আমি তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে (বর্তমান চারুকলা অনষদ) মার্স্টাস প্রথম পর্বে পড়ি। নাটকের দল ‘কালিক’ থেকে স্বেচ্ছা অব্যাহতি নিয়েছি মাত্র। ঐ সময় গানের দল মন্দিরার কাজেও একটা ভাঁটা ভাব। আমাদের চারুকলার বড়ভাই শিল্পী তরুন ঘোষের সাথে বেশ মেলামেশা। যদিও তরুনদার সাথে সম্পর্ক ১৮৮৯ সালে, আমরা যখন আমাদের কয়েকজন বন্ধুর উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রার কাজ শুরু করি তখন থেকে। আমরা তখন প্রাক-ডিগ্রী ২য় বর্ষে পড়ি। ঐ বছর শোভাযাত্রাটি “আনন্দ শোভাযাত্রা” নামে পালিত হয় এবং পরবর্তী বছর থেকে “মঙ্গল শোভাযাত্রা” নাম নিয়ে বাংলাদেশসহ সারাবিশে^ খ্যাতি লাভ করে। যা ২০১৬ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ইনটেনজিবল হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই উদ্যোগের একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমাদের সম্বর্ধনা দেয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, যার অংশ হতে পেরে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি। যা হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। বিকেল বেলা চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাপচিত্র বিভাগের সামনের বারান্দায় বসে আছি একা একা, অন্য বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছি। তখন আমাদের ক্লাস হয়, নীচ তলার ছাপচিত্র বিভাগ এবং সিঁড়ির পাশের রুমটিতে এসময় তরুনদা আসলেন। ক্যামন আছেন, ভালো আছি’র পর তরুনদা জিজ্ঞেস করলেন, কি করছি। আমি জবাবে ক্লাসের কাজ করছিলাম বলে জানালাম । আবার জানতে চাইলেন,
- আমার সাথে যাবে নাকি ?
আমি জানতে চাইলাম, কোথায় ? তিনি জানালেন একটা চলচ্চিত্রের কাজে বগুড়া যাবেন, আমি চাইলে সাথে যেতে পারি,
- চল, এইখানে কি করবা, চল ঘুইরা আসি।
আমিও সাত-পাঁচ না ভেবেই বললাম,
- চলেন !
তরুনদা আবার বললেন,
- উঠো তাইলে !
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,
- মানে ?
উনি জানালেন,
- আজকে রাতেই যেতে হবে, তুমি এখনই গিয়ে তৈরী হয়ে আমার বাসায় চলে আস। কিছু কেনা কাটা আছে, একসাথে সেড়ে রওনা হবো।
আমারও যে কথা সেই কাজ, তখনই উঠে বাসায়, মানে বড় আপার বাসা শাহজাদপুরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বড় আপাকে বলে চলে আসলাম, তরুনদার ঝিগাতলার বাসায়। দুজনে চলচ্চিত্রের কাজের জন্য পানি খাওয়ার কাঁচের গ্লাস, আয়নাসহ কিছু জিনিস কেনাকাটা করে বাসায় ফিরলাম। কাহিনীর প্রয়োজনে আয়নায় কাজ করা কাঁঠের ফ্রেম এবং কাঁচের গ্লাসে ফুল লতাপাতার ডিজাইন লাগবে, কিন্তু সেরকম কোন জিনিস তখন বাজারে পাওয়া যায় না, অনেক ঘুরেফিরেও পেলাম না। তাই আমরা ফ্রেমছাড়া আয়নার উপর মাউন্ট বোর্ড কাগজে কাঠের ফ্রেমের মত করে ফ্রেম লাগিয়ে রং করে এবং কোন কারুকাজ ছাড়া কাঁচের গ্লাসে রং দিয়ে ফুল লতাপাতা এঁকে সময়োপযোগী করে নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওগুলো কিনে এনে, আমি কাগজের ফ্রেম লাগাতে থাকলাম, মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজের অভিজ্ঞতা এখানে একটা প্রত্যক্ষ কাজে লাগলো, আর তরুনদা গ্লাসে রং করতে লেগে গেলেন। হয়ে গেল আমার আক্ষরিক হাতেখড়ি, শুরু হয়ে গেল শিল্প নির্দেশনার কাজ।
