দেশের যে কোনো বিমানবন্দর ব্যবহার করে কোথাও গেলেই বাড়তি ফি গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। বিমানবন্দরের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নতুন ফি আরোপ করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এই বাড়তি ফি বিমান ভ্রমণে যাত্রীদের কতটা নিরুৎসাহিত করবে এ নিয়ে এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই সংশয় দেখা দিয়েছে।
যে কোন দেশের বিমানবন্দর একটি স্পর্শকাতর এলাকা। বিমানবন্দর দেশের একটি অহঙ্কার। কাজেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে এর আগেও নানা প্রশ্ন উঠেছিল। সেই প্রশ্ন যে অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে একাধিকবার। চার ধাপের নিরাপত্তার মধ্যেও পাসপোর্ট- বোর্ডিং পাস না থাকা অস্ত্রধারী যুবক কিভাবে বিমানে উঠে- এমন প্রশ্নও ছিল দেশজুড়ে। বিমানবন্দরে প্রবেশ করার পর প্রথমে স্ক্যানিং, বোডিং পাস, ইমিগ্রেশন এবং সর্বশেষ বিমানে ওঠার সময় চেকআপ করা হয়। প্রতিটি জায়গায় বডি ও লাগেজ চেকআপ করা হয়। বিশেষ করে সর্বশেষ চেকআপে জুতা, বেল্ট, ঘড়ি, মানিব্যাগ, বডি- এগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়। বিমানে প্রবেশ করার গেটে বোর্ডিং দেখিয়ে সিটে বসতে হয়। অথচ একটি যুবক খেলনা পিস্তল নিয়ে বিমানে উঠে বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। বিমানবন্দরে নিয়োজিত ১৯টি সংস্থার যারা কর্তব্যে নিয়োজিত, তারা কী জবাব দেবেন? এর আগে প্রধানমন্ত্রীর বিমানের নাটবল্টু ঢিলা রাখা নিয়ে ভিভিআইপি নিরাপত্তার বিষয়টি দেশ-বিদেশে আলোচনায় উঠে আসে। এছাড়া পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পোশাক পরে এক যুবক বিমানবন্দরে ঢুকে এক যাত্রীকে ছুরিকাঘাত করে। এসব বিষয়গুলো নিয়ে আগেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে বেবিচক। এরমধ্যে নিরাপত্তার নামে অতিরিক্ত চার্জ সাধারণ যাত্রীদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এমনটাই স্বাভাবিক। তবে, বর্ধিত হার আরোপের আগে বেবিচকের অভ্যান্তরিন নিরাপত্তার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো সতর্ক করা যেতো। উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় দৃশ্যমান আরো কিছু কাজ করা হলে বর্ধিত ফি’তে যাত্রীদের মধ্যে নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়ত না, এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক।
যদিও আকাশপথে নিরাপত্তায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গ্যানাইজেশনের (আইসিএও) বিশ্বব্যাপী ইউনিভার্সেল ওভারসাইট সেফটি অডিট প্রোগ্রাম এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানিয়েছে আগেই। আইসএও-এর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটটি পরিমিতির পাঁচটিতেই কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়নে বৈশ্বিক গড় স্কোর পেতে ব্যর্থ হয়েছে ভারত। যে আটটি বিষয়ের ওপর বিমান নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করা হয় তা হলো- লাইসেন্স, অপারেশন, ব্যবস্থাপনা, প্রতিষ্ঠান, বিমান পরিচালনার যোগ্যতা, বিমান পরিভ্রমণ সেবা, বিমানবন্দর ও দুর্ঘটনার তদন্ত।
এ বিষয়গুলো কতটা নিরাপদ এবং বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো কার্যকর কিনা সে বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই ওই নিরীক্ষা পরিচালনা করা হয়। আইসিএওর মানদ-ে ওই আটটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠির কার্যকর বাস্তবায়নে ভারতের থেকে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। আটটি প্যারামিটারের মধ্যে সাতটিতেই ভারতের চেয়ে ভালো স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া সবগুলো ক্ষেত্রেই ভারতের চেয়ে ভালো অবস্থান অর্জন করেছে। অপরদিকে পাঁচটি প্যারামিটারে ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আছে মালয়েশিয়া।
বর্তমান সময়কে বিশ^ব্যাপী একটি সঙ্কটময় সময় হিসেবে দেখছে। কারণ কোভিড-১৯ সারা বিশে^র অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। এই সময়ে মানুষ জমানো অর্থ রক্ষায় সামান্য অর্থেও হিসেব কষছে কঠিনভাবে। অস্থির এই সময়ে খরচ বাড়ল আকাশপথের ভ্রমণে। দেশের যে কোনো বিমানবন্দর ব্যবহার করে কোথাও গেলেই বাড়তি ফি গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। বিমানবন্দরের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নতুন ফি আরোপ করা হয়েছে বলে বেবিচকের দাবী। উড়োজাহাজের টিকিটের সঙ্গে ভ্যাট বাবদ এ ফি কেটে নেওয়া হচ্ছে। গত জুলাইয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এ সংক্রান্ত নোটিশ জারি করেছিল। এ বাড়তি ফি বিমান ভ্রমণে যাত্রীদের কিছুটা হলেও নিরুৎসাহিত করবে বলে মনে করছেন এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্টরা।
