করোনা মহামারীর কারণে বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের মেয়াদকাল ও ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। মহামারীর কারণে ওসব প্রকল্পের কাজ বিঘিœত হয়েছে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর ব্যয় বেড়েছে। তাছাড়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজ তদারকি প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ৩৪ মাস, যা সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তাতেও ব্যয় বাড়বে। তাছাড়া তিন মাসের ধীরগতির পর মেট্রোরেল লাইন-৬, পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেলের কাজের গতি কিছুটা বেড়েছে। সম্প্রতি ফার্স্টট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলোর তদারকি-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভায় ওসব প্রকল্পের কাজের গতি বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৮৯ দশমিক ২ শতাংশ। আর ওই প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮১ শতাংশ। তবে ¯্রােত ও পানির গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় স্প্যান বসানোর কাজে কিছুটা বিঘœ ঘটছে। বর্তমান প্রকল্পের মাওয়া প্রান্তে পানির গভীরতা রয়েছে ৬ মিটার। একই সঙ্গে তীব্র ¯্রােতও রয়েছে। ফলে স্প্যান বসাতে হলে পানির গভীরতা নামতে হবে ৪ দশমিক ৮ মিটারে এবং ¯্রােতও কমতে হবে। ওই অংশে ১০টি স্প্যান বসানো বাকি রয়েছে। তাছাড়া রয়েছে করোনা ভীতি। ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত অনেকেই কভিডে আক্রান্ত হয়েছে। এটাও প্রকল্পের কাজে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। একইভাবে পদ্মা সেতুর রেললাইন সংযোগ প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, করোনা ভাইরাসের কারণে সাময়িক স্থবির হয়ে পড়া বহুল প্রত্যাশিত দেশের প্রথম মেট্রোরেলের (লাইন-৬) নির্মাণকাজে কিছুটা গতি ফিরেছে। প্রকল্পের মোট ৮টি প্যাকেজের মধ্যে ৫টির কাজ আবার শুরু হয়েছে। বাকি প্যাকেজগুলোর কাজ শিগগিরই শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী। বর্তমানে ওই প্রকল্পের বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন, স্টেশন নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক আশা করেন শিগগিরই সব প্রকল্পের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। আর প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের আগেই ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে জাপান অন্তত বিশ্বের ৩২টি দেশ থেকে তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে। দেশটি তাদের নাগরিকদের যাতায়াতের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফলে কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে আশা করা যায় দ্রুত এই সংকট কেটে যাবে এবং জাপানিরা এসে কাজ শুরু করবেন। মেট্রোরেল প্রকল্প লাইন-৬ দিয়াবাড়ী থেকে শুরু করে প্রথম ভাগে ১১ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার লাইনের মধ্যে ১০ কিলোমিটারেরও বেশি অংশে ভায়াডাক্ট স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। ওই অংশে এখন দ্রুতগতিতে রেলট্র্যাক বসানোর কাজ চলছে। তার পাশাপাশি মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপনের কাজও দ্রুতগতিতে চলছে। মেট্রোরেলের জন্য টঙ্গীতে নির্মিত সাব-স্টেশন থেকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক লাইন দিয়াবাড়ীতে অবস্থিত মেট্রোরেল ডিপোতে টেনে আনা হচ্ছে। একই সঙ্গে পুরো মেট্রোরেলের লাইনে একইভাবে বৈদ্যুতিক লাইন টানা হচ্ছে। বর্তমানে এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের চারটি স্টেশনের নির্মাণকাজ চলছে। সেগুলো হচ্ছে দিয়াবাড়ীতে উত্তরা (উত্তর), উত্তরা (দক্ষিণ), উত্তরা (পূর্ব) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন। তার মধ্যে উত্তরার তিনটি স্টেশনের উপরিভাগের নির্মাণকাজ চলছে। খুব দ্রুতততম সময়ের মধ্যে ওই তিনটি স্টেশনের কাজ শতভাগ শেষ হয়ে যাবে। তার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে।
সূত্র আরো জানায়, সরকারের নেয়া আরেক মেগা প্রকল্প কর্ণফুলী টানেল। যা বাংলাদেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন এক দিগন্তের সূচনা করবে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ টিউবওয়ের যুগে প্রবেশ করবে। দুই টিউববিশিষ্ট কর্ণফুলী টানেলের একটি টিউবের বোরিং ও রিং প্রতিস্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। ২ হাজার ৪৫০ মিটার টিউবের পুরোটার কাজ ৩১ জুলাইয়ের মধ্যেই শেষ হয়। আর এখন পর্যন্ত ওই প্রকল্পে কাজের সার্বিক অগ্রগতি হচ্ছে ৫৭ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ চেšধুরীর মতে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কর্ণফুলী নদীর ধারা দু’ভাগে বিভক্ত হওয়ায় চট্টগ্রাম মহানগরীকে এক সুতায় বাঁধতে সরকার দুই টিউববিশিষ্ট কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই প্রকল্পের নির্মাণকাজ গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। তারপর থেকে বিরতিহীনভাবে প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে তার মধ্যে গত মার্চে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে নির্মাণকাজের গতি কিছুটা মন্থর হয়। তবে সীমিত পরিসরে কাজ চলতে থাকে। করোনা ভাইরাসের বিষয়টি মাথায় রেখে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে কয়েক মাস ধরে আবারো পুরোদমে বৃহৎ এই প্রকল্পের কাজ চলছে। কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে চীনের ২৯৩ জন নাগরিক রয়েছে, যাদের সবাই বর্তমানে কর্মরত। প্রকল্পের নির্মাণকাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিসিসিসি লিমিটেড চীনের আরো ৮৭ জন নাগরিকের জন্য বাংলাদেশি ভিসার আবেদন করেছে। ইতোমধ্যে সেতু কর্তৃপক্ষ বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে চিঠি দিয়েছে। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ টাকার এই টানেল নির্মাণ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন হচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা আসবে। প্রকল্পের মূল টানেল নির্মাণকাজের শতভাগ ব্যয় বহন করছে চীন সরকার।
এদিকে সরকারের অগ্রাধিকাপ্রাপ্ত অন্য মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ বর্তমানে কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে রয়েছে দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেস রেলওয়ে নির্মাণ প্রকল্প। করোনার কারণে ওসব প্রকল্পের কোনোটার কাজেই কাক্সিক্ষত গতি নেই। বিগত ২০১০ সালে দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির কাজের সার্বিক অগ্রগতি মাত্র ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে ওই প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার কথা রয়েছে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রকল্পের কাজ প্রায় বন্ধই রয়েছে। ২০১৪ সালে মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ওই প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ২৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। ওই প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত আর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হয় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ। মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এখন পর্যন্ত ওই প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ২৫ দশমিক ০৪ শতাংশ এবং মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
অন্যদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বহুবার বলেছেন, যেদিন পদ্ম সেতুতে গাড়ি চলবে, ঠিক সেদিন থেকেই ট্রেনও চলবে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে ওই প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ২৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ, আর্থিক অগ্রগতি ৩০ দশমিক ৫২ শতাংশ। বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। অথচ বলা হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে। ফলে সে সময়ের মধ্যে রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কিনা তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সংশয় প্রকাশ করেছেন। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজও প্রায় বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পের প্রথম অংশ এয়ারপোর্ট-বনানী আগে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে তা হচ্ছে না। বর্তমানে ওই প্রকল্পের বনানী অংশে সীমিত পরিসরে কাজ চলছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্দিষ্ট সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ না হলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যয় বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কভিড-১৯-এর অচলাবস্থা। ফলে ওসব প্রকল্পের কাজ সচল রাখা এখন খুবই চ্যালেঞ্জের। ওই কারণে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকাল এবং ব্যয় বাড়াটা খুবই স্বাভাবিক।
মেগাপ্রকল্পগুলোর প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, সেতু নির্মাণকাজ শেষ হতে সময় বেশি লাগার জন্য পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের মূল সেতু ও নদীশাসন কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক সংস্থার মেয়াদ আরো ৩৪ মাস বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এজন্য সরকারের ব্যয় হবে ৩৪৮ কোটি ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা। বিশেষ করে বর্তমানে করোনা সংক্রমণের কারণে পদ্মা সেতুর কাজ সময়মতো করা যায়নি। তাছাড়া এ বছরের ভয়াবহ বন্যার কারণেও কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। সে জন্য নদীশাসন তদারকির দায়িত্বে থাকা কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি) অ্যান্ড এএমপি অ্যাসোসিয়েটসের মেয়াদ ৩৪ মাস বাড়ানো হয়েছে।