একটা সময় চিঠি ছিল তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে হৃদয়ের আবেগের এক মধুময় পাঠশালা। আবেগ মাখা সেই চিঠি লেখার অভ্যাস মানুষের মাঝ থেকে হারিয়েই যাচ্ছে। চিঠি লেখার প্রবণতা কমে আসায় এর ভাষার নান্দনিকতা, শিল্প-তা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়জনের কথা জানবার প্রতি মানুষের যে তীব্র ব্যাকুলতা তা যেন হঠাৎ করেই উবে গেছে জীবন থেকে। কতদিন দরজায় এসে কড়া নাড়ে না পোষ্ট অফিসের পিওন। অথচ আধুনিক ডাক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে পৌনে দুইশ বছর ধরে রচিত হয়েছে মানুষের অগ্রযাত্রার ইতিহাস। সেই প্রাচীনকাল থেকেই চিঠির মাধ্যমে উঠে এসেছে সময়, মানুষের জীবনযাত্রার ইতিহাস। সৃষ্টিশীলতার বিকাশও ঘটতে দেখা গেছে চিঠির মধ্য দিয়ে। কবি রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে যেভাবে মানুষের জীবন, প্রকৃতি, রাজনীতি ও সমাজনীতি উঠে এসেছে, যেভাবে সোজাসাপটা ভাষায় তিনি সবকিছুর বর্ণনা করেছেন তা বর্তমান মানুষের কাছে চলার দিকনিদের্শনাও দেয়। প্রখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে লেখা চিঠি নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়েছে গ্রন্থ। ইন্দিরা গান্ধীর কাছে জওহরলাল নেহরুর লেখা চিঠি নিয়ে প্রকাশিত দুইটি গ্রন্থ“লেটার ফ্রম এ ফাদার টু হিজ ডটার’ এবং গ্লিস্পসেস অব ওয়ার্ল্ডহিস্টরি”আজো আগ্রহী পাঠকের কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ১৯২৮ সালে ইন্দিরা গান্ধীর বয়স যখন ১০ বছর তখন নেহরু তাকে প্রাকৃতিক ইতিহাস ও সভ্যতার বিকাশ নিয়ে ধারণা দিতে লিখেন প্রথম গ্রন্থে স্থান পাওয়া ৩০টি চিঠি এবং দ্বিতীয় গ্রন্থে ১৯৬টি চিঠি স্থান পায়। এসব চিঠিরও মূল বিষয় পৃথিবীর ইতিহাস, মানবজাতির ইতিহাস। ফলে ব্যক্তিগত চিঠিও কখনো কখনো পরবর্তীকালের জন্য হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষার মাধ্যম। তাই চিঠির গুরুত্ব ও আনন্দ কোনো ভাবেই প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে পাওয়া সম্ভব নয়। ডাক বিভাগের পোষ্টম্যান হলুদ খামভরা গুপ্ত কথার ঝুলি নিয়ে ঘুরে ঘুরে যে চিঠি বিলি করতো সেই দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। ফ্যাক্স, ই-মেইল, মেইল, মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তা, ফেজবুক, স্কাইপেতে ভিডিও চ্যাটসহ ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তিতে কালের যাত্রার সেই চিঠি ও ডাকঘর হারিয়ে যেতে বসছে। সেই দীর্ঘ্য অতীতে যখন ইলেকট্রনিক্স যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না তখন সাধারণ মানুষসহ অফিসিয়াল কোন ঘোষণা বা সতর্কবার্তা, নির্দেশ বা পদক্ষেপের বার্তা সরকার প্রচার করতো ডাকবিভাগের চিঠির মাধ্যমে। তখন ব্যস্ত সময় পার করতো ডাক পিওন, রানার, পোষ্ট মাস্টারসহ অন্যান্য কর্মচারীরা। ডাকঘর যোগাযোগের এমন এক মাধ্যম, যার ভেতর লুকিয়ে থাকে অনেক অনুভ’তির অনুরণন, অনেক আনন্দের কোলাহল কিংবা হতাশার চাপা দীর্ঘশ্বাস। কখনো এটি বয়ে আনে কারো শেষ বিদায়ের কান্না ভেজা খবর। এসব নিয়েই সুখ-দুঃখের সন্দেশ আদান প্রদানের ছোট শব্দের এই মাধ্যমটির নাম চিঠি। যেখানে লেখার সঙ্গে মিশে থাকত সৃষ্টিশীল ভাবনার প্রকাশ। একটি চিঠি বিভিন্ন ভাষা ও জ্ঞানের শৈলি দিয়ে লেখা খামে মোড়ানো ডাক পিওন