বেবিচকের দেওয়া তথ্য মতে, যারা ১৬ আগস্টের টিকিট ইতোমধ্যে কেটেছেন, তাদের বর্ধিত ফি পরিশোধ করতে হয়েছে। বেবিচক বলছে, সার্কভুক্ত দেশগুলোতে যাওয়া যাত্রীদের প্রতি টিকিটের জন্য উন্নয়ন ফি হিসেবে ৫ ডলার ও নিরাপত্তা ফি হিসেবে ৬ ডলার করে দিতে হয়। আন্তর্জাতিক গন্তব্যে প্রতি টিকিটে ১০ ডলার করে বাড়তি ফি দিতে হয়। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারীদের প্রতি টিকিটের জন্য উন্নয়ন ফি দিতে হয় ১০০ টাকা ও নিরাপত্তা ফি ৭০ টাকা। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীদের খরচ বাড়ল ১৭০ টাকা। বেবিচকের এক নোটিশে বলা হয়, যাত্রীদের ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এটিই নতুন আরোপিত সর্বাধিক ফি। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সুত্র জানায়, দেশের যেকোনো বিমানবন্দর দিয়ে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি পাঁচ ডলার এবং নিরাপত্তা ফি ছয় ডলার দিতে হবে। আবার দেশে ফিরে আসার ক্ষেত্রেও সমপরিমাণ অর্থ দিতে হবে। অন্যদিকে সার্কভুক্ত দেশের বাইরে ভিন্ন কোনো দেশে গেলে যাওয়া এবং আসার ক্ষেত্রে একজন যাত্রীকে ৪০ ডলার দিতে হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের বিমান বন্দরগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতি বছর প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা খরচ হয়। দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে উন্নয়নমূলক কাজ চলছে- একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিচালনা ব্যয় মেটানোর জন্যই এ ফি ধার্য করা হয়েছে। ধার্যকৃত ফি থেকে সরকার প্রতিবছর ৬০০ কোটি টাকার মতো পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের উত্তরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ফি নেবার প্রচলন আছে বলে দাবি করেন সিনিয়র সচিব মহিবুল হক। তিনি বলেন, এই রিজিওনের ভেতরে আমরা সবচেয়ে বিলম্বে এটা কার্যকর করতে যাচ্ছি এবং সবচেয়ে কম অর্থ আমরা নিতে যাচ্ছি।
অপরদিকে এটমোস্ফিয়ার রিসার্চ গ্রুপের মতে ২০২৩ সালের আগে বিমান ভ্রমণ স্বাভাবিক নাও হতে পারে। কারণ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। এই মারণ ভাইরাস ঠেকাতে শহরের পর শহরে লকডাউন চলছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় অচল। বিমান চলাচল প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। কখন থেকে আবার চালু হবে স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সেই ব্যাপারে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বলা হচ্ছে, ২০২৩ সালের আগে বিমান ভ্রমণ বা বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক নাও হতে পারে।
বৈশ্বিক ভ্রমণবিষয়ক বিশেষজ্ঞ গ্রুপ এটমোস্ফিয়ার রিসার্চ গ্রুপের তথ্য মতে, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে; এরকম ঘোষণা করার পরও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে আরো টানা দুই বছর সময় লাগতে পারে। অর্থাৎ ২০২৩ সাল নাগাদ বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে। তাদের মতে, যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত ফিরে আসার পরিবর্তে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে। অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ব্যবস্থা চালু হবে সবার আগে।
বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সংবাদ বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ঘাটতি, ফ্লাডলাইট ও দুর্বল সিসিটিভি ক্যামেরার কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন (কেপিআই) জরিপ দলের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত বছরের শেষ দিকে গোয়েন্দা সংস্থা, সিভিল এভিয়েশন এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত এই দলটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরিপ চালায়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে ওই জরিপের প্রতিবেদন জমা দেন তারা। গত বছরের এপ্রিল মাসে একই ধরনের আরও একটি জরিপ চালানো হয়েছিল। ওই জরিপে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল তার সামান্য অংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে জরিপ দলটি জানিয়েছে। সবশেষে একটাই মন্তব্য, অতিরিক্ত ফি নিয়ে হলেও বিমানের মানউন্নয়ন ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সক্ষম হলে হয়ত সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে তৈরি হওয়া নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ি নাও হতে পারে।
লেখক : এম. শাহজাহান সাংবাদিক