মানব জাঁতি মানব সভ্যতার ধারাবাহিক ইতিহাসের ধারায় এমন কিছু দুঃখজনক, বেদনাদায়ক, হৃদয় গ্রাহী ঘটনা সংযোজিত হয়েছে যা অধ্যয়ন করলে মন শুধু ব্যথিত ও মর্মহত হয়। আর এসব ঘটনা সংঘটনের নায়কদের উদ্দোশ্যে মন থেকে বেরিয়ে আসে নানা ধিক্কারজনক উক্তি। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় এমন কিছু মহাস্থানের জীবন এই পূথিবীতে অকালে ঝরে গেছে, যাদের এই অপমৃত্য বিবেকই কোন অবস্থাতেই মেনে নিতে পারে না। মানব জাঁতি ও মানব সভ্যতার চিরকল্যানকামী এ রকম এক মহাপুরুষের নাম সর্বকালের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী, জাতির জনক বর্তমান প্রধান মন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ আগস্ট ছিল জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এ দিনে মানব ইতিহাসের বর্বরতম হত্যা কান্ডের স্বীকার হয় সর্বকালের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। ঘাতকেরা শুধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে খ্যান্ত হননি তার সাথে প্রাণ দিতে হয়ে ছিল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, পুত্র ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, লে. শেখ জামাল, স্কুল ছাত্র ছোট শিশু শেখ রাশেল, পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি কামাল, বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, কৃষকনেতা অব্দুর রব সেরনিয়াবাত, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বেবী সেরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু, আরিফ, আবদুল নঈম খান রিন্টুসহ পরিবারের ১৮জন সদস্যকে হত্য করা হয়। হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিলকে।
শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা দেশে বাইরে থাকায় প্রাণে বেচে যান। ১৫ই অগাস্ট, ১৯৭৫ - শেখ হাসিনা, তাঁর স্বামী ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া আর বোন শেখ রেহানা সেদিন ব্রাসেলস-এ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের কাছে ছিলেন। ব্রাসেলস থেকে ওঁদের প্যারিস যাওয়ার কথা। কিন্তু আগের দিন গাড়ির দরজায় ডক্টর ওয়াজেদের হাত চিপে গিয়েছিল। ওঁরা আলোচনা করছিলেন ওই অবস্থায় প্যারিস যাবেন কী-না। ব্রাসেলসের সময়ে তখন ভোর তখন সাড়ে ছ'টা। সানাউল হকের টেলিফোন বেজে উঠল। অন্য প্রান্তে ছিলেন জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী। হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী, জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত তিনিই জানালেন বাংলাদেশে সেনা বিদ্রোহ হয়েছে সকালে। প্যারিসে না গিয়ে তক্ষুনি জার্মানি ফেরত যাওয়ার কথা বললেন মি. চৌধুরী। যে মুহূর্তে মি. হক শুনলেন যে সেনা বিদ্রোহে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন, তখনই তাঁর দুই কন্যা এবং জামাতাকে কোনও রকম সাহায্য করতে অস্বীকার করলেন। উপরন্তু নিজের ঘর থেকেও তাঁদের চলে যেতে বলেন মি. হক। শেখ মুজিবের প্রয়াণ দিবসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা ওই ঘটনার কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, "আমরা যেন ওঁর জন্য বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম। অথচ শেখ মুজিবই তাঁকে বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়েছিলেন। ওটা একটা রাজনৈতিক নিয়োগ ছিল। ওই খবর পাওয়ার পরে জার্মানি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি দিতেও অস্বীকার করেছিলেন তিনি।" তবে তাঁরা কোনও মতে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর কাছে পৌঁছেছিলেন। তাঁরা সেখানে যাওয়ার আধঘণ্টার মধ্যেই যুগোস্লাভিয়া সফরে আসা বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেনও সেখানে পৌঁছান। সেই বিকেলেই জার্মান সম্প্রচার সংস্থা ডয়েচেভেলে আর অন্য কয়েকজন জার্মান সাংবাদিক রাষ্ট্রদূতের আবাসে গিয়েছিলেন তাঁর মন্তব্য নেওয়ার জন্য। শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ হাসিনা আর তাঁর বোন রেহানা মানসিকভাবে এতটাই বিধ্বস্ত ছিলেন, যে তাঁরা কেউই কোনও মন্তব্য করতে চাননি, কারও সঙ্গে কোনও কথাও বলেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন রাষ্ট্রদূতের আবাসে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কোনও মন্তব্য করেননি সেদিন। তবে রাষ্ট্রদূত মি. চৌধুরী এটা নিশ্চিত করেছিলেন যে শেখ মুজিবের দুই কন্যা তাঁর কাছেই আছেন। এরইমধ্যে যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটো শেখ মুজিবের দুই কন্যা ও জামাতার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ফোন করেছিলেন। কিন্তু এরপরে তাঁরা কোথায় থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছিল না।
হুমায়ূণ রশিদ চৌধুরীর পুত্র নোমান রশিদ চৌধুরী ২০১৪ সালের ১৫ই অগাস্ট 'ডেইলি স্টার' পত্রিকায় 'বঙ্গবন্ধু'জ ডটার্স' (বঙ্গবন্ধুর কন্যারা) শিরোনামের একটি লেখায় স্মৃতিচারণ করেছেন এই ভাবে: "পশ্চিম জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়াই কে পুরীর সঙ্গে আমার বাবার দেখা হয়েছিল একটা কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে। তিনি মি. পুরীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে ভারত কি শেখ হাসিনা আর তাঁর পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারবে? তিনি খোঁজ নিয়ে জানাবেন বলেছিলেন। পরের দিন মি. পুরী আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে তাঁর দপ্তরেই চলে আসেন। "তিনি জানিয়েছিলেন যে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াটা অনেক সময় নেয়। তিনিই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে দিল্লিতে তো বাবার নিজেরই অনেক চেনাশোনা, কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে সেখানে মিশন প্রধান ছিলেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধী আর তাঁর দুই পরামর্শদাতা ডি পি ধর এবং পি এন হাক্সর তো বেশ পছন্দ করেন। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন মি. পুরী।" তাঁর সামনেই মি. চৌধুরী ডি পি ধর এবং পি এস হাক্সরকে ফোন করেন। কিন্তু দুজনেই সেইসময়ে ভারতের বাইরে
