বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সবজির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ফলে আশানুরূপ হারে রফতানিও বাড়ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১৩ কোটি ডলারের শাকসবজি রপ্তানির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। বিপরীতে শাকসবজি রপ্তানি হয়েছে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। ওই হিসাবে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১৬ শতাংশ বেশি রপ্তানি হয়েছে। আগের বছরের হিসাবেও রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আগের বছর প্রায় ১০ কোটি ডলারের সবজি রফতানি হয়েছিল। ওই হিসাবে রফতানি প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৬৪.৫৩ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুধু কৃষি খাতের মধ্যেই সর্বোচ্চ তা নয়, বরং পুরো রপ্তানি খাতের মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ। কৃষি বিভাগ, ইপিবি এবং বাংলাদেশ ফ্রুট ভেজিটেবল অ্যান্ড এলাইড প্রডাক্টস এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন সংশ্লিষ্ট সুত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনার মধ্যে বেশ কয়েক মাস শাকসবজি রফতানি বন্ধ ছিল। তারপরও এ খাতে বছর শেষে ৬৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি দেশের সব খাতের রফতানির মধ্যে একক পণ্য হিসেবে চতুর্থ সর্বোচ্চ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শাকসবজি ও ফলমূলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রবাসে অবস্থিত লাখো বাংলাদেশি নিয়মিত দেশি এসব পণ্য চায়। আবার বিদেশিরাও এখানকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় উৎপাদিত কৃষিপণ্যের প্রতি আগ্রহী। ফলে শাকসবজি খাতে প্রতি বছরই বড় প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনা রয়েছে।
সূত্র জানায়, ইপিবির তথ্যানুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১২ কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে দেশ থেকে ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার মূল্যের কৃষিপণ্য রফতানি হয়েছে। তার মধ্যে সবজি ছাড়াও ফলমূল চার লাখ ৯০ হাজার ডলারের রফতানি হয়েছে। যা আগের বছরের চেয়ে ৪৮ শতাংশ বেশি। আর শুকনো খাবার রফতানি হয়েছে ১৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের, যা আগের বছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ কম। ৩ কোটি ৩২ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের মসলা রফতানি হয়েছে। এই খাতেও ১৯ শতাংশ রফতানি কমেছে। তাছাড়া চা রফতানি হয়েছে ৩১ লাখ ২০ হাজার ডলার মূল্যের। ফলে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সবজি রপ্তানি হয়েছিল ৬৫ লাখ ডলার, আগস্টে তা বেড়ে হয়েছে ৭২ লাখ ৪০ হাজার ডলার। তাতে কভিডের কারণে তৈরি হওয়া ঘাটতিও কমে এসেছে। জুলাই মাসে রফতানি ঘাটতি ছিল ২২ শতাংশ। আগস্টে কমে হয়েছে ৯ শতাংশ। চলতি বছর সবজি রপ্তানির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ডলার।
সূত্র আরো জানায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সবজি সংগ্রহ করে সেগুলো একসঙ্গে করা হয়। সেগুলোর কোয়ারেন্টিন সার্টিফিকেটের (স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা সনদ) জন্য আবেদন করে রাজধানীর শ্যামপুর ওয়্যারহাউসে নিয়ে আসা হয়। কৃষি সম্প্রসারণের সংগনিরোধ বিভাগে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শেষে প্যাকিং করে সরাসরি বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। অনেক সময় বিমানবন্দরের ওয়্যারহাউসেও পরীক্ষা করা হয়। তারপর আগে থেকে বুকিং দেয়া যাত্রীবাহী বিমানের কার্গো হোলে নির্দিষ্ট গন্তব্যে তুলে দেয়া হয়। করোনার কারণে যাত্রীবাহী বিমান চলাচল সীমিত হওয়ায় শাকসবজি রফতানি এখন কিছুটা কম। তাছাড়া বন্যার কারণে কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ঘাটতি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দেশেই এখন দাম বেশি। এমন পরিস্থিতিতে রফতানি প্রায় থমকে রয়েছে। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পটোল, বেগুন, বরবটি, চিচিঙ্গা, পান ইত্যাদি পণ্যই বেশি রফতানি হচ্ছে।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ বিভাগ সবজিতে রোগবালাই আছে কিনা তা যাচাই করে। তার ভিত্তিতেই কোয়ারেন্টিন সার্টিফিকেট দেয়া হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যে মান পরীক্ষার সনদ চাওয়া হয় তার ব্যবস্থা এখনো দেশে হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। ওই লক্ষ্যে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানিতে সহযোগিতা করতে একটি বিশেষ ল্যাবরেটরি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওই পরীক্ষাগারে পণ্যের মান পরীক্ষা করে রফতানি সনদ দেয়া হবে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশি কৃষি ও খাদ্যপণ্যের গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়াতেই এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এদিকে সবজি রফতানি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফ্রুট ভেজিটেবল অ্যান্ড এলাইড প্রডাক্টস এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-সম্পাদক গোবিন্দ চন্দ্র সাহা জানান, সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে দেশ থেকে শাকসবজি রফতানি আরো অনেক বেশি হতো। মূলত গ্রীষ্মকালীন সবজিই বেশি রফতানি হয়। আর তা বেশি হয় জুলাই থেকে আগস্ট মাসে। এবার ওই সময়টাতেই করোনা ও বন্যায় রফতানি একেবারেই কমে গেছে। তবে ধীরে ধীরে বাড়ছে। এই খাতে রফতানির বাজার আরো বাড়াতে হলে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার দরকার। কারণ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যে কোয়ারেন্টিন সর্টিফিকেট দেয় তার ওপর অনেক দেশেরই আস্থা নেই।
এ প্রসঙ্গে উদ্ভিদ সংগনিরোধ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক (আমদানি রপ্তানি ও পরীক্ষাগার) মো. ফজলুল হক জানান, সব ধরনের সবজিই এদেশ থেকে রফতানি হয়। আলুর চাহিদাই রয়েছে ৪০ থেকে ৪৩ হাজার টন। সরকারের আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। তবে রফতানির বাজার বাড়াতে হলে উৎপাদনও বাড়াতে হবে। উৎপাদন কম হলে দেশের বাজারে সবজির দাম বেড়ে যায়। তখন রফতানিকারকরা লোকসানের ভয়ে পণ্য রপ্তানি বন্ধ রাখে।