আমরা রাত নয়টা পর্যন্ত কাজ করে খেয়ে দেয়ে রওনা হলাম কল্যানপুর। বগুড়ার টিকেট কেটে বাসে উঠে বসলাম। ভোর তিনটার দিকে শেরপুর গিয়ে নামলাম। ওখান থেকে লোকাল বাসে করে যেতে হবে ধুনট এর গোসাইবাড়ী, তারপর রিক্সা এবং পায়ে হেটে যমুনার চর, যেখানে আমাদের শ্যুটিং স্পট। আমরা শেরপুর নেমে শুনলাম সকাল না হওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে যাওয়ার কোন উপায় নেই। তাই আমরা ওখানকার স্থানীয় মানুষের পরামর্শে শেরপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছেই একটা আবাসিক হোটেলে গিয়ে উঠলাম বাঁকি সময়টুকু পাড় করার জন্য।
সকালে ঘুম ভেঙে দেখি তরুনদা তাঁর বিছানায় নেই। শুনলাম বাইরে কোথাও গিয়েছেন। যা হোক আমি প্রাতঃ কাজ সেড়ে হাত মুখ ধুতে ধুতেই দেখি তরুনদা চলে এসেছেন। সাথে সকালের নাস্তা, বগুড়ার দই এবং মাটির কিছু লোকশিল্প, যেগুলো সংগ্রহ করতেই ভোরবেলায় বাইরে চলে গিয়েছিলেন। এখানে বলে রাখা দরকার, তরুনদার লোকশিল্প সংগ্রহের একটা নেশা আছে। যার জন্য উনি যেখানেই যান সেখানকার লোকশিল্প খুঁজে বেড়ান। আর তাই তিনি প্রাতঃভ্রমনের ছলে লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে করে মাটির জিনিসগুলো সংগ্রহ করে এনেছেন। দুজনে মিলে সকালের নাস্তা সেড়ে লোকজনের কাছ থেকে জেনে নিয়ে লোকাল বাসে করে ধুনট পৌছালাম। লোকাল বাস মানে সে যেন আক্ষরিক অর্থেই লোকাল বাস, টিকেট কেটে এই বাসে না বসে আমরা হাটতে থাকলে এরচেয়ে আগে গিয়ে পৌছাতে পারতাম মনে হয়! এরপর রিকসায় একদম যমুনার চরের কাছে গোসাইবাড়ীতে একটা ঘাটে ছোট্ট একটা বাজারে নেমে হেটে লোকেশনে পৌছালাম। সেটাও এক অভিজ্ঞতা। আমরা যেখানে গিয়ে পৌছালাম, সেটা একটা যাত্রার প্যান্ডেল। চলচ্চিত্রটি মূলতঃ গ্রামীন মেলায় একটি যাত্রাদলের ভিতরের ঘটনার সাথে এলাকার মানুষের বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে, যা আপনারা সবাই জানেন। তাই শ্যুটিংএর জন্য যে সেট বানানো হয়েছে সেটারই একটি অংশে অভিনেতা, অভিনেত্রী ও কলাকূশলীদের থাকার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। গিয়ে পৌছাতে না পৌছাতে সিনেমার ভিতরে আরেক সিনেমার গল্প শুনতে হলো। আমাদের থাকার জন্য যে ব্যবস্থা সেখানেই আমাদের চলচ্চিত্রের নায়িকা, চিত্র নায়িকা মৌসুমীরও থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে গল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী যাত্রাদলের পরিবেশের সাথে নিজেকে খাঁপ খাইয়ে নিতে পারে। কিন্তু এলাকার মানুষ তো আর গল্পের প্রয়োজন জানেন না, মানেনও না। তাই তাঁরা বিকেল বেলা মৌসুমী পৌছানোর পরেই এমন ভীর করেন যে, যাত্রার প্যান্ডেল ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম, নিরাপত্তা রক্ষীরা রীতিমত হিমশীম খাচ্ছেন। এলাকার মানুষও নাছোড় বান্দা, নায়িকাকে না দেখে যাবেন না। এক পর্যায়ে ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক আর ভুলবশতঃই হোক প্যান্ডেলে আগুন ধরে যায়। অনেক কষ্টে সবার আন্তরিক চেষ্টায় আগুন নেভানো হয়। এসব নিয়ে ব্যাস্ততার মাঝে নায়িকা বোরখা পড়ে তাঁর মাকে নিয়ে কখন প্যান্ডেল থেকে বের হয়ে গিয়েছেন, কেউ টেরই পেলেন না। এরপর যখন একটু স্থীর হয়ে সবাই নায়িকার খোঁজ করলেন, ততক্ষণে তিনি ঢাকার পথে রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। ঐ দিন বিকেল থেকে ক্যামেরা ওপেন হওয়ার কথা থাকলেও এ পরিস্থিতিতে সে সম্ভাবনা আর থাকলো না। আমরা তারমধ্যেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। প্রপস হিসেবে আমাদের বানানো এবং সংগৃহিত সরঞ্জামাদি দেখে অভিনেতা মামুন ভাই (মামুনুর রশীদ) বলে ফেললেন,
- তরুন তো এবার পুতুল নিয়েই ছাড়বে মনে হয় ......!
চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কারের জন্য যে ক্রেস্ট দেয়া হয়, তাকে মজা করে এ জগতের সবাই পুতুল বলে থাকে। অভিনেতা, আবৃত্তিকার জয়ন্ত দা (জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়) অবশ্য এজন্য কৃতিত্ব নিতে চাইলেন,
- ওকে তো আমিই ঠিক করে দিলাম, মামুন ভাই !
এরমধ্যে ঢাকায় ফোন করে নতুন নায়িকা খোঁজ করতে বলা হলো, যেন কাজে কোন অসুবিধা না হয়। কারন অনেকগুলো মানুষের সময় মিলিয়ে একটি চলচ্চিত্রের সময়সূচী ঠিক করা হয়। যার একদিন, দুইদিন নষ্ট হলে তা মেলানো খুব কঠিন হয়ে যায়। ঐ সময় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিনেত্রী নায়লা আজাদ নূপুর ঢাকায় অবস্থান করছিলেন, যিনি এই সিনেমার গল্প নিয়ে নাট্যদল ‘ঢাকা থিয়েটার’ এর মঞ্চায়িত নাটকে ঐ চরিত্রটিতে নিয়মিত অভিনেত্রী সূবর্ণা মোস্তফার পাশাপাশি বিকল্প চরিত্র হিসেবে অভিনয় করতেন। আমাদের চলচ্চিত্রের আরেক অভিনেতা পাভেল ভাইয়ের (পাভেল আজাদ) মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে তাঁকে ফোন করে তাঁর সাথে যোগাযোগ করে ঐ রাতেই রওনা করিয়ে সকালের মধ্যে লোকেশনে নিয়ে আসা হলো। রাতে ঘুমাতে গিয়ে হলো আরেক মজার অভিজ্ঞতা। প্যান্ডেলের ভিতর চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে আলাদা আলাদা কক্ষ বানানো হয়েছে। একটিতে তরুনদা, সহকারী পরিচালক আতিক (নূরুল আলম আতিক), সহকারী পরিচালক সামির (সামির আহমেদ), সহকারী পরিচালক জয়ন্ত (জয়ন্ত সরকার), স্থিরচিত্রের জন্য টুকু ভাই (টুকু খন্দকার), মেকআপ আর্টিস্ট ও আমিসহ কয়েকজন। পাশেরটিতে অভিনেতা মামুন ভাই, জয়ন্তদা, আসাদ ভাই (রাইসুল ইসলাম আসাদ), পাভেল ভাইসহ কয়েকজন। আসাদ ভাই কাজের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। লোকেশনে যাওয়ার পর থেকেই উনি উনার চরিত্র, গ্রামের কৃষকের পোষাক লুঙ্গি, হাতাওয়ালা কোড়া গেঞ্জি, গামছা ও শার্ট, সেটাও কখনও কাঁধে - কখনও গাঁয়ে পরে সাধারণ মানুষের সাথে মিলে মিশে চলাফেরা করতে লাগলেন প্রথম দিন থেকেই। রাতের বেলা চরের সুনসান পরিবেশে ঘুমাতে গিয়ে গান গাইতে শুরু করলেন। আসাদ ভাই চমৎকার গান করেন, চলচ্চিত্রে চরিত্রের ভিতরও গান ছিল যা উনি নিজেই গাইবেন। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছি, ভালোও লাগছিল ওরকম একটা পরিবেশে। এপাশ থেকে তরুনদা আমাকে বলতে লাগলেন,
- তুমিও একটা ধরো, মিঠু ....
- আসাদ ভাই যে মনোযোগ দিয়ে গাইছেন, যদি রাগ করেন ?
- আরে কিছু বলবেন না, ধরো একটা ......
আমাদের কক্ষের সবাই সমর্থন দিলেন, আমিও সাহস করে ধরলাম একটা। ওপাশ থেকে আসাদ ভাইয়ের আরেকটা, আবার এপাশ থেকে আমার আরেকটা। এভাবে পালাক্রমে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আসাদ ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
- কে গায়?
- এসিস্টেন্ট আর্ট ডিরেক্টর মিঠু ..... আসাদ ভাই ....
- বাহ, বেশ গায় তো!
ঐ রাতের জন্য গান শেষ হলো, ঘুমাতে হবে তাই। কিন্তু যে কয়দিন ছিলাম, রাতে শোয়ার পর ওপাশ থেকে আসাদ ভাই ডেকে উঠতো,
- মিঠু ....
- বলেন, আসাদ ভাই .....
- গান ধরো .....
তারপর আমি একটা, উনি একটা এভাবে চলতে থাকতো ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। এখানে কথাটি বলার লোভটি সম্বরণ করতে পারলাম না। চলচ্চিত্রের জন্য আসাদ ভাই একটি গান নির্বাচন করে নিয়মিত চর্চ্চা করে যাচ্ছিলেন। আশির দশকের বাংলা সিনেমার একটি গান, গানটি চলচ্চিত্রের সময় উপযোগী না বলে আমার কাছে মনে হলো। এদিকে আসাদ ভাই অভিজ্ঞ মানুষ, ভয়ও লাগছে বলতে গেলে কিছু মনে করে কিনা! আমি সাহস করে বলে ফেললাম। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং আমাকে প্রশংসা করে আগেই ব্যাপারটি জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানালেন। তারপর একটা গুরু-দ্বায়িত্ব দিলেন বিকল্প গানটি আমাকেই নির্বাচন করে দেয়ার জন্য। আমার তখন আর কোন গানই আর মাথায় আসছে না, আমি শুধু উনাকে শচীন দেব বর্মনের যে কোন একটা গান বেছে নিতে বললাম। উনিই গান নির্বাচন করলেন, আমি সমর্থন করলাম। ঐ গানটিই পরে উনি গেয়েছিলেন চলচ্চিত্রে।
পরের দিন বিকেল থেকে আমাদের শ্যুটিং শুরু হয়। প্রথম দিনের কাজ ছিল ঘোড়ার গাড়িতে করে রাস্তা থেকে চরের ভিতর যাত্রা প্যান্ডেলে যাত্রাদলের সবার আসার দৃশ্য গ্রহণ। ঘোড়ার গাড়ি সকাল বেলায়ই চলে আসলো। তরুনদার নির্দেশমত দুজনে মিলে ঘোড়ার গাড়ির ছই, চাঁকাসহ গাড়ির কাঠামো ও যাত্রাদলের লোকদের সঙ্গে আনা টিনের ট্রাংকে কারুকাজ এবং নকশা করে কাহিনীর সময়োপযোগী করা হলো। অনেক কষ্ট করে সময় নিয়ে দৃশ্যটি ধারণ করতে হলো। কারন মূল রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে চরের বালির উপর লোকজন ও তাদের মালামালসহ গাড়ি টানতে গিয়ে ঘোড়ার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। গাড়ি থেকে নেমে প্যান্ডেলের গেইটে অপেক্ষমান যাত্রাদলের অধিকারী (মামুন ভাই) এর সাথে কথোপকথন শেষে ওখান থেকে যাত্রা প্যান্ডেলের ভিতরে ঢোকা পর্যন্ত শ্যুটিং করে ঐ দিনের কাজ শেষ হলো। পরের দিন যাত্রা প্যান্ডেলের পিছনে নদীর ধারে আধা-ডুবা নৌকার উপরে জয়ন্তদা আর নূপুরদির একটা দৃশ্য শ্যুটিং হলো। এই দৃশ্যে আমাদের করার তেমন কিছু ছিল না নৌকাটাকে আগে থেকেই তৈরী ছিল দৃশ্যায়নের আগে শুধু জায়গামতো রাখা হলো। এছাড়া স্থানীয় কিছু শিল্পীর সাথে আসাদ ভাই, মামুন ভাইদের সাথে প্যান্ডেলের বাইরে বিভিন্ন জায়গার কিছু দৃশ্যায়ন করা হলো। বগুড়ার ময়না ভাই (তৌফিক হাসান ময়না), সিরাজগঞ্জের একজন (নামটি মনে নেই এই মূহুর্তে) সহ অনেকের সাথে পরিচয় হলো। পিছনে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মানুষদের মেলার আঙ্গিনায় প্রবেশের দৃশ্য, যারা বিভিন্ন লোকশিল্প নিয়ে আসছে। এই প্রপ্স্গুলো শ্যুটিং এর আগে তৈরী করে দিতে হলো আমাকে। তার একজন হলো বেলুনওয়ালা, যে তিনকোনা একটা বাঁশের ফ্রেমের সাথে বিভিন্ন রকম এবং রংএর বেলুন লাগিয়ে চরের আঁকা-বাঁকা, উচু-নীচু পথ দিয়ে হেটে আসবে, সামনে ময়না মূল অভিনেতাদের। এই জিনিসটা আতিক আমাকে নিয়ে পাসিং শট দিতে বলল, আমি তো ক্যামেরার সামনে যাবনা তার উপর আমি ট্রাউজার পরে আছি। আমি প্রডাকশনের কাউকে পাঠাতে বললাম। একটা চাদর সংগ্রহ করে আতিক অনেকটা জোঁড় করেই আমাকে পাঠালো। ওর যুক্তি আমি হাটলে শটটি নিতে বেগ পেতে হবেনা, শট ‘এনজি’, মানে বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে যেতে হলো। ঐ সময় আমার মাথায় কাঁধ ছাড়িয়ে পিঠ পর্যন্ত ঝাকরা চুল, মুখভর্তি দাড়ি। গ্রামের মানুষ হিসেবে এই গেট আপ এ টি শার্ট, ট্রাউজার পরে কিভাবে শট দেব ভাবছি। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাড়িয়ে আছি আর ভাবছি। পরিচালক আবু সাইয়ীদ ভাই সামনের মূল চরিত্রের সবাইকে শট বুঝিয়ে দিচ্ছেন তো দিচ্ছেনই। আমি দূর থেকে বুঝতে পারছি কি হচ্ছে। আমি তখন কঠিন ধূমপায়ী, কাজ ছাড়া দাড়িয়ে থাকা মানেই আমার হাতে থাকবে সিগারেট। আমি কিছুক্ষন অপেক্ষার পর যথারীতি সিগারেট জ¦ালিয়ে টানছি। এমন সময় আতিক ঈশারা করলো হাটার জন্য। আমি চাদর দিয়ে চুল দাড়ি ঢেকে সিগারেটটা যেহেতু কেবলই জ¦ালিয়েছি, তাই ফেলে না দিয়ে হাতের ভিতরের দিকে নিয়ে যেভাবে গ্রামের মানুষ ছোট হয়ে যাওয়া বিড়ি টানে সেভাবে সিগারেট টানতে টানতে একটু কুজো হয়ে হাটতে লাগলাম। আমাকে যেহেতু রাস্তা দেখিয়ে দেয়া হয়নি, আমি একটু ঘুর পথ ধরে ধরেই হাটছি আর ভাবছি আবার বোধ হয় শট দিতে হবে, আবার হাটতে হবে! আমি তখনও জানিনা শট ঠিক আছে কিনা। জানতে চাইলাম আমি কি করব, ঈশারা পেলাম চলে আসার, মানে শট ওকে। ওদিকে যাত্রা প্যান্ডেলের অলঙ্করনের কিছু টুকিটাকি কাজ বাকি ছিল, ওগুলো দেখে এবং মেলার জন্য কোথায় কোন দোকান, মেলার অফিস কোথায় বসবে ওগুলো মিস্ত্রি এবং আমাকে বাকি কয়েকদিনের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তরুনদা রাতে ঢাকায় চলে আসলেন। আমরা আরেক দিন শ্যুটিং করলাম। মেলার আঙ্গিনায় চা-মিষ্টিসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদির দোকান, পাশাপাশি আতিক, সামির, জয়ন্ত, টুকুভাই, কোলকাতা থেকে আসা সিনেমাটোগ্রাফার সমিরন দা, তার সহকারী হিসেবে অপু দা (এল অপু রোজারিও), মামুনভাই, জয়ন্তদা, আসাদভাইসহ এলাকার কিছু লোকজন থাকায় চারুকলার মোল্লা ভাইয়ের দোকানের পরিবেশেই আছি মনে