দরজায় এসে হাঁকেন চিঠি নিন, বেয়ারিংচিঠি আসছে। ডাক যোগে বেশী পাতার চিঠি হলে খামের ওপর বাড়তি টিকিট লাগাতে হতো। এ চিঠির অতিরিক্ত মাশুল না দিলে প্রাপককে তা পরিশোধ করতে হতো। খামের ওপর অর্ধচন্দ্রের সিলমোহর আঁটা দিয়ে আটকানো এই চিঠিকে বলা হতো বেয়ারিংচিঠি। বাবার কাছে টাকা চেয়ে সন্তানের বেয়ারিংচিঠির আবেদনে হৃদয়ের স্পর্শ বাবাকে কাঁপিয়ে তুলতো, তা আজ প্রযুক্তির মুঠোফোনে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছে অজানাই থেকে যাচ্ছে। পুত্রের কাছে মায়ের চিঠি কিংবা মায়ের কাছে পুত্রের চিঠির কী আবেদন তা বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির আলোয় বেড়ে ওঠা ছেলে-মেয়ে বা মায়ের অনুভ’তিতে কখনোই স্পর্শ করবে না। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমরা যখন অভ্যস্ত ছিলাম না, তখন এই চিঠিই কখনো বিনোদনের খোরাক যোগাত, কখনো বা ব্যথাতুর হৃদয়ে কান্না ঝরাতো, কখনো উৎফুল্ল করত, কখনো আবার আবেগে আপ্লুত যোগাত। কী যে সেই আদ্ভুত টান কালি ও কাগজে লেখা চিঠিতে। সেই সব চিঠি পাওয়ার আকুলতা কিংবা চিঠি পড়ার আনন্দ সব কিছুই যেন আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ¯œান হতে চলছে। ইন্টানেটের এ যুগে কাগজ- কলমে লেখা চিঠির প্রচলন অনেক কমে গেলেও তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি।এখনো অফিসিয়াল চিঠি-পত্র প্রতিদিন কম বেশী ডাক যোগের যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। উপমহাদেশে প্রথম এ ডাক চালু হয় ১৭৭৪ সালে। একটি দেশের পরিচয়, তার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ডাকটিকিটে ধরে রাখারও মাধ্যম হয়ে উঠে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্মারক ডাকটিকিট ১৯৭২ সালের ২১ ফের্রুয়ারী প্রকাশিত হলেও দেশে ১৫০ বছরের ঐতিহ্য ধারন করে এগিয়ে চলা ডাক বিভাগের প্রায় নয় হাজার পোষ্ট অফিস আজ নানান সমস্যায় জর্জরিত। প্রধান সমস্যগুলো ডাকঘরগুলোতে প্রযুক্তি পরিচালনার অভাব,অবকাঠামোর উন্নয়নের অভাব ও দক্ষ জনবল নিয়োগ ব্যবস্থা করা, ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আনা, অনলাইনের সমস্ত সুবিধা প্রদান করা, কম্পিউটার প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করাসহ নানাবিধ সমস্য সমাধানের পদক্ষেপ নিলে এ ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকবে। এ প্রতিষ্ঠানটির নেটওয়ার্ক যার জাল পাহাড়, নদী, সমুদ্র, মেরু থেকে অন্য মেরু অঞ্চল, ঘনবসতি এলাকা থেকে জর্নাকীর্ণ দূর্গম স্থান সর্বত্র এর বিস্তৃত। তবে সময়ের সাথে সাথে অবধারীত নিয়মে পোষ্ট অফিসের চেহারা আজ ক্রমেই পরিবর্তনশীল। তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিকতার যুগে পোষ্টঅফিস ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তিগত আপডেটের কারেণে পাল্টে যাচ্ছে পোষ্ট বা ডাক দপ্তরটি সম্পর্কে নতুন প্রজম্মের ধ্যান-ধারণা। হাতে লেখা চিঠি, পোষ্টকার্ড, ইনল্যাল্ড, ইনভেলাপ,মানি-অর্ডার, কিংবা টেলিগ্রামের মাধ্যমে খবর আদান-প্রদানের স্থানটি দখল করে নিয়েছে ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তি। বহু বছর আগেই ধাপে ধাপে চিঠির স্থান দখল করা শুরু করে দিয়েছে যথাক্রমে টেলিফোন, মোবাইল, ইমো, এসএমএস, ই- ইমেল, ইন্টারনেট, এবং বেসরকারি ও স্বশাসিত কুরিয়ার সার্ভিস।