‘চারপাহে পানি পেডত ভোক’ বন্যাকবলিত কুঁড়িগ্রামের রমলা বিবির কণ্ঠে এভাবেই ঝরে পড়ে ক্ষুধা। তার দিনের পর দিন অভুক্ত থাকা মলিন হাহাকার ঢেউ তুলে চতুর্দিকের বন্যার পানিতে। রমলা বিবির মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ পানিবন্দি।
প্রতি বছর আমাদের দেশে বর্ষাকাল এলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বন্যা দেখা দেয়। জলবায়ুর প্রভাব আর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে বন্যাপ্রবণ দেশ। তবে ২০২০ সালে করোনা ক্রান্তিলগ্নে প্রথম আম্ফান আর এখন বন্যায় অচল হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। প্রতিদিনই নিত্য-নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে আর পানিবন্দি হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। এসব মানুষ তাদের বসতবাড়ি আর সম্পদ হারিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে বাঁধের ওপর উঁচু স্থানে কিংবা খোলা আকাশের নিচে কোনো সড়কের পাশে। সবকিছু হারিয়ে এসব বানভাসি মানুষ এখন অসহায় হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। গত এক সপ্তাহ পানির প্রভাব বাড়ছে আর একেকটি করে বাঁধ ভাঙছে।
১৯৭১ এ স্বাধীনতার পর থেকে বন্যার কাছে বার বার আমরা হয়েছি পরাজিত। ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যা থেকে শিক্ষা নিতে ভুলে যাই আমরা। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ হওয়ায়, গত কয়েকদিন যাবৎ অতিবৃষ্টি জনিত উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এতে দেশের শাখা প্রশাখাসহ ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ বর্গকিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অতিবৃষ্টি ও নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে দেশের কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। কুড়িগ্রাম, জামালপুর, বগুড়া,সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ি, মুন্সিগঞ্জ ও চাঁদপুর জেলার মোট ১৬টি নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে প্রবল বৃষ্টিপাত এবং পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ হতে প্রবাহিত পানি বৃদ্ধি পায়। ফলে বিভিন্ন নদ-নদী পানিতে ভরপুর হয়ে নদীর তীর, বাঁধ সমূহে ভাঙন দেখা দেয় এবং মানুষ, ঘর-বাড়ি, গবাদিপশুসহ আরো অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। আর চলতি বছরও এর ব্যাতিক্রম নয়। একই বন্যা পরিস্থিতি লক্ষণীয় ২০২০ সালেও।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ১৫টি জেলার ৬৭টি উপজেলা প্লাবিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। এ পরিসংখ্যান অনুসারে প্রায় ৩ লক্ষ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যাপীড়িত এসকল এলাকার মানুষের দুর্দশার বাস্তব চিত্র পরিসংখ্যানে আনা হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন: বন্যা, নদীভাঙন, পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, অগ্নিকান্ড ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে মানবিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে চলতি বছরের জুলাই মাসে ত্রাণ কার্যে দশহাজার নয়শত (১০,৯০০) মেট্রিকটন চাল ও নগদ এক কোটি তিয়াত্তর লক্ষ (১,৭৩,০০,০০০/-) টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। পারত পক্ষে, এই বরাদ্দকৃত পরিসংখ্যান শুনলে আনন্দ লাগে। মনে হয়, যাক বন্যাকবলিত মুখগুলো কোনরকমে খেয়ে পরে বেঁচে তো আছে। কিন্তু একটু সচেতন ভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, বন্যাকবলিত জনপ্রতি বরাদ্দ মাত্র ৮.৬৫টাকা অর্থাৎ প্রায় ৯টাকা!! না, অবস্থা এর চেয়েও করুণ! পরিসংখ্যান অনুযায়ী জামালপুরে ১৫০ মেট্রিকটন চাল ও ২৫০,০০০ টাকা, সিরাজগঞ্জে ২০০ মেট্রিকটন চাল ও ৩,০০,০০০ টাকা, বগুড়ায় ২০০ মেট্রিকটন চাল ও ৩,০০,০০০ টাকা, মানিকগঞ্জে ১৫০ মেট্রিকটন চাল ও ২৫০,০০০ টাকা, মাদারিপুরে ১০০ মেট্রিকটন চাল ও ২,০০,০০০ টাকা, রংপুরে ২০০ মেট্রিকটন চাল ও ৩,০০,০০০ টাকা, সিলেটে ২০০ মেট্রিকটন চাল ও ৩,০০,০০০ টাকা, সুনামগঞ্জে ২০০ মেট্রিকটন চাল ও ৩,০০,০০০ টাকা, গাইাবান্ধায় ১৫০ মেট্রিকটন চাল ও ২৫০,০০০ টাকা, টাঙ্গাইলে ২০০ মেট্রিকটন চাল ও ৩,০০,০০০ টাকা, ফরিদপুরে ২০০ মেট্রিকটন চাল ও ৩,০০,০০০ টাকা, লালমনিরহাটে ১৫০ মেট্রিকটন চাল ও ২৫০,০০০ টাকা, রাজবাড়িতে ১৫০ মেট্রিকটন চাল ও ২৫০,০০০ টাকা, কুড়িগ্রামে ২০০ মেট্রিকটন চাল ও ৩,০০,০০০ টাকা, নীলফামারীতে ১৫০ মেট্রিকটন চাল ও ২৫০,০০০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মূলত বন্যাকবলিত ১৫টি জেলায় নগদ অর্থ বাবদ মূল বরাদ্দ একচল্লিশ লক্ষ (৪১,০০,০০০/-) টাকা! যা মাথাপিছু মাত্র ২টাকা! এবার আসা যাক চালের হিসাবে।
১৫টি বন্যাকবলিত জেলায় মোট বরাদ্দকৃত ত্রাণ (চাল) ২৫০০ মেট্রিকটন। ১মেট্রিক টন= ১০১৬ কেজি। সেই হিসাবে মোট ২৬,৪১,৬০০ কেজি চাল। তাহলে বিশ লক্ষ মানুষের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ১.৩২ কেজি অর্থাৎ মাত্র দেড় কেজি চাল। তাহলে, মোট বরাদ্দকৃত অর্থ ১৭৩,০০,০০০ টাকার ৪১,০০,০০০ টাকা যদি ১৫টি বন্যাকবলিত জেলায় বরাদ্দ হয় তবে বাকি ১,৩৩,০০,০০০টাকা গেলো কোথায়? তাহলে, উত্তর হলো, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গত জুলাই মাসের ৪তারিখে কেবল ১৫টি জেলায় নয়, সমগ্র বাংলাদেশের সকল অর্থাৎ ৬৪টি জেলায়
ত্রাণ (চাল) ও নগদ অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। এই প্রণোদনা অ, ই এবং বিশেষ শ্রেণির মাঝে বন্টনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আপনি হয়তো ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে তাকাবেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, যেখানে গত ৪জুন তারিখে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাও ত্রাণ মন্ত্রনালয় কর্তৃক গৃহীত মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সমগ্র বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলায় নগদ বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ৯১,১৩,৭২,২৬৪ (একানব্বই কোটি তেরো লক্ষ বায়াত্তর হাজার দুইশত চৌষট্টি) টাকা এবং শিশু খাদ্য ক্রয় বাবদ অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ ২৫,৫৪,০০,০০০ (পঁচিশ কোটি চুয়ান্ন লক্ষ) টাকা। তাহলে, একমাসের ব্যবধানে সকল জেলায় অর্থ বরাদ্দের পরিবর্তে বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে শুকনা খাবার, ত্রাণ (চাল, ডাল প্রভৃতি) এবং নগদ অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে প্রকৃত অর্থে মানুষের পাশে দাঁড়ানো হতো বলে আমি মনে করি। তাহলে তো আর শুনতে হোত না বানবাসি মানুষের আফসোস-- ‘বানত ভাসি যাই, কাউয়ো এলাও হামার খবর নেইল না বা।"
ত্রাণ বলতে যা বোঝায় মূলত বন্যা প্লাবিত এলাকায় তা হলো শুকনো খাবার। চলতি বছরে ১৫টি দুর্যোগপূর্ণ জেলায় শুকনো খাবার পৌঁছেছে মাত্র প্রায় ২৬ হাজার প্যাকেট। বিশ লক্ষ বানভাসি মানুষের ক্ষুধা নিবারণে এই পরিমাণ শুকনো খাবার কতটুকু পর্যাপ্ত। ত্রাণই নয়, বন্যাকবলিত এলাকায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা হলো বিশুদ্ধ পানি। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। পানি থেকে নিজেকে আর তার সম্পদ গবাদিপশুকে বাঁচাতে উঁচু জায়গা প্রয়োজন। প্রয়োজন স্যানিটেশন ব্যবস্থারও। বিভিন্ন এলাকার আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো পানির নিচে রয়েছে। পানিবন্দি দুর্গত মানুষের খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গো খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। দ্রুতগতিতে পানি বাড়লেও কমছে খুবই ধীর গতিতে, ফলে বন্যার্তদের মধ্যে দুর্ভোগ বাড়ছে। সুতরাং সবার ত্রাণের প্রয়োজন আছে এমনটাও না। তবে বেশিরভাগ মানুষেরই ত্রাণের প্রয়োজন কিন্তু যে পরিমাণ ত্রাণের প্রয়োজন সে পরিমাণ ত্রাণ এখনো সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি। লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করলেও নেই সরকারি পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা। অপরদিকে, বেসরকারি এনজিও সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে এখনো কোনো ত্রাণের তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি। আর মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসা মানুষের দেয়া ত্রাণ আর সরকারি বরাদ্দ ত্রাণ দিয়ে কিছু হচ্ছে না এসব অঞ্চলের লোকদের অর্থাৎ ত্রাণের অপ্রতুলতা থেকেই যাচ্ছে কেননা এক একটি গ্রামে বন্যার্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় কয়েক হাজার এবং এরা পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে দিনের পর দিন। কিন্তু ত্রাণের সাহায্য যা আসছে তা সত্যিই অপ্রতুল। কেননা, করোনার করালঘাতে সবাই কম বেশি জর্জরিত। এমতাবস্থায়, ব্যক্তিগত সহযোগিতা সত্যিই কষ্টসাধ্য। তবুও বাংলাদেশের মানুষ সহনশীল। দুর্যোগে সবাই সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চায়। আবার সরকারের পক্ষ থেকে যে পরিমাণ ত্রাণ কিংবা আর্থিক সাহায্য আসছে তা যথাযথভাবে প্রদান করা হচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার।
এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কৃষি বিভাগ। হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। আগে ভাগেই পানি আসায় ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। বিশেষ করে অর্থকরী ফসল পাট ও আখের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। পাট, আমনের বীজতলা, আউশ ধান, সবজিসহ অন্তত কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে চিকিৎসা সংকট। বেড়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বন্যা দুর্গতরা স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে পড়েছে চরম দুর্ভোগে। বিশেষ করে নারী, শিশু-কিশোরী ও বৃদ্ধদের অবস্থা খুবই নাজুক। তাদের এ অবস্থা দেখে মনে কষ্ট হয়। প্রশ্ন জাগে উত্তরবঙ্গসহ এসব অঞ্চলের মানুষগুলো কি শুধু বছরের পর বছর বন্যার ঢেউয়ে ঘুরপাক খেতেই থাকবে?
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। তাই কেবল ত্রাণ দিয়েই হাত মুছে ফেলাটা সমাধান নয়। প্রয়োজন বাস্তবিক রূপকল্পের। স্বাধীনতার পর থেকে দফায় দফায় সরকার পরিবর্তন হলেও উত্তরাঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণে কেউ কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যদিও দেশে উন্নয়নের বুলি শোনানো হয়েছে বহুবার। কিন্তু রাস্তাঘাট আর ব্রিজ কালভার্ট আর কয়েকটা ফ্লাইওভার নির্মাণ করাকেই যে উন্নয়ন বলা হয় তা সহজেই অনুমেয়। এত উন্নয়ন সত্ত্বেও কেন দেশ ডুবছে পানিতে, কেন পানিতেই কবর দিতে হচ্ছে বানভাসি মৃতদের তা আজ বিবেকের কাছে প্রশ্ন।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, প্রতি বছর বাংলাদেশে বন্যায় ফসলি জমি প্রায় ১৯০ কিলোমিটার জমি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদীতে চলে যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় তার চাইতে বেশি ক্ষতি হয় প্রতি বছর সৃষ্ট বন্যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বন্যাসহ দুর্যোগে প্রতি বছর ৫৭০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুতরাং বন্যা নিয়ন্ত্রণে এবং এ ধরনের ক্ষতি এড়াতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অবশ্যই হাতে নিতে হবে।
বাংলাদেশের প্রধান নদ নদী হচ্ছে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র। এদের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে উজানে চীন ও ভারত। উজানে বৃষ্টি হলে দ্রুতই এসব নদ নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। বর্তমান বর্ষা মৌসুমের প্রথমভাগে অবস্থান করছি আমরা। এ সময়টাতে ভারত ও বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সে কারণে খুব সহসাই পানি কমে না। বরং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে চলতি বন্যা। আর পানি বৃদ্ধি পেলে বন্যা আরও চরম আকার ধারণ করার পাশাপাশি জন দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
বন্যায় সবচেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করেন তিস্তা পাড়ের মানুষ। ধেয়ে আসা উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। জন্মলগ্ন থেকে খনন না করায় প্রতিবছরের বন্যায় পলি পড়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়েছে। তলদেশ ভরাট হওয়া উজানের সামান্য ঢেউয়ে তিস্তার দুই কুল উপচে বন্যার সৃষ্টি হয়। প্রতিবছরের বন্যায় পলি পড়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়েছে। ফলে পানি প্রবাহের পথ না পেয়ে উভয় তীরে বন্যার সৃষ্টি হয়ে ফসল ও সম্পদের ক্ষতিসাধন হচ্ছে। উজানে পানি প্রবাহ কমে গেলে এ অঞ্চলে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। তলদেশ ভরাট হওয়ায় গতিপথ না পেয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে তিস্তার পানি। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন তিস্তার তীরবর্তী মানুষ।বন্যা আর খরার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ফসল ও পরিবার পরিজনকে বাঁচাতে তিস্তা নদী খনন করে উভয় পাড়ে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। খনন করে বাঁধ নির্মাণ হলে ভাঙন, বন্যা আর খরা থেকে ফসল, সম্পদ ও জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি তিস্তার পানি ব্যবহার করে কৃষির আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে দাবি স্থানীয়দের। বন্যার আঘাত একটু প্রকট হলেই ঝুঁকিতে পড়ে সলেডি স্প্যার বাঁধসহ সব বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বেশি ঝুঁকিতে পড়ে গ্রামের বালুর বাঁধ। নদীর ভাঙন ও প্লাবন থেকে বাঁচতে বাধ নির্মাণ করা হলেও তা আমাদের কোনো কাজেই আসে না।
ধলেশ্বরী নদীতে ১৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন মাস আগে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। বেড়িবাঁধটি মূলত ঘোনাপাড়াসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাকে ধলেশ্বরী নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করার জন্য নির্মাণ করা হয়। অথচ তিন মাস আগে বাঁধ নির্মিত হলেও তা এলাকাবাসীর কোনো উপকারে এলো না। গত কয়েক দিনে ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্মিত বেড়িবাঁধ ভেঙে বেশ কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ভাঙন থেকে রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর তীর সংরক্ষণে সিসি ব্লক ও জিওবি ব্যাগ ফেললেও বিআইডব্লিউটিএ’র অপরিকল্পিত নদী ড্রেজিংয়ের ফলে সিসি ব্লকের নিচে ফাঁকা হয়ে ধসে যাচ্ছে। ফলে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করছে।
সরকারিভাবে বরাদ্দ চেয়ে ব্যর্থ হয়ে অনেক অঞ্চলেই স্থানীয়রা নিজেদের উদ্যোগে দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করেন। ফলে বন্যা ও ভাঙন থেকে রক্ষা পায় কয়েক হাজার পরিবার, বিদ্যালয়সহ নানান সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো সেই বাঁধ ভাঙনের মুখে পড়লে এটি রক্ষায় কিছু জিও ব্যাগের দাবি জানালেও যখন সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়না, তখন সত্যিই বলতে ইচ্ছা হয়, উন্নয়নের জোয়ারে ভাসে দেশ অথচ বন্যার জোয়ারে মানুষ ভাসমান।
নদী খনন ও শুষ্ক মৌসুমে পরিকল্পিতভাবে সংস্কার কাজ না করাসহ ওয়াপদা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির জন্য তাদের এমন অনাকাঙ্কিত দুর্ভোগ বলে মনে করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। বছর বছর ভেঙে যাওয়া নদীতীর রক্ষা বাঁধগুলোর সংস্কার করা কিংবা স্থায়ীভাবে বাঁধের কাজ না করায় তাদের এই চরম খেসারত দিতে হচ্ছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নদ-নদীর পানি উপচে বন্যার পদধ্বনি কেবল নয়, এমন পরিস্থিতি আমাদের জন্য দুর্ভাবনার। সামনে ভয়াবহ বন্যার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে তা আমলে নিয়েই সরকারের এখন থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। যদিও বলা হয়ে থাকে, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়ানো আমাদের সাধ্যাধীন নয় তবে যথাযথ প্রস্তুতি নিলে মানুষের দুর্ভোগ, ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চয়ই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। নদী ভরাট হওয়ার কারণে যেমন বেড়েছে ভাঙন, তেমনি সামান্য ঢলে দুকূল উপচে আকস্মিক বন্যা ঘটায়। নদ-নদীর নাব্য রক্ষা করে একদিকে যেমন বন্যার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তেমনি