হতো। এর মধ্যে ঢাকা থেকে হাবিবুর রহমান মধু ভাইয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করে চারজন যাত্রার নৃত্যশিল্পি দীপালী রানী সরকার, ঝর্ণা রানী, মনি দাস, রানী দাসসহ কয়েকজন যাত্রাশিল্পি এবং যাত্রার যন্ত্রীদল এসে আমাদের দলে যোগ দিল। ওদের সাথে গান নিয়ে কিছুক্ষন আড্ডা হলো, একটা গান নির্বাচন করতে হবে যার সাথে আমাদের গল্পের নায়িকা যাত্রাদলের নায়িকা হিসেবে যাত্রার চার নৃত্যশিল্পিসহ নাচবে। ওদের গলা খুব সুন্দর কিন্তু এত চড়া সুরে গান করছিল যে, তার সাথে আমরা অনেক চেষ্টা করেও গলা মেলাতে পারছিলাম না। পরের রাতে যাত্রামঞ্চে নাচের দৃশ্যসহ কিছু দৃশ্যের এবং প্যান্ডেলের গ্রীনরুমের দৃশ্যায়ন হবে। মঞ্চ মোটামুটি তৈরীই ছিল,শুধু সংগ্রহ করে আনা যাত্রার ঐতিহ্য হ্যাজাক জ¦ালিয়ে দিতে হবে। আমাকে বলা হলো যাত্রার লোকদের সাথে কথা বলে ওদের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রীনরুমের পরিবেশ তৈরী করতে। আমি যাত্রাদলের ভিতরের বেশ কিছু ব্যাপার জানলাম, যা আগে জানতাম না। যেমন ওদের মেয়েরা যেখানে মেক-আপ নেয়, সেখানে শুধু মেয়েদেরই প্রবেশাধিকার থাকে, ওদের কোন কিছু লাগলে দলে অপ্রাপ্ত বয়স্ক নির্দিষ্ট যে ছেলে থাকে সেই একমাত্র ঐ কক্ষের কাছাকাছি যেতে পারবে। সেও বাইরের পর্দার আঁড়াল থেকে শুধুমাত্র ভিতরে হাত ঢুকিয়ে জিনিসটি দিতে পারবে। আরেকটি ব্যাপার আমাকে স্পর্শ করে। প্রত্যেক শিল্পী ভিতর থেকে উচ্চস্বরে ধরে, তাঁদের সংলাপ বলতে বলতে মঞ্চে প্রবেশ করেন লম্বা একটি প্যাসেজের মত সিঁড়ি দিয়ে। এটা জানতাম, আমার মনে হয় আপনারাও সবাই জানেন। কিন্ত ঢোকার আগে একটি বেদীতে প্রণামের ভঙ্গিতে ছুয়ে তারপর সংলাপ বলা শুরু করে, যা মসজিদের গম্বুজ এবং পূজার বেদীর আকৃতির একটি মিশেল রূপ। সকল ধর্ম, বর্ণ, মত নির্বিশেষে সবাই এই একই কাজ করে, যারমধ্যে কোন ধর্মীয় ব্যাপার নেই, আছে সাংস্কৃতিক আচার, আছে ভক্তি। রাতে দর্শকের উপস্থিতিতে মঞ্চে নূপুরদি এবং যাত্রাদলের পালাসহ নাচের সাথে গান দৃশ্যায়িত হলো।
সবাই মিলে মিশে কাজ করছিলাম, যে কারনে মন খারাপ করার সুযোগ পাইনি, বেশ আনন্দেই কাটাচ্ছিলাম। বাঁধ সাধলো ঝড়। হঠাৎ একরাতে ঝড় উঠলো, উন্মত্ত যমুনার তীরের গাছপালাহীন চরে তৈরী মেলাসহ যাত্রা প্যান্ডেলে। মনে হচ্ছিল যেন মাথার উপর থেকে সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যাহোক ঝড় থেমে গেল, যেরকম আচমকা এসেছিল তেমনই হঠাৎ করেই। ত্রিপলের ছাদ টিকে গেল ঠিকই কিন্তু ঝড়ের পর বিপত্তি ঘটালো বৃষ্টি। বৃষ্টির পানিতে আমাদের বিছানাপত্র, কাঁপড়- চোঁপড়, সাথে আমাদের শিল্প নির্দেশনা বিভাগের তিনটি ট্রাঙ্ক, যা বেশীরভাগই কাগজের তৈরী সরঞ্জামাদিতে ভরা ভিজিয়ে দিতে লাগল। বৃষ্টির পানি একবার একদিক দিয়ে পরে, আমরা জিনিসপত্র, ট্রাঙ্ক নিয়ে অন্যদিকে সরে যাই। আবার এইদিকে পানি পরে আমরা ঐদিকে যাই। এভাবে সবাই জিনিসপত্রসহ ভিজে আমাদের সবার অবস্থা খুবই