গ্রামাঞ্চলে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও সংরক্ষণে সরকার শত শত পুকুর, দীঘি ও জলাশয় খনন করছে। ওই লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯২৫টি পুকুর, দীঘি ও জলাশয় খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজ শতকরা ৭০ ভাগ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে গ্রামের মানুষ ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিবর্তে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করতে পারবে। মূলত ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাওয়ার কারণেই ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রকল্পটি সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারও ছিল। ওই কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি পুকুরের পানির গভীরতা হবে ৫ মিটার থেকে ৭ দশমিক ৫ মিটার। চারপাশে কাঁটাতারের বেড়ার পাশাপাশি পুকুরের অপব্যবহার রোধে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করার জন্য থাকবে একটি ফটক। চারপাশে থাকবে হেঁটে চলার ইটের রাস্তা। থাকবে পুকর পাড় রক্ষার জন্য বেষ্টনী। পুকুরের আকার সর্বনিম্ন ১ হাজার ৫শ’ বর্গমিটার থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার বর্গমিটার হতে হবে। প্রকল্পের আওতায় থাকা পুকুরগুলো জেলা পরিষদের দেখভাল করার দায়িত্ব। এ কারণে গোটা কার্যক্রম তদারকি করার জন্য পুকুর এলাকায় জেলা পরিষদের স্থানীয় সদস্যসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দিয়ে একটি তদারকি কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটিই পুকুর, দীঘি ও জলাশয়গুলো দেখে রাখছে। ওই কারণেই এখন পর্যন্ত কোন পুকুর, দীঘি ও জলাশয় সংস্কার করার পর নষ্ট হয়ে যায়নি। যেসব জেলায় স্যালাইন তথা লবণাক্ত পানির আধিক্য রয়েছে, সেসব এলাকায়ও প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। উপকূলীয় ১২ জেলায় ১৬৫ পুকুর ও দীঘি পুনর্খনন কাজ চলছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এ কাজের সঙ্গে জড়িত। পুকুরের মাটি কাটা, পাড়ে মাটি ভরাট এবং পাড় বাঁধা, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং, রেইন ওয়াটার সংগ্রহ করে পুকুরে জমা করা, এ্যাপ্রোচ রোড তৈরি, ওয়াক ওয়ে নির্মাণ, প্লাসাইটিং করা, কাঁটাতারের বেড়া (বার্বেট ফেন্সিং), পাড়ে ঘাস লাগানো, পানি নিষ্কাশন, গাছ লাগানো ও নিয়মত পুকুর, দীঘি ও জলাশয়গুলো দেখভাল করা।
সূত্র জানায়, ৪২টি জেলার গ্রামাঞ্চলে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও সংরক্ষণের জন্য ২০১৬ সালের সেপ্টম্বর মাসে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। চলতি ২০২০ সালের জুনে প্রকল্পটি মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানো হয়েছে। ফলে আগামী বছরের জুনে প্রকল্পটি শেষ হবে। প্রকল্পের পুরো নাম ‘পানি সংরক্ষণ ও নিরাপদ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে জেলা পরিষদের পুকুর, দীঘি ও জলাশয়সমূহ পুনর্খনন-সংস্কার প্রকল্প ২০২০’। প্রকল্পের মূল ডিপিপিতে ধরা ছিল ৮০৯ পুকুর, দীঘি ও জলাশয়। পরে সংশোধিত হয়ে পুকুর, দীঘি ও জলাশয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯২৫টি। ইতিমধ্যে ৫৭৪ পুকুর, দীঘি ও জলাশয় পুনর্খনন-সংরক্ষণ-সংস্কার এবং নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ৩৫১ পুকুর, দীঘি ও জলাশয় পুনর্খনন-সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজ শুরু হবে বর্ষা চলে যাওয়ার পর। তবে পুকুর-দীঘি-জলাশয়গুলো পুনর্খনন ও সংস্কার কাজ করতে গিয়ে নানা ধরনের জটিলতার শিকার হতে হয়েছে। পুকুরগুলো সরকারি সম্পত্তিতে থাকলেও অনেকেই দীর্ঘকাল ধরে তা ভোগ দখল করে যাচ্ছে। সেখান থেকে পুকুরগুলো উদ্ধার করা খুবই জটিল কাজ ছিল। জেলা পরিষদ অনেক সময় এ বিষয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। অথচ পুকুর-দীঘি ও জলাশয় পুনর্খনন ও সংস্কার কমিটির সভাপতি হচ্ছেন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তার অনুমোদন না পেলে ঠিকার বিল পাবে না। আবার অনেক জেলায় জেলা পরিষদের সহযোগিতা পাওয়া গেছে। অনেক পুকুর ও দীঘির মালিকানা নিয়ে মামলা থাকায় পুনর্খনন কাজ করা সম্ভব হয়নি। সেজন্য কিছু পুকুর ও দীঘি খনন কাজ বাদ দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের পিডি শামছুল আলম জানান, কিছু পুকুর, দীঘি ও জলাশয়ে কম খরচে করা হয়েছে। আর ওসব পুকুর, দীঘি ও জলাশয়ের টাকা দিয়ে আরো ৩২৬ পুকুর, দীঘি ও জলাশয় প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাতে সারাদেশে পুকুরের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। তাছাড়া এটি সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ করার জন্য সরকার নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাঁচার জন্য পানি অপরিহার্য। সেজন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিবর্তে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করা খুব জরুরি। পল্লীর এলাকার জনগণের জীবনমান উন্নয়নে নিরাপদ পানি সবার আগে প্রয়োজন। গ্রাম এলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি রয়েছে পুকুরের গভীর পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানির স্তর ঠিক রাখা এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির চাপ কমানো। বৃষ্টির পানি বা বর্ষার পানি সংরক্ষণ করে তা বিশুদ্ধ করে ব্যবহার করার জন্যই সরকার পুকুর, দীঘি ও জলাশয় পুনর্খননের ওপর জোড় দিয়েছে।