বৈশ্বিক অতিমারী করোনার প্রভাবে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি সাধন হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায়। কারণ সবকিছু করোনার মধ্যেই প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেও শিক্ষা ব্যবস্থার স্বাভাবিক হতে আরও সময় প্রয়োজন। কারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা। যে কারণে শিক্ষার্থীরা গৃহবন্দী। এই গৃহবন্দীত্ব কাটাতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ধরে রাখতে। নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও চেষ্টার কমতি ছিল না। সব কার্যক্রমের সফলতা-ব্যর্থতা থাকে। তবে সমস্যা সামনে এলেই সমাধানের পথ বেরিয়ে আসে। ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে আমরা সম্ভবত আরো অনেকখানি এগিয়ে গেলাম। অনলাইন ক্লাস সাড়া ফেলেছে। কিন্তু সারাদেশে বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা গ্রহণ করা সব ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এই সময়ে বিভিন্ন পদ্ধতির দুর্বলতা এবং সমস্যা উপলদ্ধি করে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে ’শিক্ষা টিভি’ চালু করতে যাচ্ছে সরকার। নামী দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলে না পাঠিয়ে বরং ওই সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ক্লাস টেলিভিশনে প্রচার করার জন্যই এই শিক্ষা টিভির চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। আজকাল টিভিতে কত কত চ্যানেল রয়েছে। সেসব চ্যানেলে দিনভর বিনোদনের কমতি নেই। কিন্তু একটা চ্যানেল যদি থাকে যেখানে শিক্ষা বিষয়ক কার্যক্রম থাকবে, ক্লাস থাকবে,শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান থাকবে, শিক্ষা নিয়ে নানা রকম পরিকল্পনা থাকবে তাহলে ভালোই হয়। অত্যন্ত সময় উপযোগী এই কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের জন্য ফলপ্রসু হবে। কারণ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেই টেলিভিশনে কোনো জটিল বিষয় দক্ষ শিক্ষকের কাছে শিখতে পারার এই সুযোগ লেখাপড়ায় গতি আনবে। বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষা টিভি চালুর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ করোনার আর কতদিন থাকবে তা যেমন বলা যায় না তেমনি ভবিষ্যতে আর কোনো সমস্যা আসবে না তাও বলা যায় না। তাছাড়া শিক্ষার সুফল সারাদেশে সমানভাবে পৌছে দিতে শিক্ষা টিভির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই সময়ে শিক্ষার যে প্রায় অচলাবস্থা তার ফল আমাদের আরও বহুবছর ভোগ করতে হবে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেকে নিজেকে এবং বিশ^কে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা এখন নিজেদের ঘরবন্দী করে রাখছি।
এখন স্কুল কলেজ সব কিছু বন্ধ রয়েছে। অনেক দেশ স্কুল খুলে আবার করোনার প্রকোপের কারণে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। ততদিন ভরসা অনলাইন ক্লাস। করোনাভাইরাসের কারণে স্কুলগুলো বন্ধ থাকার কারণে বিকল্প হিসেবে এই অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে নিতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে বিশে^র সব দেশের সামর্থ সমান না হওয়ার এর সফলতা ক্ষেত্র বিশেষে হেরফের হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু উন্নয়ন তহবিল ইউনিসেফ জানাচ্ছে, অনলাইন ক্লাসের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী। এর কারণও মূলত একটাই। অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করার মতো সুযোগ অর্থাৎ ডিভাইস বা ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা ইত্যাদি। ইউনিসেফের সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও ইলেকট্রনিক সুবিধা না থাকায় বিশ^জুড়ে আনুমানিক ৪৬ কোটি ৩০ লাখ শিশু অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটট্রা ফোরে বলেন, মাসের পর মাস ধরে এত শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত থাকা শুধু নিছক একটি সংখ্যা নয়, এটা বৈশি^ক শিক্ষা সংকট। আগামী কয়েক দশক ধরে অর্থনীতি ও সমাজে এর প্রতিক্রিয়া অনুভূত হতে পারে। শিক্ষার সংকট ধারণাটি করোনাকালীন সময়ে বেশি উপলদ্ধি হচ্ছে। কারণ এই রকম পরিস্থিতি যা একটি মহামারী এবং এখানে কোনো কাজই জীবনের চেয়ে মূল্যবান হতে পারে না, এমন একটি পরিস্থিতিতে দাড়িয়ে শিক্ষা কার্যক্রম আপাতত বন্ধ বা বিকল্প উপায়ে চালিয়ে নেয়ার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না।
বৈশি^ক এই শিক্ষা সংকট আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। তবে এখান থেকে আমাদের শেখার মতো কিছুও রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের আরও দ্রুততম সময়ে ডিজিটালাইজেশনের চূড়ান্ত রুপে যেতে হবে। সবার কাছে আধুনিক ডিভাইস পৌছাতে হবে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। ইন্টারনেটের যুগে তা আরও সহজলভ্য করতে হবে। তবে এতকিছুর মধ্যে একটি শিক্ষা টিভির প্রাসঙ্গিক গুরুত্ব এসে যায়। একটি টিভি চ্যানেল যেখানে সারাদিন বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, শিক্ষাকে আনন্দময় করতে কৌশল ইত্যাদি থাকলে তা কেবল শিক্ষার্থীর জন্যই সুফল বয়ে আনবে না, শিক্ষকদের জন্যও যথেষ্ট উপকারী হবে। কারণ একজন শিক্ষক যদি টিভিতে দক্ষ শিক্ষকদের ক্লাস নেয়া পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে তিনিও আরও দক্ষ হতে পারবেন। নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে ক্লাসে আরও সফলভাবে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে সক্ষম হবেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে করোনা যে বৈশি^ক সংকট তৈরি করেছে তা আরও কতদিন চলবে বলা সম্ভব না। এই সংকট মোকাবেলায় যে দেশ যত দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারবে সেই দেশ তত এগিয়ে থাকবে। অনলাইন মাধ্যম, রেডিও বা টেলিভিশনে ক্লাস প্রচারের সুবিধা শিক্ষার গতিকে চালু রেখেছে। এরপর যদি একটি শিক্ষা টিভি হয় তাহলে তা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য আরও ইতিবাচক এবং অনেক সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে সক্ষম হবে।
কলাম লেখক, পাবনা।