খারাপ। সবারই মেজাজ খারাপ, রাতের ঘুমের বারটা। যে যার মত করে বহিঃপ্রকাশ করল নিজেদের মনের অবস্থা। আমার অবস্থা আরও শোচনীয়, আমাদের বেশীর ভাগ জিনিসপত্র ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা (আতিক, সামির, জয়ন্ত, টুকুভাইসহ আমি) এ অবস্থায় কাজ করে যাওয়া সম্ভব না জানিয়ে দিলাম, একটু কড়া ভাষায়ই বাক্য বিনিময় হলো সাইয়ীদ ভাইয়ের সাথে। উনি চুপচাপ শুনে গেলেন এবং মন খারাপ করে তার ব্যবস্থাপনার দূর্বলতার কথা স্বীকার করে নিলেন এবং জানালেন, যে কোন সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি, সে অধিকার আমাদের আছে। আমরা সোজাসাপ্টাভাবে পরের দিন সকালে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সাইয়ীদ ভাইকে জানিয়ে দিলাম, উনিও মেনে নিলেন কোন কথা না বলে। আমরা ঘুমাতে গেলাম।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল, নাস্তা করে আমাদের কক্ষের সবাই চায়ের দোকানে গিয়ে চা খাচ্ছি একসাথে। ওদের কেউ একজন আমাকে জিঙ্গেস করলো, আমি কি করব। আমি অবাক হয়ে বললাম, নতুন করে কি বলার আছে, যা সিদ্ধান্ত নেয়ার তা তো রাতেই হয়ে গেছে। তখন ওরা জানালো, ওরা ওদের সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে এসেছে। কারন, এ পরিস্থিতিতে পরিচালককে বিপদে ফেলে ওরা যেতে চায় না। পরে অবশ্য জেনেছিলাম আতিক এবং তরুনদা অনেকদিন খেটেখুটে এই চলচ্চিত্রের পরিকল্পনা এবং চিত্রনাট্য করেন, যা অর্থের অভাবে শুরু করেতে পারছিলেন না, তখন সাইয়ীদ ভাই ওদের প্রস্তাব দেন তিনি চলচ্চিত্রটি করতে চান। সিদ্ধান্ত হয় ওদের সবাইকে সাথে নিয়েই কাজটি করবেন তিনি। এতে করে অনেক দিনের পরিশ্রমের ফসল হিসেবে চলচ্চিত্রটি আলোর মুখ দেখবে, আবার নিজেদের চলচ্চিত্র বানানোর ইচ্ছারও শুরু হবে। আর তাই তৈরী হওয়া পরিস্থিতিতে আতিকের স্বপ্ন পূরণের স্বার্থেই ওরা সবাই নিজেদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। আমি আগের সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে না এসে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা জানালাম। আতিক রাস্তায় লাগতে পারে ভেবে আমাকে পাঁচশত টাকা হাতে দিলেন, ওটাই আমার চলচ্চিত্র জগতে প্রথম এবং ঐ কাজের একমাত্র পারিশ্রমিক। ওটা পরিচালক বা প্রযোজক দিয়েছিলেন, নাকি আতিক নিজের কাছ থেকে দিয়েছিলেন তাও জানা হয়নি।
নূপুর আপা, অভিনেতা কামাল আহ্মেদ এবং প্রডাকশন ম্যানেজার বাবুল শরীফ ঢাকায় আসবে, আমি ওদের সাথে মাইক্রোবাসে উঠে বসলাম। গাড়িতে বসে নূপুর আপার সাথে বিস্তারিত আলাপ পরিচয় হলো। উনি প্রথম জানলেন যে আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে মাস্টারস করছি এবং এই চলচ্চিত্রের সাথে সহকারী শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ করছিলাম। এর আগে উনার সাথে আমার কথা হয়, মেক-আপ রুমে। মেক-আপের পর ওনার পায়ে আলতা লাগাতে হবে, মেক-আপ আর্টিস্ট শফীক ভাই (শফীকুল