রেলে পচনশীল কাঁচামাল পরিবহনে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সেজন্য প্রায় চার দশক পর অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনা হচ্ছে। মাছ, মাংস, ফল, শাক-সবজি মালবাহী ট্রেনের ওসব লাগেজ ভ্যানে পরিবহন করার পরও থাকবে সম্পূর্ণ সতেজ। এর ফলে এদেশে প্রথমবারের মতো মালবাহী ট্রেনে রেফ্রিজারেটর তথা ফ্রিজিং সিস্টেম থাকবে। আর ওসব মালবাহী ট্রেন সময়মতো স্টেশন ছেড়ে যাবে এবং নির্ধারিত সময়েই গন্তব্যে পৌঁছাবে। মালবাহী পণ্য পরিবহনের বগিগুলোও হবে কয়েকগুণ বেশি গতিসম্পন্ন। মিটার গেজ ও ব্রডগেজ উভয় লাইনেই ওসব ট্রেন পথে চলবে। তাছাড়া যে কোন সময় ওসব মালবাহী ট্রেন থামাতে চাইলে মাত্র ২০ সেকেন্ডের মধ্যেই থামানো যাবে। মালবাহী ওই ট্রেনের গতি সাধারণ যাত্রীবাহী ট্রেনের মতোই হবে। আর পণ্য পরিবহনে কোন অভিযোগ থাকলে দ্রুত তা সমাধান করা হবে। কৃষক বা ব্যবসায়ীর মালামাল দেরিতে পৌঁছলে উপযুক্ত কারণ জানাতে হবে। মূলত বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রী পরিবহনের পাশপাশি পণ্য পরিবহনে নতুন করে গতি আনতে চাচ্ছে। ওই লক্ষ্যে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে সাধারণ ও বিশেষায়িত সকল প্রকার পণ্য রেলওয়ের মাধ্যমে পরিবহন করতে নাগরিকদের উদ্ধুদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেজন্য কম সময়ে ও নির্ধারিত মূল্যেই সকল প্রকার পণ্য গন্তব্যে পৌঁছতে গভীর মনোযোগ দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিশেষায়িত পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি আধুনিক সুবিধাসমৃদ্ধ ও উচ্চ গতিসম্পন্ন অটোমেটিক এয়ার ব্রেক সিস্টেম সম্বলিত ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনছে। যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি মালামাল ও বিশেষায়িত পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে দীর্ঘ ৪০ বছর পর এসব অত্যাধুনিক লাগেজ ভ্যান সংগ্রহ করা হচ্ছে। নতুন আনা ওসব ভ্যানে রেফ্রিজারেটর সিস্টেম থাকায় বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য, মাছ, মাংস, দুধ, শাক-সবজি, ফলমূল ও অন্যান্য পচনশীল দ্রব্য কম খরচে ও কম সময়ের মধ্যে রেলপথে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তাতে কৃষক ও কৃষি পণ্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িতরা বেশি লাভবান হবে। মূলত ভবিষ্যতে কৃষকের পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ হিসেবেই অত্যাধুনিক লাগেজ ভ্যান ক্রয় করা হচ্ছে। তাতে করে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ে বিগত ১৯৮০ সালের দিকে সর্বশেষ মালবাহী ট্রেন আনে। তবে ওসব ট্রেনে কোন ফ্রিজিং সিস্টেম ছিল না। ফলে রেলপথে শুকনো খাবার ও পণ্য আনাই সম্ভব হতো। এখন রেল কর্তৃপক্ষ আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেম্পারেচার কন্ট্রোলিং সিস্টেম সম্পন্ন আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন মালবাহী ট্রেন আনছে। বর্তমানে রেলওয়ের যেসব মালবাহী ট্রেন রয়েছে সেসব ট্রেনের বগির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে পণ্যবাহী ট্রেনগুলো অনেকটা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে। ফলে রেল কর্তৃপক্ষ পণ্য পরিবহনে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ বগি থাকায় ও ধীর গতিসম্পন্ন মালবাহী ট্রেন চলাচল করায় অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য রেলপথে পরিবহন করতে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে রেলওয়ে প্রতিবছর লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম পণ্য পরিবহন করছে। আর পণ্য পরিবহনে রেলের চেয়ে সড়ক পথকেই বেছে নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
