করোনা ভাইরাসে বিচলিত বিশ্বের অন্যতম সম্পদশীল দেশগুলো। আর দরিদ্রতম দেশগুলোর অনিশ্চয়তার সম্মুখীন কখন কি হয়? নেই পর্যাপ্ত হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্স, অক্সিজেন সিলিন্ডার, ভেন্টিলেটারসহ চিকিৎসা সামগ্রী। ফলে হতাশাগ্রস্থ মানুষ অনেকটা উপসর্গ গোপন করে নিজেদের মতো করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফলে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমনটাই অভিমত দিয়েছেন বরিশালের বিশিষ্টজনরা।
এনিয়ে জনকন্ঠের বিশেষ অনুসন্ধানে কয়েকটি পরিবারের খোঁজও মিলেছে। যারমধ্যে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ড থেকে উপসর্গ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া আবদুর বারেক (৫৫) নামের এক ব্যক্তি গত ১৪ জুন রাতে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার গুচ্ছ গ্রামের নিজ বাড়িতে মারা গেছেন।
সূত্রমতে, সম্প্রতি সময়ে করোনার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসার জন্য তিনি বরিশালের বেসরকারী রাহাত আনোয়ার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসেন। সেখানকার চিকিৎসক আবদুল বারেকের উপসর্গ দেখে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন। এরপর শেবাচিমে গেলে তার নমুনা সংগ্রহ করে করোনা ওয়ার্ডের ব্যবস্থাপত্র দেন চিকিৎসক। কিন্তু আবদুল বারেক করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি না থেকে সেখান থেকে পালিয়ে বাড়িতে চলে যায়। এদিকে করোনার উপসর্গ নিয়ে আবদুল বারেকের বাড়িতে অবস্থান এবং পালিয়ে যাবার বিষয়টি প্রকাশ পেলে মেডিকেল টিম ১৪ জুন তার বাড়িতে গিয়ে আবদুল বারেকের শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার আগেই আবদুল বারেকের মৃত্যু হয়।
স্থানীয়রা জানান, মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ও পুত্রের শরীরেও করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়ার পর মেডিকেল টিম তাদের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। সূত্রে আরও জানা গেছে, আবদুল বারেকের মতো অন্যান্য রোগীরা তাদের রোগ গোপন করে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন বরিশাল নগরীর অত্যাধুনিক বেসরকারী রাহাত আনোয়ার হাসপাতালে। আর রোগ গোপন করার কারণেই ওই হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডাঃ আনোয়ার হোসেনসহ দুইজন নার্স করোনায় আক্রান্ত হন। এরমধ্যে বরিশালের স্বনামধন্য চিকিৎসক ডাঃ আনোয়ার হোসেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ৯ জুন ভোরে মৃত্যুবরন করেছেন।
একইভাবে রোগ গোপন করে চিকিৎসা নিতে আসায় বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালসহ জেলার প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালের প্রায় আড়াই শতাধিক চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, গৌরনদী পৌর এলাকার পূর্ব কাছেমাবাদ এলাকার মুজাফ্ফর হাওলাদারের পুত্র মোঃ সুজন (৩০) কর্মস্থল ঢাকায় বসে করোনা পজেটিভ হয়। পরবর্তীতে গত পাঁচদিন পূর্বে সে ঢাকা থেকে পালিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসেন। বাড়ির কাউকে সে করোনা পজেটিভের কথা না বলায় তার বাড়ি ও পরিবারের লোকজন অবাধে চলাফেরা করতে থাকে। সুজন বাড়িতে আসার তিনদিন পর বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানতে পেরে গত ১৪ জুন সুজনদের বাড়িসহ পাশ্ববর্তী পাঁচটি বাড়ি লকডাউন করেছে। স্থানীয়রা জানান, প্রশাসনের লকডাউনকে উপেক্ষা করে ওই (সুজন) বাড়ির সদস্যরা অবাধে স্থানীয় হাট-বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে এলাকাবাসীর মধ্যেও করোনা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
সোমবার দিবাগত রাতে জেলা প্রশাসনের মিডিয়া সেল সূত্রে জানা গেছে, বরিশালে নতুন করে র্যাব ও পুলিশসহ ৫৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় ৯৭৮ জন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। পাশাপাশি জেলায় ১৩ জন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। নতুন করে আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছেন-র্যাব-৮ এ কর্মরত তিনজন, একজন সরকারি কর্মকর্তা, মেট্টোপলিটন পুলিশের ছয়জন সদস্য, রেঞ্জ পুলিশের দুইজন, বাকেরগঞ্জ ও বাবুগঞ্জে কর্মরত দুইজন পুলিশ সদস্য, শেবাচিম হাসপাতালে কর্মরত তিনজন নার্স, দুইজন স্টাফ, সদর জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত একজন চিকিৎসক ও একজন নার্সসহ বাকিরা নগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।
বাসদ’র জেলা শাখা সদস্য সচিব ডাঃ মনিষা চক্রবর্তী বলেন, বরিশালে শেবাচিমের মতো বড় একটি হাসপাতাল থাকা সত্বেও সেখানে করোনা রোগী বহন করার মতো একটি এ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়না। এমনকি বিভাগীয় শহর বরিশালে একটিমাত্র পিসিআর ল্যাব ও একটি নমুনা ল্যাব রয়েছে, যেখানে শত শত মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে নমুনা পরীক্ষার জন্য অবস্থান করে নগরীকে আরও ঝুকিপূর্ণ করে তুলছে।
তিনি আরও বলেন, বরিশালের একটি ল্যাব দিয়ে বিভাগের ছয়টি জেলার করোনার চিকিৎসা চলছে। তাই বরিশালের সকল জেলার হাসপাতালে অবিলম্বে আইসিইউ ও নমুনা বুথের সংখ্যা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনা রোগের নমুনা সংগ্রহ করতে হবে এবং পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত ও বরিশালসহ সকল হাসপাতালে করোনা রোগের চিকিৎসার জন্য আলাদা ইউনিট চালুসহ শেবাচিম হাসপাতালে ন্যুনতম একশ’ বেডের আইসিইউ চালু করা এখন জরুরি হয়ে পরেছে। বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গুরুত্বের সাথে জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করবেন বলেও তিনি আশাব্যক্ত করেন।