাদ্দ দিয়ে ঘাটতি মেটানো কল্যানকর হতে পারতো বলে আমার ধারণা। তারপরেও যে বাজেট প্রস্তাবিত হয়েছে তা দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চলমান লুটপাট, ঘুষ, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এই বাজেট কেবল “বাজেট” শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। তাতে জনগণ যেমন উপকৃত হবে না। যে প্রেক্ষাপটের উপর এই বাজেট প্রণয়ন হয়েছে, তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। এখন দেখার বিষয় সরকার কিভাবে এই বাজেটকে বাস্তবায়ন করবে এবং কতটা সফল হবে।
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী