বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্কের এক সোনালী অধ্যায় চলছে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ভি মুরালিধরন। সম্প্রতি সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক সম্মেলনের আয়োজন করে কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই)। সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ভি. মুরালিধরন বলেন, ২০১৪ সাল থেকে দুই দেশের সম্পর্কের খুব উন্নয়ন ঘটেছে। এই সময় থেকে দুই দেশের স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে, সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে, কানেক্টিভিটি চুক্তি সই হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করছে। দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় চলছে, যা আরও শক্তিশালী হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা সফর করতে এসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। অপরদিকে, হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার ঢাকা সফরকে একটা ব্রেকথ্রু হিসেবে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
এ বিষয়ে মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, করোনার সময় যেহেতু বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই কোনো দেশেরই। সেটার একটা ব্রেকথ্রু হিসেবে আমরা দেখছি এই ভিজিটটাকে। স্বয়ং মোদিজি এবং ফরেন মিনিস্টারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই এখানে এসেছেন তিনি এবং করোনার সময় ওনারও প্রথম সফর এটি। উনি আমাকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দিল্লিতে যাওয়ার জন্য। জয়েন কনসালট্যান্ট কমিটির মিটিং হবে, তার আগেই হয়তো আমি একবার যাব।
যদিও এই সফর নিয়ে ঢাকার ভারতীয় মিশন কয়েক লাইনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিলেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করতে ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা এগিয়ে নিতে দুই দিনের সফরে ঢাকা এসেছেন। আর ঢাকা পৌঁছে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সাংবাদিকদের বলেন, উন্নয়নের জন্য দুইদেশ একসঙ্গে অনেক কাজ করছে, সামনের দিনগুলোতে আরও কাজ করবে। দুইদেশের সম্পর্কে কোনো টানাপোড়েন নেই, উল্লেখ করে শ্রিংলা বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় চলছে। এই সম্পর্ক বহমান থাকবে এবং আগামীতে আরও শক্তিশালী হবে, যাতে উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।
যদিও কভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে শ্রিংলার ঢাকা সফর নিয়ে নানা রকম গুঞ্জন ছিল। সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছিল যে- তিনি দিল্লির বিশেষ বার্তা পৌঁছে দিতেই দুদিনে সফরে এসেছেন। কী সেই বার্তা?- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, ওনারা (ভারত) বাংলাদেশকে এতটাই গুরুত্ব দিচ্ছে যে, উনি এই বার্তা নিয়ে এসেছেন যে, এই পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে ওনারা সম্পর্কটা উন্নত করতে চান।
এই সফর নিয়ে ভারতীয় দৈনিক আজকালের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- বাংলাদেশে বিমান বন্দর তৈরিতে সহযোগিতার কথা আগেই ঘোষিত হয়েছিল। এবার তিস্তার ওপর সেচ প্রকল্পেও ১০০ কোটি মার্কিন ডলার সাহায্য করছে চীন। এরপর আর চুপ করে বসে থাকতে পারেনি দিল্লি।
এর আগে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিস্তার জল নিয়ে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদি। কিন্তু এখনও তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। তার অন্যতম কারণ মমতা ব্যানার্জি। তিনি নিজের রাজ্যের মানুষের স্বার্থে আঘাত করে জল দিতে রাজি নন। তাঁর কারণেই ২০১১ সালেও দুই দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি সই হয়নি। এবার এই বিষয়টি নিয়েই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের খবর, সেকারণেই তিস্তার ওপর সেচ প্রকল্প নির্মাণে চীনের হাত ধরেছে ঢাকা। বাংলাদেশ-ভারত যুগ্ম নদী কমিশনের একমাত্র সদস্য মাহমুদুর রহমান জানিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি এখনও বিশ বাঁও জলে। এভাবে আর বসে থাকতে চাইছে না ঢাকা।
তাছাড়া মোদি সরকার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাশের পর দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা তিক্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। কিন্তু যেভাবে কিছু বিজেপি নেতা বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের কুকথা বলেছেন, তাতে চটেছে ঢাকা। তাই দিল্লির থেকে মুখ ফিরিয়ে বেজিংয়ের দিকে ঝুঁকেছে হাসিনা সরকার। এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে ভারত। বাংলাদেশও নেপালের পথ যাতে না ধরে, তাই তড়িঘড়ি ঢাকায় বৈঠকে দুই দেশ।
ভারতের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার লিখেছে, প্রায় হঠাৎই দু’দিনের ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করলেন ভারতের বিদেশসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনার রিভা গঙ্গোপাধ্যায় দাশ জানান, দু’দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে দিল্লির বিশেষ বার্তা নিয়ে এসেছেন বিদেশসচিব।
ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে শ্রিংলার বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের রিভা বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিশেষ ও নিবিড় সম্পর্ক। এই কারণে মহামারির মধ্যে আন-অফিশিয়াল সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বিদেশসচিব। তিনি আরও জানান, শ্রিংলার সফরকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধুবাদ জানিয়েছেন। করোনা-পরবর্তী সময়ে দু’দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহযোগিতা জোরদার করা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে ভারতের। গত বছরে নাগরিকত্ব আইন বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকে কেন্দ্র করে বিজেপি নেতাদের মন্তব্য ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছিল। এখন লাদাখে চিন-ভারত স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। আর পুরনো সুসম্পর্কের জেরে বাংলাদেশের ওপরে ক্রমাগত প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে চিন। ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তি আটকে রয়েছে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার জলস্তর ধরে রাখার প্রকল্পে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে চিন। করোনার সম্ভাব্য টিকার তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা বাংলাদেশে চালানোর ছাড়পত্রও চিন পেয়েছে। এ দিকে, পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি শেখ হাসিনাকে ফোন করে করোনা ও বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, ঢাকার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় ইসলামাবাদ।
সম্প্রতি বাংলাদেশকে ১০টি রেল ইঞ্জিন দিয়েছে ভারত। কিন্তু বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ইঞ্জিনগুলি পুরনো। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেছিলেন, এমন ক্ষতিকর কাহিনিগুলো একই জায়গা থেকে উঠে আসছে। এই আবহেই শ্রিংলার সফর।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জি ২৪ ঘণ্টা লিখেছে, তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে নয়া দিল্লি ও ঢাকার দড়ি টানাটানি নতুন কিছু নয়। আর তারই মাঝে সেই তিস্তা প্রকল্পেই সম্প্রতি ঢাকাকে বিপুল পরিমাণ সাহায্যের ঘোষণা করেছে বেজিং। এমন আবহেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলি ঝালিয়ে নিতে ও সামগ্রিক পরিস্থিতির আঁচ পেতেই এই ঝটিতি সফর বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
দ্য হিন্দু লিখেছে, একদিকে বাংলাদেশে মেগা প্রকল্পে চীনের বিশাল বিনিয়োগ, অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ- এসব ইস্যুকে সামনে রেখে ঢাকা সফর করছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। দ্য হিন্দুতে তিস্তা নির্ভর সেচ বা কৃষি প্রকল্পে চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার সহায়তা পেতে যাচ্ছে ঢাকা এ খবর দেয়া হয়েছে। শিরোনামের মধ্যেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে- তিস্তা প্রকল্প চীনের বিনিয়োগকে টার্গেট করে বাংলাদেশে আসছেন শ্রিংলা। কল্লোল ভট্টাচার্য লিখেছেন, তিস্তায় সেচ প্রকল্পে চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলারের সহায়তা পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে পানিবন্টন বিষয়ক সমঝোতার কেন্দ্রে রয়েছে এই তিস্তা। এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গ্রীষ্ম মৌসুমে তিস্তায় পানির লেভেল আশানুরূপ পর্যায়ে রাখতে সহায়ক হবে।
ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়েও দুদেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ভারতের সীমান্তে প্রতিবন্ধকতা তৈরির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশ নিজ সীমান্তে সকল প্রতিবন্ধকতা তুলে নিলেও ভারত তা বন্ধ করে রেখেছে।
যদিও, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। দুই দেশের মানুষে মানুষে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। সে কারণেই বারবার হোঁচট খেলেও এই বন্ধন কখনো ছিন্ন হয় না। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আজ সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা ছিল, সেগুলোর বেশির ভাগেরই সমাধান হয়েছে। আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বাকি সমস্যাগুলোরও দ্রুত সমাধান হবে বলে আশা করা যায়। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ ও ভারতের এই সম্পর্ক উত্তরোত্তর আরো শক্তিশালী হবে এবং উভয় দেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এগিয়ে যাবে। শুধু দ্বিপক্ষীয় নয়, নেপাল, ভুটানকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার যে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তাও ক্রমে আরো বিস্তৃত হবে। আমরা চাই, প্রতিবেশী দুই দেশ আঞ্চলিক উন্নয়ন, শান্তি ও স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে আরো ঘনিষ্ঠভাবে এগিয়ে যাক।
লেখক : এম. শাহজাহান, সাংবাদিক