সম্ভব ভাঙন ঠেকানো। গণমাধ্যম বলছে - ড্রেজিং নিয়ে সরকারের ‘মহাপরিকল্পনা’ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? বন্যার সময় বাঁধ একটা বড় আশ্রয়স্থল। যেভাবে বাঁধ ভাঙছে, তাতে সব বাঁধকে এখন নিরাপদ আশ্রয় মনে করা যাচ্ছে না। তারপর রয়েছে খাদ্য সংকট। নতুনপ্রজন্মের রাজনীতিক, শিক্ষা সাহিত্যিক সাংস্কৃতিককর্মী হিসেবে আমি আশা করছি, বন্যার্তদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা দেয়ার সংস্থান করবে সরকার। বিশুদ্ধ পানি, ওষুধপত্র এবং চিকিৎসাসেবাও প্রস্তুত রাখা দরকার। সরকার ও প্রশাসন এ বিষয়ে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিবে- এটাই চাওয়া।
বন্যার সময়কে বন্যা-পূর্ববর্তী, বন্যাকালীন ও বন্যা-পরবর্তী সময় বিবেচনায় নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। বন্যা-পূর্ববর্তী সময়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচিত ভারত, নেপাল ও চীনে এবং দেশে বৃষ্টিপাতের স্থায়ীত্বকাল ও পরিমাণ সম্পর্কে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্রকে অবহিত করা। বন্যা সতর্কীকরণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্রের বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির বিষয়ে কমপক্ষে পাঁচদিন আগে সতর্ক বার্তা দেয়া। আবহাওয়া অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করার জন্য উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক করা প্রয়োজন। পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তা সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে অবহিত করা এবং প্রয়োজনে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়য় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়ার আহ্বান জানানো। একই সঙ্গে সরকারিভাবে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সংস্থান করা। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখাসহ বাঁধগুলো সংরক্ষণে কার্যকর প্রস্তুতি নেয়া।
দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমে দেখেছি- দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পুরস্কার পেয়েছেন। সুতরাং বন্যার্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও দুর্যোগ মোকাবেলায় টেকসই সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি। অন্যথায় তার এই অর্জন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়া সত্ত্বেও নদীগুলোর দূষণরোধ কিংবা ভরাটরোধে নেই কোনো তৎপরতা। আর এসব কর্মকান্ড যারা পরিচালনা করে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও নেই কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা। সরকার কেবল সড়ক পথেই উন্নতিসাধন করছে কিন্তু নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় নদীগুলোর প্রতি সরকারের উদাসীনতা বারবার পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের এসব বন্যার স্থায়ী কোনো সমাধান না হলে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সর্বোপরি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এরা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। আবার বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে অবশ্যই এসব এলাকার বীজ, ক্ষেত-খামার ও ফসলি জমি প্রভৃতিকে রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় এসব অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-কষ্ট কখনোই লাঘব হবে না।
দেশের ভাগ্যোন্নয়নে তথা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম পাশাপাশি চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এতে উন্নয়ন টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। নতুবা ছোট ছোট পরিসরে গড়ে ওঠা বিপদ একদিন বিশাল ও দানবীয় রূপ নিয়ে আমাদের গ্রাস করতে পারে। আর বছরের পর বছর বন্যাকবলিত মানুষের কান্না ঘুরপাক খেতে থাকবে
‘বানত মরি গেইলং বাহে, বানত মরি গেইলং’
শান্তা ফারজানা : সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি এবং সভাপতি, জাতীয় শিক্ষাধারা