সূত্র আরো জানায়, রোলিং স্টক ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে আনা ১২৫টি ল্যাগেজ ভ্যান কিনতে সিডি-ভ্যাট ছাড়া প্রায় ৩৫৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকার খরচ হবে। চীনের অর্থায়নে চলমান লাগেজ ভ্যান ক্রয়ের সিডি ভ্যাটের অর্থ দেবে সরকার। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের অধীনে নতুন আরো ৪০টি লোকোমেটিভ আমেরিকা থেকে আনার জন্য চুক্তি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে করোনার প্রভাব না পড়লে আগামী ২০২১ সালের মার্চ নাগাদ ওসব লোকোমেটিভ বাংলাদেশে আনা সম্ভব হবে। তাছাড়া সম্প্রতি অত্যাধুনিক লাগেজ ভ্যান কিনতেও চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তির পর থেকে পরবর্তী ২০ মাসের মধ্যেই ওসব লাগেজ ভ্যান কেনা হবে। তারপর পরবর্তীতে মোট ২৭ মাসের মধ্যে ওসব ভ্যান সরবরাহ করা হবে। স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি ওসব লাগেজ ভ্যান তুলনামূলক কম ক্ষয় হবে ও পানি পড়লেও মরিচা ধরবে না। ফলে বেশি দিন স্থায়ী হবে। বর্তমানে মালবাহী ট্রেনগুলোর গতি সর্বোচ্চ ৪৫ কিলোমিটার হলেও ওসব লাগেজ ভ্যানের গতি হবে ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। ওসব লাগেজ ভ্যান হবে অত্যন্ত শক্তিশালী। যা পণ্য নিয়েও স্বাভাবিক ট্রেনের মতোই একই গতি নিয়ে চলবে। ফলে বাংলাদেশ রেলওয়ে মালবাহী ট্রেনের এক নতুন যুগে পদার্পণ করবে। প্রতিটি মালবাহী ট্রেনের স্থায়িত্বকাল ৩৫ বছর ধরা হলেও চলমান বগিগুলো সর্বনি¤œ ৪০ বছর থেকে ৫০ বছর ধরে চলছে। নতুন ওসব লাগেজ ভ্যান আনার পর মালবাহী ট্রেন চালু করা হলে পণ্য পরিবহনে এক নতুন গতির সঞ্চার হবে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে রোলিং স্টক ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান জানান, ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে দেশে প্রথমবারের মতো আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন লাগেজ ভ্যান ক্রয় করার চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে। ওসব লাগেজ ভ্যানে মালামাল পরিবহন করা হবে। আগে পণ্যবাহী ট্রেনে মাছ মাংস শাক-সবজি ফ্রিজিং আকারে ও টেম্পারেচার সিস্টেম না থাকায় কৃষকগণ ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করতে পারতো না। ফলে আর্থিকভাবে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো। ওসব লাগেজ ভ্যানে কোন পণ্য আনা হলে তা সম্পূর্ণ সতেজ থাকবে। যার ফল ক্রেতারাও সরাসরি পাবে। তাছাড়া এ প্রকল্পের অধীনে নতুন আরও ৪০টি লোকোমেটিভ আমেরিকা থেকে আনার জন্য চুক্তি করা হয়েছে। আশা করা যায় আগামী ২০২১ সালের মার্চ নাগাদ ওসব লোকোমেটিভ বাংলাদেশে আনা হবে। ফলে রেলওয়েতে গতি সঞ্চার হবে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানান, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ রেলওয়েকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। সরকার রেলওয়েতে পণ্য পরিবহনে গতি আনতে বদ্ধপরিকর। তারই অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে কৃষকের পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ হিসেবে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন টেম্পারেচার কন্ট্রোল সিস্টেমের মিটারগেজ ও ব্রডগেজ লাইনে চলার জন্য ১২৫টি লাগেজ ভ্যান ক্রয় করা হচ্ছে। বর্তমানে মালবাহী ট্রেনগুলোর গতি সর্বোচ্চ ৪৫ কিলোমিটার হলেও ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতির নতুন আনা ওসব লাগেজ ভ্যান সময়মতো ও অনেক কম সময়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাবে। তাতে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে। একই সঙ্গে নাগরিকগণও তৃণমূলে উৎপাদিত তাজা মাছ মাংস পাবেন। আর মালামাল পরিবহনে গতি আনতে পণ্য পরিবহন সংক্রান্ত কোন অভিযোগ থাকলে দ্রুতই তা সমাধান করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া কৃষক বা ব্যবসায়ীর মালামাল দেরিতে পৌঁছালে উপযুক্ত কারণ বর্ণনা করতে হবে।