সরকার দেশজুড়ে গ্রামীণ পর্যায়ে সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকারমূলক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর তা বাস্তবায়ন করছে। ওই প্রকল্পের আওতায় ৮শ’ ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এক লাখ ৩৭ হাজার টিউবওয়েল স্থাপন করা হচ্ছে। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ওসব টিউবওয়েল বিতরণ করার কথা রয়েছে। তবে অভিযোগ উঠেছে প্রকল্পের আওতায় বেশির ভাগ টিউবওয়েল জনপ্রতিনিধিদের কর্মীদের বাড়িতেই স্থাপন হয়েছে। আর দরিদ্র জনগোষ্ঠী সেখান থেকে বঞ্চিত রয়েছে। কারণ টিউবওয়েলগুলো জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে। ৬৪টি জেলার ২৭৮টি নির্বাচনী এলাকায় টিউবওয়েলগুলো বিতরণের কাজ চলছে। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারাদেশে গ্রামীণ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের মাধ্যমে পানিবাহিত এবং পানি সংক্রান্ত রোগ হ্রাস করে গ্রামীণ জনগণের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখাই প্রকল্পের লক্ষ্য। নিরাপদ পানির উৎস স্থাপনের মাধ্যমে পল্লী এলাকায় পানি সরবরাহের আওতা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক ক্ষয়-ক্ষতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য সমস্যার সময় পানি সরবরাহ বজায় রাখাই মূল উদ্দেশ্য। তাছাড়া প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত জনসাধারণের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। নিরাপদ পানি সরবরাহের মাধ্যমে ডায়রিয়া ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগ হ্রাস করা। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে অগভীর নলকূপ ও গভীর নলকূপ।
সূত্র জানায়, জাতীয় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন নীতিমালা ১৯৯৮ অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে নলকূপের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি নলকূপের জন্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০৫ থেকে ৫০ জনে মধ্যে নিয়ে আসা। নীতিমালা অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে নলকূপের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিটি নলকূপের জন্য বর্তমান ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮৭ থেকে ৫০ জনে আনাই হচ্ছে বড় কাজ। কিন্তু বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে নিরাপদ পানি সরবরাহ কভারেজ বৃদ্ধি অত্যন্ত কঠিন। কারণ বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্যতা (ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠস্থ উভয়ই) দিন দিন কমে আসছে। আর্সেনিক ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি ভূ-গর্ভস্থ পানি দূষিত করছে। তাছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে অগভীর একুইফার (ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তর) এলাকায় লবণাক্ততা, দুর্গম অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাওয়া, কিছু কিছু এলাকায় কোন ধরনের পানির উৎস স্থাপন সম্ভব না হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। ওসব কারণে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আদর্শ লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তার সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পানির বর্ধিত চাহিদার বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতেই বিপুল পরিমাণ পানি সরবরাহের প্রয়োজন। আর গ্রামীণ জনগণের শহরে অভিবাসন ও দ্রুত নগরায়ণে প্রয়োজনীয়তাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে নীতিমালার নির্ধারিত মানদ- অর্জন করতে বড় পরিসরে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। ২০১৭ সালে পিএন্ডসি বিভাগ ও ডিপিএইচইর হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে চালু নলকূপের সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪৬০টি। এই অবস্থায় প্রতি ৫০ জনের জন্য একটি নলকূপ ভাগে পড়েনি। পড়েছে দেড় থেকে ২শ’ মানুষের ভাগে। ফলে গ্রামীণ জনপদের মানুষের পানির অভাব থেকেই যাচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, প্রকল্পটি নিয়ে গত দুই বছরে নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের তদন্তে শুরুতেই প্রকল্পের কেনাকাটায় বড় ধরনের অনিয়ম বেরিয়ে এসেছে। প্রকৃত অর্থে যারা টিউবওয়েল পাওয়ার যোগ্য তারা কেউ পায়নি। বরং ধনী মানুষেরা পেয়েছে। এমনও হয়েছে যে, এক ব্যক্তি একাধিক নলকূপ হাতিয়ে নিয়েছে। ফলে কোথাও কোথাও সাধারণ সরকারি নলকূপ থেকে পানি নিতে গিয়ে গালমন্দ শুনতে হয় এবং সরকারি নলকূপ থেকে পানি নিতে বাধাও পেতে হচ্ছে। শুধু তাই না, মূলত প্রকল্প থেকে বড় অংকের অর্থ নয়-ছয়ের বিষয়টি মাঠপর্যায় থেকে শুরু হয়েছে। ওই অর্থের একটি অংশ প্রকল্পের কতিপয় কর্মকর্তাও হাতিয়েছে। যদিও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, এক একটি নলকূপ নিতে আড়াই হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা সরকারের ফান্ডে জমা দিতে হচ্ছে। ওই টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয়। সেখানে অনিয়ম করার কোন সুযোগ নেই।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের অগ্রাধিকারমূলক গ্রামীণ পানি সরবরাহ প্রকল্পের পিডি মোহাম্মদ হানিফ জানান, ২০১৮ সালে হাতে নেয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে এক লাখ ৩৭ হাজার অগভীর ও গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ গত জুনে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু করোনার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মেয়াদ বাড়লেও টাকা বাড়েনি। এই প্রকল্পে প্রতি উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে কতগুলো নলকূপ বসানো হবে তা নির্ধারণ করা আছে। আর নির্ধারিত সংখ্যা অনুযায়ী সারাদেশে নলকূপগুলো ভাগ করে দেয়া হয়েছে। সেখানে মন্ত্রী-এমপি সুপারিশ করলেও একটি নলকূপ বাড়ানো সম্ভব না। ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজ শতকরা ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। ৬৪ জেলার ২৭৮টি নির্বাচনী এলাকায় প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে। আর আগামী ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে।