জনবলের অভাবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) শতাধিক জলযানকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বরং ওসব নৌযান বছরের পর বছর অলস পড়ে রয়েছে। অথচ ওসব জলযান কিনতে সরকারকে ২ হাজার ২১ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। বর্তমানে যথাযথ পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ক্রমশ কমছে জলযানগুলোর আয়ুষ্কাল। আর নদী খননে ওসব জলযান ব্যবহার করতে না পারায় সুফলও মিলছে না। বিআইডব্লিউটিএ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শিপইয়ার্ডে ও নদীতে বিআইডব্লিউটিএর ২৪টি ড্রেজারসহ ১২৭টি জলযান পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল না থাকায় ওই জলযানগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ওসব জলযান পরিচালনার জন্য বিআইডব্লিউটিএ ৩ বছর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ৯১৯টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করে। তবে ৩১৮টি পদ কমিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১ হাজার ৬০১টি পদ সৃষ্টির অনুমোদন দিলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ে তা আটকে রয়েছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ও প্রশাসনিক জটিলতায় অর্থ মন্ত্রণালয় ওসব পদের অনুমোদন দেয়নি।
সূত্র জানায়, দুটি প্রকল্পের আওতায় বিআইডব্লিউটিএর জন্য ১২৭টি জলযান কেনা হয়। ‘২০ ড্রেজারসহ সহায়ক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি সংগ্রহ’ প্রকল্পের আওতায় ২০টি ড্রেজারসহ ১১২টি জলযান কেনা হয়েছিল। তার মধ্যে ৯৫টি জলযান বিআইডব্লিউটিএর বহরে যোগ হয়েছে। তাতে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। আর ‘১০ ড্রেজারসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি/যন্ত্রপাতি সংগ্রহ’ প্রকল্পের আওতায় কেনা হয় ৩৮টি জলযান। তার মধ্যে ৩২টি জলযানের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাকি জলযান নির্মাণ চলছে। দুই প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ২১ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু জনবল না থাকায় ওসব জলযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না এবং বিভিন্ন স্থানে পড়ে রয়েছে। তার মধ্যে ২৬ ইঞ্চি ডায়ামিটারের কাটার সাকশনবিশিষ্ট বড় আকারের ৬টি ও ২০ ইঞ্চি ডায়ামিটারের ৯টি কাটার সাকশন ড্রেজার রয়েছে। তবে অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছু সংখ্যক লোক দিয়ে কিছু জলযান সচল রাখা হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০১৮ সালে সবচেয়ে বড় আকারের ড্রেজার বাঙ্গালী, বিশখালী, বংশী, বলেশ্বর, ব্রহ্মপুত্র ও বরাক বিআইডব্লিউটিএ বহরে যুক্ত হয়। প্রতিটি ড্রেজারের দাম ৬৩ কোটি টাকা। ওসব ড্রেজার সংগ্রহের দুই বছর হলেও জনবল সংকটে বিআইডব্লিউটিএ কাক্সিক্ষত সুফল পায়নি। বর্তমানে ৪টি ড্রেজার শিমুলিয়া ও বাকি ২টির একটি খুলনা ও আরেকটি পাটুরিয়ায় রাখা হয়েছে। প্রতিটি ড্রেজার পরিচালনায় ২০ জন জনবল প্রয়োজন হলেও অস্থায়ী ভিত্তিতে ৫-৬ জন রয়েছে। মূলত জনবলের অভাবেই ড্রেজারগুলো অলস বসে থাকছে। ফলে যে হারে নদী ড্রেজিং করার কথা তার এক-চতুর্থাংশও ড্রেজিং হচ্ছে না। ওসব ড্রেজার দিনে কমপক্ষে ১৬ ঘণ্টা ড্রেজিং করার কথা। অথচ লোকবল না থাকায় গড়ে ৫-৬ ঘণ্টাও চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে বিগত ২০১৬ সালে নদীর গভীরতা জরিপের কাজে কেনা ৭টি সার্ভে জাহাজ বুঝে নেয় বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু জাহাজগুলো এখনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শিপইয়ার্ডে পড়ে রয়েছে। একই কারণে ওই শিপইয়ার্ডে আরো কিছু জলযান রয়েছে। এখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ওসব জলযান পাহারা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হচ্ছে। শিপইয়ার্ডই নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে কিছুদিন পরপর ওসব জলযানের প্রধান ইঞ্জিন ও জেনারেটর চালু করা ও ব্যাটারি চার্জ দিতে হচ্ছে। তাছাড়া অন্যসব ইকুইপমেন্ট সচল রাখার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। তাছাড়া অন্য একটি শিপইয়ার্ডেও বেশ কয়েকটি জলযান বছরের পর বছর ধরে পড়ে রয়েছে। জনবল সংকটে ওসব জলযান বিআইডব্লিউটিএ নিতে পারছে না। তাছাড়া শুধু বেসরকারি শিপইয়ার্ড নয়, বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব বেজগুলোয়ও অনেক জাহাজ পড়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন বসে থাকায় একদিকে যেমন নৌযানগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশের আয়ুষ্কাল কমছে, অপরদিকে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে জনবল অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ফজলুল বারী জানান, নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয় পেয়েছে। কিন্তু ওই প্রস্তাবের বিষয়ে কিছু তথ্য এক থেকে দুই মাস আগে চেয়েও পাওয়া যায়নি। তথ্য পাওয়ার পর প্রস্তাব পর্যালোচনা করে অনুমোদনের জন্য তোলা হবে।
এ ব্যাপারে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, জনবল সংকটে বিআইডব্লিউটিএর জলযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না। আর জনবলের অনুমোদন না পাওয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কাজে আসছে না। সুফলও পাওয়া যাচ্ছে না। আর অনুমোদন পাওয়ার পর নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতেও দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে।