দেশের কৃষি জমি রক্ষা সরকার পরিকল্পিত এলাকার বাইরে আর শিল্প কারখানা স্থাপন করতে দেবে না। কিন্তু সারাদেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই পরিকল্পিত শিল্প এলাকার বাইরে বেশি শিল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী। যে কারণে উদ্যোক্তারা নিজেদের মতো করে শিল্প প্রতিষ্ঠানের জমি কিনে যেখানে-সেখানে কারখানা স্থাপন করছেন। তাতে দুই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রথমত শিল্প স্থাপনের জন্য বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি বিনষ্ট হচ্ছে। ফলে ফসল উৎপাদনের জমি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত সরকার পরিকল্পিত শিল্প পার্ক স্থাপন করে সেখানেও জমি অধিগ্রহণ করে শিল্পের জন্য প্লট বানিয়ে রাখছে। ফলে ওসব জমিতেও আর ফসলের আবাদ হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে যত্রতত্র শিল্প কারখানা স্থাপনে নিরুৎসাহিত করার নির্দেশনা দেয় হয়েছে। একই সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ ছাড়াও অন্যান্য পরিষেবা যেন অপরিকল্পিত এলাকায় না দেয়া হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমান সরকার পরিকল্পিত এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বেশি মনযোগ দিচ্ছে। সেজন্যই ঢাকার হাজারীবাগে যুগের পর যুগ ধরে গড়ে ওঠা চামড়া শিল্প কারখানা সাভারে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তার বাইরে ওষুধ শিল্প, কেমিক্যাল শিল্পকে সরিয়ে নেয়ার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে তৈরি পোশাক কারখানা দেশে সব থেকে বেশি অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান এই খাতের কারখানাগুলো রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রামে অনেকটাই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে শহরাঞ্চলে মানুষের চাপ বাড়ায় দীর্ঘ যানজটসহ নানান সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী যত্রতত্র শিল্প কারখানা স্থাপনে নিরুৎসাহিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনার বিষয়টি জানানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, অপরিকল্পিত এলাকায় যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেখানে চাইলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ সেখানে একই বিতরণ লাইনে সকলকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও নির্দিষ্ট কারখানার জন্য বিতরণ লাইন থাকলেও তার পরিমাণ খুবই কম। সঙ্গত কারণে নির্দিষ্ট এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলে তাদের পৃথকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। তাতে সেখানে কোন রকম লোডশেডিং করা হবে না। কিন্তু ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো পরিকল্পিত এলাকার বাইরের শিল্পেই বেশি বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে। সারাদেশে দুই লাখ ২৯ হাজার ৮১২টি শিল্প সংযোগের মধ্যে পরিকল্পিত শিল্প এলাকায় মাত্র চার হাজার ৯০৫টি কারখানা রয়েছে। বাকি দুই লাখ ২৪ হাজার ৯০৭টি বিদ্যুৎ সংযোগ পরিকল্পিত শিল্প এলাকার বাইরে রয়েছে। সরকার পরিকল্পিত এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য উদ্যোক্তাদের আহ্বান জানাচ্ছে। তবে শিল্পের বড় একটি অংশই অপরিকল্পিত এলাকায় থেকে যাচ্ছে। তাতে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। পাশাপাশি শিল্পের জন্য দু’ভাবে জমি ছেড়ে দেয়াতে ক্রমান্বয়ে কমছে কৃষি জমি।
সূত্র আরো জানায়, ইতিমধ্যে নির্দিষ্ট পরিকল্পিত এলাকার শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য এন মাইনাস ওয়ান প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। ওই পদ্ধতিতে একটি বিতরণ লাইন বন্ধ হলে আরেকটি বিতরণ লাইন দিয়ে আপনা-আপনি বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়ে যাবে। তার মধ্যে অপর লাইনটি সংস্কার করে ঠিক রাখবে বিতরণ কোম্পানি। ফলে শিল্প মালিকরা কোন সময়ই বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগে পড়বে না। পৃথিবীর উন্নত দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে এন মাইনাস ওয়ান প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া এখন মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিন ভাগের এক ভাগ চালালেই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। সঙ্গত কারণে পরিকল্পিত এলাকার শিল্পের জন্য পৃথক বিদ্যুৎ বরাদ্দ রাখাটাও বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য কঠিন হবে। ওই লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো সকল পরিকল্পিত শিল্প পার্কে বিদ্যুতের অবকাঠামো স্থাপনের কাজও শুরু করেছে।
এদিকে পরিকল্পিত এলাকার শিল্প-কারখানায় বিদ্যুতের বাইরে জ্বালানি সংস্থানে গ্যাসের সংযোগ দেয়ার জন্যও সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। এখন প্রতিদিন ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে আরো ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা সম্ভব। মহেশখালিতে যে দুটি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে তা দিয়ে প্রতিদিন এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা সম্ভব। শিল্পে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকারের এলএনজি আমদানি বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে।
অন্যদিকে জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্টদের মতে, আগে শিল্পে সংযোগের জন্য বিশেষ কমিটির সুপারিশের দরকার হলেও এখন তা হচ্ছে না। বরং কোম্পানিগুলো নিজের বোর্ডে আলোচনা করেই শিল্প সংযোগের অনুমোদন দিতে পারে। তবে এই সংযোগের ক্ষেত্রেও পরিকল্পিত শিল্প এলাকাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।