বর্তমান সরকার গ্রিড লাইনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু তারপরও ব্যক্তিপর্যায়ে বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর সংখ্যা। আগের চেয়ে সোলার হোম সিস্টেমে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষের নির্ভরতা অনেকগুণে বাড়ছে। বিশেষ করে যেসব বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে এমন সব বাড়িতেও সিস্টেমের মাধ্যমে বাড়তি ব্যবস্থা হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যবহারকারীরা মূলত সর্বক্ষণিক বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যেই গ্রিড লাইনের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকছে। ফলে গ্রামের পাশাপাশি শহরে বা মফস্বল শহরে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারের চাহিদা বাড়ছে। যখন গ্রিড লাইনের বিদ্যুৎ থাকে না ব্যবহারকারীরা তখন সৌরবিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে। বিশেষ করে লোডশেডিংয়ের সময়ে বাড়তি ব্যবস্থা হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ বেশ কাজে দিচ্ছে। ব্যবহারকারী এবং সৌরবিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ১৯৯৬ সাল থেকে দেশে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তিপর্যায়ে সোলার হোম সিস্টেমে বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়। মূলত দুর্গম ও চরাঞ্চলে বিদ্যুতের সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিতেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তারপর দু’যুগ পেরিয়ে গেছে। এই দীর্ঘসময়ে দেশে গণহারে বাড়ছে সোলার হোম সিস্টেমে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার। এখন তা শুধুমাত্র চর এবং দুর্গম অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নেই। শহরাঞ্চলেও এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী, বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। শুধু বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ নয়, সেচকাজসহ সৌরবিদ্যুতের বহুমুখী ব্যবহার কয়েকগুণ বেড়েছে।
সূত্র জানায়, গ্রিড লাইনের পাশাপাশি এখন অনেকেই সৌরবিদ্যুতের ওপর নির্ভর করছে। মূলত সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুবিধা পেতেই সোলার হোম সিস্টেমের প্রতি অনেকে ঝুঁকছে। ইডকলের হিসাব মতে দেশের গ্রামীণ পর্যায়ে সৌরবিদ্যুতের ৬০ লাখ গ্রাহক রয়েছে। আর সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। ওই হিসাবের বাইরেও অনেকে এখন দোকান থেকে কিনেই বাড়িতে সিস্টেম স্থাপন করছে। তাছাড়া ডিভাইসের মাধ্যমে অনেকে ভাগাভাগি করেও সৌরবিদ্যুত ব্যবহার করছে। দেশে ১৯৯৬ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সোলার হোম সিস্টেম বা বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার শুরু হয়। তার আগে সরকারি পর্যায়ে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে উৎসাহিত করার চেষ্টা করা হয়। বেসরকারিভাবে ডাউন পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমেই প্রথম চরাঞ্চল, দুর্গম এলাকা এবং গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার কাজ শুরু হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি প্রথম বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এই কার্যক্রম হাতে নেয়। তবে সৌরবিদ্যুতের অধিক দামের কারণে প্রথমদিকে তা ব্যবহারে অনেকেই আগ্রহী ছিল না। কিন্তু গ্রামীণ শক্তি ডাউনপেমেন্টের মাধ্যমে মানুষের কাছে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। ওই পদ্ধতিতে কয়েক বছরের কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করে নিজেরাই তার মালিকানা পেতো। ফলে বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য গ্রিড লাইনের অপেক্ষায় থাকতে হতো না। ওই সুবিধার কারণে আস্তে আস্তে মানুষের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে আগ্রহ বেশ বেড়ে যেতে থাকে।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে যাদের ঘরে গ্রিড লাইনের বিদ্যুৎ রয়েছে তারাও বাড়তি সুবিধা বা সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করছে। এই পন্থায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরও ব্যাটারিতে জমে থাকা অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করে অর্থও আয় করা যাচ্ছে। ফলে দিন দিন সৌর বিদ্যুৎ মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তাছাড়া দুই ধরনের বিদ্যুৎ ব্যবহারের কারণে সৌরবিদ্যুৎ অনেকটা অব্যবহৃত থেকে যায়। ফলে বিদ্যুৎ নষ্ট না করে ডিভাইসের মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করা যাচ্ছে। ফলে একজনের থেকে অন্যরা এখন সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে তার অবস্থানগত কারণে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের বেশ উপযোগী। কারণ বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় সৌরবিদ্যুতের জন্য সূর্যের পর্যাপ্ত আলো পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি যে বছর অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে সে বছরও প্রয়োজনীয় সূর্যালোক পাওয়া যাচ্ছে। ফলে সোলার হোম সিস্টেমে বিদু উৎপাদনের কোন ধরনের জটিলতায় পড়তে হচ্ছে না। নেই লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণাও। ফলে ইচ্ছমতো সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার এখন মানুষের হাতের নাগালে এসে পৌঁছেছে। তাছাড়া দেশে এখন সৌরবিদ্যুতের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ছে। শুধু বাসাবাড়িতেই এর ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সেচ থেকে শুরু করে সড়কবাতি, ইকো ভিলেজ তৈরিতেও সোলার বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে। সরকার টিআর, কাবিখার মাধ্যমে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে উৎসাহিত করছে। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ভবন নির্মাণে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার নীতিমালা থাকায় বহুগুণে ব্যবহার বাড়ছে। ফলে রাজধানী ঢাকায় বহুতল ভবনগুলোতে শোভা পাচ্ছে সারি সারি সোলার প্যানেল।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে ইতোমধ্যে বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে (সোলার হোম সিস্টেম) বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ মানুষ বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। গত জুন মাসে প্রকাশিত বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্টে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে নেপাল। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর পৃথিবীতে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গড়ে বেড়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশ এ হার বৃদ্ধিতে পৃথিবীতে অন্যতম। ২০১০ সালে বাংলাদেশে ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় ছিল, যা ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৯৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে।
দেশে সৗরবিদ্যুতের প্রসার প্রসঙ্গে গ্রামীণ শক্তি মহাব্যবস্থাপক ওয়াসিম রেজা জানান, দেশে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার গণমুখী হয়ে গেছে। এখন আর বাসাবাড়িতে সীমাবদ্ধ নেই। আগের ডাউন পেমেন্ট সিস্টেমের প্রথা প্রায় উঠেই গেছে। এখন মানুষ দোকান থেকে কিনে নিয়েই বাড়িতে সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করছে। দামে সস্তা হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে চাহিদা আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়েছে। সৌরবিদ্যুতের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে এর সঙ্গে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোও সেদিকেই মনোনিবেশ করছে। গ্রামের অনেকেই সোলার প্যানেল ব্যবহার করে টিউব ওয়েলের মাধ্যমে পানি উত্তোলন বা পানি বিশুদ্ধকরণের কাজ করছে। সরকারের সহ¯্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়টি রয়েছে। ফলে সরকার থেকেও এটি ব্যবহারে জোর দিচ্ছে। এ কারণে টিআর, কাবিখা প্রকল্পের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছে। সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রথম পর্যায়ে এর দাম ছিল অনেক। কিন্তু বর্তমানে সৌরবিদ্যুতের দাম ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ায় ব্যবহার বাড়ছে। আগে যেখানে একটি সিস্টেম ব্যবহারে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা খরচ হতো. এখন ওই ধরনের একটি সিস্টেম বসাতে একজনের খরচ পড়ছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। ফলে ব্যক্তিপর্যায়ে এখন দেশে গণহারে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে।