প্রত্যাবাসন না হলেও ক্যাম্প থেকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা উধাও হয়ে যচ্ছে। আর প্রতিদিনই বাড়ছে এ সংখ্যা। ইতিমধ্যে গত ৩ বছরে ক্যাম্প থেকে ২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উধাও হয়ে গেছে। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে ওই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয় । মিয়ানমারের রাখাইনে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সহিংস ঘটনার পর ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)। তাদের সর্বশেষ হিসাবমতে ৩৪টি ক্যাম্পে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৫ হাজার ৮২২ জন। ওই হিসাবের মধ্যে রয়েছে ১৯৯১ সালে আসা ৩৪ হাজার রোহিঙ্গাও। বাকি ২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কোথায় গেছে তা কারোরই জানা নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে ওসব রোহিঙ্গা লোকালয়ে মিশে যাচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে তারা ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং আইএসসিজি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এ বছর এক হাজার ৫৮ মিলিয়ন ডলার আন্তর্জাতিক সাহায্য চাওয়া হয়েছে ৮ লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার জন্য। কিন্তু বছরের আট মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মিলেছে মাত্র ৪০৯ মিলিয়ন ডলার। যা চাহিদার মাত্র ৩৯ শতাংশ। তার আগে ২০১৯ সালে প্রত্যাশিত ৯২১ মিলিয়ন ডলারের ক্ষেত্রে মিলেছিল চাহিদার মাত্র ৬৯ শতাংশ বা ৬৩৫ মিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর হিসাব মতে, ক্যাম্পে যে হারে রোহিঙ্গা কমছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিদেশি অর্থ সাহায্যও। আর ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে মিশে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দায়ভার এই দেশের কাঁধে আপনাআপনিই পড়ছে।
সূত্র জানায়, ৩৪টি রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার ৪৩৮ শিশুর জন্ম হচ্ছে। ওই হিসাব যোগ করলে গত ৩ বছরে ক্যাম্পে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন দপ্তর এবং জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের যৌথ উদ্যোগে চলতি বছর সর্বশেষ ডিজিটাল নিবন্ধনে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৮ লাখ ১৯ হাজার ৭৮৭ জন। আর পরিবারের সংখ্যা এক লাখ ৭৯ হাজার ৫৯০। ক্যাম্পের ২০১৮ সালের জুন মাসের আগের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের সঙ্গে তুলনা করে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার ক্যাম্প থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করছে। রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ছে অথবা বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকছে। তারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে ও স্থানীয়দের শ্রমক্ষেত্র কেড়ে নিচ্ছে। এমনকি মিয়ানমার থেকে আগে এসেছে এমন অনেকে এখন কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় জনপ্রতিনিধি। তারা রোহিঙ্গাদের স্থায়ী হতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বসতি স্থাপন করেছে- এমন রোহিঙ্গার সংখ্যা অনেক। তাছাড়া উখিয়া উপজেলার পালংখালী, জালিয়াপাড়া, মাছকারিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে ওঠেছে। প্রশাসনিকভাবে কোনো অভিযান না থাকায় রোহিঙ্গারা বেপরোয়া। তার আগে দেখা গেছে অভিযানে যারা ধরা পড়তো, তাদের ৯০ শতাংশই রোহিঙ্গা। ক্যাম্পে তারা ব্যাপকহারে মাদক ব্যবসায় যুক্ত। অবৈধ ব্যবসায় তারা বিপুল অর্থ আয় করছে, যা দিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরসহ বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী হচ্ছে রোহিঙ্গারা।