ইসলাম) যাত্রাশিল্পীদের মেক-আপ নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় আমি আলতা লাগিয়ে দিয়েছিলাম ওনার হাতে পায়ে। এ জন্য ওনি ভেবেছিলেন আমি মেক-আপ আর্টিস্ট এর সহকারী। আমার চলে আসার কারন জানতে চাইলে আমি জানালাম, যারা একটি চলচ্চিত্রকে স্বার্থক করে তুলতে এর পেছনে শ্রম দেবে তাদের এবং পরিশ্রম করে বানানো ও সংগৃহিত জিনিসপত্রের যত্ম যারা নিতে না পারেন তাদের সাথে কাজ করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। উনি সমর্থন করলেন আমার কথা।
আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম তরুনদাকে আমার ফিরে আসার কথা। উনি আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন। আমার পরিবর্তে চন্দন কে (শফিকুল কবির চন্দন) নিয়ে পরের দিন লোকেশনে চলে গেলেন এবং চন্দনকে সাথে নিয়েই বাকি কাজ শেষ করেছিলেন। এখানে বলে রাখা ভালো, তরুনদা জাতীয় জাদুঘরে চাকুরী করার কারনে প্রচন্ড ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও কখনো নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্রের কাজ করতে পারেননি।
চলচ্চিত্রটি আমাদের শিল্প নির্দেশনা বিভাগসহ এগার(১১)টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তঃর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারসহ সাফল্যের সাথে প্রদর্শিত হয়েছে। তরুনদা প্রথম কাজেই তার প্রথম এবং এখন পর্যন্ত (২৩ এপ্রিল, ২০২০ খ্রীস্টাব্দ) একমাত্র জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। উনি পরে ঐ পুরস্কার এবং মেডেল দেখিয়ে আমাকে বলেছিলেন, সহকারীদেরও আলাদা করে পুরস্কার থাকা উচিৎ। আরো বলেছিলেন মেডেলে নাম লেখা না থাকলে ওটা সহকারীদের দিয়ে দিতেন তিনি। এ চলচ্চিত্রটিতে সরাসরি আমার পুরস্কার না পাওয়া হলেও আমার শিল্প নির্দেশনা বিভাগ পুরস্কার পাওয়াতে এবং তরুনদার মুখে আমাদের স্বীকৃতি পেয়েই আমি তৃপ্ত হলাম। যদিও আমি কাজটি শেষ করে আসতে পারিনি, মাত্র কয়েকদিন কাজ করেছিলাম, তারপরও প্রথম প্রেমের মত আমার জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রটি আমার কাছে অনেকটুকু জায়গা দখল করে আছে। এই কাজটি করতে গিয়ে আমার শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ করার ইচ্ছা এবং রাস্তা দুটোই পেয়ে গেলাম। যার ফলশ্রুতিতে আমি আমার জীবনে বেশ কয়েকজন গুণি পরিচালক ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পেয়েছি, অনেকগুলো ভালো চলচ্চিত্র নির্মানের সাথে একজন কুশলী হিসেবে সংযুক্ত থাকতে পেরেছি এবং আজও কাজ করে যাচ্ছি বলে আমি সবসময় নিজেকে ধন্য মনে করি।
লেখক পরিচিতি :
শহীদ আহ্মেদ মিঠু
সহকারী অধ্যাপক,
নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউট, নারায়ণগঞ্জ।
চারুশিল্পী, শিল্প নির্দেশক, সংগঠক, ইউনেস্কো কর্তৃক ইনটেনজিবল হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃত “মঙ্গল শোভাযাত্রা” র উদ্যোক্তা।