টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালী পয়েন্টে করতোয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ১১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ও ক্ষেতের ফসল। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে প্রবেশ করেছে বন্যার পানি।ফলে রোগী পরিবহনে অ্যাম্বুলেন্সের পরিবর্তে কলাগাছের তৈরি ভেলা ব্যবহার করা হচ্ছে। পানিতে নেমে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নেয়া সম্ভব নয়, তাই হাসপাতাল চত্বরে কলাগাছের তৈরি ভেলায় রোগী পারাপার করছেন কয়েকজন যুবক।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের সামনে হাঁটু পানি আর বাইরে কোমর পানি। হাসপাতালের নিচতলার সব রুমেও হাঁটু পানি। হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার কোনো কমতি নেই। কলাগাছের ভেলায় পারাপারে গত চারদিনে ৩০ জন প্রসূতির ডেলিভারি ও ছয়টি অপারেশন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বর পানিতে থৈ থৈ করছে। প্রায় চার ফুট পানির নিচে হাসপাতালের বাগান, টিউবওয়েল, সাইকেল গ্যারেজসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদটির ওজুখানাও পানির নিচে।
হাসপাতাল থেকে ২০০ গজ দুরে ঢাকাণ্ডরংপুর মহাসড়ক। হাসপাতালে সেবা নিতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছেন। রংপুর মহাসড়ক থেকে হাসপাতালের দিকে তাকালে সড়কের ওপর পানি আর পানি। ফলে রোগীদের পরিবহন হিসেবে অ্যাম্বুলেন্সের পরিবর্তে কলাগাছের ভেলা ব্যবহার করতে হচ্ছে।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচারশহর থেকে হাসপাতালে আসা মোমেনা খাতুন বলেন, আমার মেয়েকে বাচ্চা প্রসবের জন্য হাসপাতালে এনেছি। হাসপাতালের সামনে অনেক পানি তাই কলাগাছের ভেলায় হাসপাতালে প্রবেশ করতে হচ্ছে।
গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার বাসিন্দা আবদুল মালেক জানান, অসুস্থ অবস্থায় আমার ভাতিজাকে গতকাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে এসে পানির কারণে কলাগাছের ভেলা ব্যবহার করতে হচ্ছে।
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রিয়াজ উদ্দিন জানান, আমি মনে করেছিলাম পানির কারণে হাসপাতালে প্রবেশ করতে পারবো না। পরে দেখি হাসপাতালে রোগী পরিবহনে কলাগাছের ভেলা ব্যবহার করা হচ্ছে। ভেলার ওপর কাঠের তক্তা রাখা হয়েছে, যাতে রোগীরা সহজে বসতে পারেন।
কলাগাছের ভেলায় রোগী বহনকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা মানুষকে সেবা দিতে এই উদ্যোগ নিয়েছি। অনেকেই খুশি হয়ে দশ-পাঁচ টাকা দেন। আমরা চাই হাসপাতালে এসে যেন সবাই সেবা পায়, কেউ যাতে ফিরে না যায়। বন্যাকবলিতরা চিকিৎসা সেবা নিয়ে যাতে বাড়ি ফিরতে পারেন তাই এই ভেলা সার্ভিস দিচ্ছি।
ভেলায় রোগী বহনকারী শাওন মিয়া বলেন, হাসপাতাল চত্বরে অনেক পানি। আমরা নিজেরা বন্যার পানিতে ভিজে রোগীদের হাসপাতালে যাতায়াতের ব্যবস্থা করছি। অনেক ডেলিভারির রোগী বা হাত-পা ড্রেসিং করা রোগীকে ভেলায় তুলে পারাপারের ব্যবস্থা করছি।
শহিদুল ইসলাম নামে একজন বলেন, এই হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, রোগী ও রোগীর স্বজনদের দুর্ভোগ কমাতে আমাদের এই কলাগাছের ভেলার অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. শাকিল উদ্দিন জানান, বন্যার কারণে মানুষ অনেক কষ্ট করে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসছে। তাদের পারাপারে কলাগাছের তৈরি ভেলা ব্যবহার করা হচ্ছে। ডাক্তারদের অনেক কষ্ট করে হাসপাতালে আসতে হচ্ছে।
হাসপাতালের স্টোর রুমের দায়িত্বে থাকা মো. মাসুদ মিয়া বলেন, হাসপাতাল চত্বরে অনেক পানি, তাই রোগী ও ডাক্তারদের কলাগাছের ভেলায় করে আসতে হচ্ছে। আমরা অনেক কষ্টে চিকিৎসা সরঞ্জাম রক্ষা করেছি।
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে গাইবান্ধা মহিলা পরিষদের আমাতুর নুর ছড়া বলেন, এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালে যাতায়াতে ভেলা সার্ভিস চালু মানবিকতার অন্যতম উদাহরণ।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মজিদুল ইসলাম ইসলাম বলেন, পানিবন্দি হাসপাতালে যাতায়াতের জন্য কলাগাছের ভেলার বিকল্প নেই। এখানে নৌকা আনার মতো পরিবেশও নেই। স্থানীয়দের কলাগাছের ভেলার এই ব্যবস্থাটি হাসপাতালের রোগী পারাপারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তিনি আরও জানান, গত তিনদিনে এ হাসপাতালে ছয়টি অপারেশন করা হয়েছে। পানিবন্দি থাকা অবস্থায় গত চারদিনে ৩০ জন প্রসূতির ডেলিভারি করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।