সূত্র আরো জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইন-শৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি হচ্ছে। জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্রও দেখা যাচ্ছে। তারা এখন স্থানীয়দের জন্যও বিষফোঁড়া। একটি স্থানে এতো বিপুল রোহিঙ্গা রাখার পদক্ষেপ সঠিক নয়। স্থানীয়দের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ক্যাম্পে পূর্ণ নিরাপত্তার ভেতর রাখা প্রয়োজন। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে এমন কিছু এনজিও কর্মকর্তাও তাদের নানাভাবে মদদ দিচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মতো বিশ্ব সমস্যা যেন স্থানীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। জরুরিভাবে এর সমাধান খুঁজে নিতে হবে। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের অনেকেই বিভিন্ন স্থানে খাস জমি ও বনভূমি দখল করে বসতি গড়ে তুলছে। টেকনাফের পৌরশহর, হ্নীলা, বাহারছড়া, হোয়াইক্যংসহ বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপনকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা কম নয়। তাছাড়া রোহিঙ্গারা জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। অনেক পরিবারেই এক বা একাধিক সদস্য বিভিন্ন কাজে যুক্ত। পরিবারের বাকি সদস্যরা ক্যাম্পে নিয়মিত ত্রাণসামগ্রী নিচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪০১ রোহিঙ্গার জন্য খাদ্যসামগ্রী দিচ্ছে। বাকি রোহিঙ্গারা কোথায় রয়েছে এবং কীভাবে তারা জীবিকা নির্বাহ করছে ওই তথ্য তাদের কাছে নেই। সংস্থার তথ্যমতে, গত ডিসেম্বরে তারা ৯ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গার জন্য খাদ্যসামগ্রী দিয়েছিল।
এদিকে উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গাদের দেয়া তথ্যমতে, আশ্রয় কেন্দ্রে নিবন্ধন করেনি এমন রোহিঙ্গার সংখ্যাও লক্ষাধিক। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অবস্থাপন্ন রোহিঙ্গা পরিবারগুলো ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়নি। তারা কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়া, পাহাড়তলী, ঝিলংজা, সদর উপজেলার ঈদগাঁও এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ভাড়া নিয়ে থাকছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরিও করছে। তাছাড়া সাগরে মাছ ধরা নৌকায় মাঝিমাল্লাদের বেশিরভাগই এখন রোহিঙ্গা। যদিও রোহিঙ্গাদের কাজ না দিতে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু অনেক বোট মালিক কম বেতন দিতে পরিচয় গোপন রেখে রোহিঙ্গাদের শ্রমে লাগাচ্ছে। তাছাড়া গ্রামের বিভিন্ন পথ রয়েছে, যেখানে কোনো চেকপোস্ট নেই। রোহিঙ্গারা ওসব পথ ব্যবহার করে দিনে বা রাতে অন্যখানে চলে যাচ্ছে। কক্সবাজার শহর থেকে অন্য জেলায় যেতে তাদের কোনো চেকপোস্ট সামনে দিয়ে যেতে হয় না।
এদিকে এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন জানান, অধিকাংশ রোহিঙ্গা মহাসড়কের চেকপোস্ট এড়ানোর জন্য হাঁটা পথ ব্যবহার করে। ওসব কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বেষ্টনী নির্মাণের কাজ শুরু করেছে।
অন্যদিকে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা সংকটের ৩ বছরে তিন দফায় কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে গেছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গেবৈঠক করেছে। তারপরও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুবুল আলম তালুকদারের মতে, প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৩৫৮ পরিবারের পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার ৩১৯ রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের কাছ থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ১০ হাজার ৭০৪ রোহিঙ্গার ছাড়পত্র পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার আন্তরিক নয়। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে ইতিমধ্যে সাড়ে ৬ হাজার একর বনভূমি বেদখল হয়ে গেছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অকল্পনীয় ক্ষতি হয়েছে। পাহাড় কাটায় বদলে গেছে ভূমির প্রকৃতি। ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস ও কার্যক্রমের প্রভাব পড়েছে আশপাশের বিস্তৃত এলাকায়। নষ্ট হচ্ছে কৃষিজমি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে বন ও জীববৈচিত্র্য যেমন বিপন্ন হবে, তেমনি মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে এ অঞ্চল।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারে আইএসসিজির সমন্বয় কর্মকর্তা সৈকত বিশ্বাস জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিশ্রুত তহবিল না মেলায় পরিকল্পিত অনেক ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে। স্থানীয়দের জন্যও অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তাতে দাতা সংস্থাগুলোও উদ্বিগ্ন। দাতা দেশগুলোর মধ্যে এ বছর সবচেয়ে বেশি ১৭৬ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দিয়েছে আমেরিকা। তারপর অস্ট্রেলিয়া সরকার দিয়েছে ৩৮ মিলিয়ন ডলার। আর সমপরিমাণ অর্থ সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাজ্য।