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করতে মি. চৌধুরী একটু ইতস্তত করছিলেন। মিসেস গান্ধী একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী আর মি. চৌধুরী একজন সাধারণ রাষ্ট্রদূত। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে তাঁর কয়েক বার সাক্ষাত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বছর তিনেক তাদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিলনা।
রাজনীতিতে তিন বছর অনেকটা লম্বা সময়। আর তারও পরে তখন ভারতে জরুরী অবস্থা চলছে। মিসেস গান্ধী নিজেই ব্যতিব্যস্ত। নোমান রশিদ চৌধুরী লিখেছেন, "যখন কোনও দিক থেকেই কিছু হচ্ছিল না, তখন একরকম শেষ চেষ্টা করে দেখার জন্য বাবা মিসেস গান্ধীর দপ্তরে একদিন ফোন করেই ফেললেন। ওই নম্বরটা বাবাকে ভারতের রাষ্ট্রদূত মি. পুরী দিয়েছিলেন।" "বাবা আশা করেননি যে ফোনটা টেলিফোন অপারেটরের পরে অন্য কারও কাছে যাবে! কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই ফোনটা ইন্দিরা গান্ধী নিজেই তুলে ছিলেন। বাবা মিসেস গান্ধীকে গোটা বিষয়টা খুলে বললেন। তক্ষুনি বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজী হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।" জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত মি. পুরী ১৯শে অগাস্ট হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীকে জানিয়েছিলেন যে দিল্লি থেকে নির্দেশ এসেছে শেখ মুজিবের দুই কন্যা এবং তাঁদের পরিবারকে সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। ২৪শে অগাস্ট এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে শেখ হাসিনা তাঁর পরিবারের বাকিরা দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নেমেছিলেন। মন্ত্রিপরিষদের একজন যুগ্ম সচিব তাঁদের স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন। প্রথমে ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি 'সেফ হাউস'-এ তাঁদের রাখা হয়েছিল। পরে ডিফেন্স কলোনির একটি বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। দশ দিন পরে, ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ভারতের বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা 'র'-এর একজন কর্মকর্তা তাঁদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আবাস ১ নম্বর সফদরজং রোডে পৌঁছান। দেখা হওয়ার পরে ইন্দিরা গান্ধীকে শেখ হাসিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "১৫ই অগাস্ট ঠিক কী হয়েছিল?" সেখানে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, তাঁর পরিবারের আর কেউ জীবিত নেই। এটা শুনেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার জীবনীকার সিরাজউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, "ইন্দিরা গান্ধী হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তোমার যা ক্ষতি হয়েছে, তা তো পূরণ করা যাবে না। তোমার তো এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। আজ থেকে ছেলেকে নিজের বাবা আর মেয়েকে নিজের মা বলে মনে কোরো।"সিরাজউদ্দিন আহমেদের তথ্য অনুযায়ী শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানকালে ওই একবারই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। তবে 'র'-এর গোয়েন্দা অফিসারদের কথা অনুযায়ী শেখ হাসিনা আর ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে আরও কয়েক বার দেখা হয়েছিল। প্রথম সাক্ষাতের দিন দশেক পরে শেখ হাসিনাকে ইন্ডিয়া গেটের কাছে পান্ডারা পার্কের 'সি' ব্লকে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছিল। ওই ফ্ল্যাটে তিনটে শোওয়ার ঘর আর কিছু আসবাবপত্রও ছিল। পরে তিনি নিজেই কিছুকিছু আসবাব কিনেছিলেন। তাঁর ওপর কড়া নির্দেশ ছিল যে তিনি যেন ঘরের বাইরে না যান, অথবা কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ না করেন। তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য একটা টেলিভিশন সেটও দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়ে ভারতের টেলিভিশনে শুধুমাত্র দু'ঘণ্টার জন্য দূরদর্শনের অনুষ্ঠান প্রচারিত হত। 'র'-এর একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলছিলেন, "শেখ হাসিনার নিরাপত্তার জন্য দু'জনকে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সত্য ঘোষ নামের এক ইন্সপেক্টর। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল। অন্যজন ছিলেন ১৯৫০ সালের ব্যাচের ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস কর্মকর্তা পি কে সেন। ঘটনাচক্রে ইন্সপেক্টর সেনকে 'কর্নেল' হিসাবে, আর পদাধিকার বলে তাঁর থেকে অনেক উঁচুতে, আইজি র্যাঙ্কের কর্মকর্তা পি কে সেনকে 'ইন্সপেক্টর' হিসাবে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে রাখা হয়েছিল।এই দু'জন অফিসারই ছায়ার মতো শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকতেন।
শেখ হাসিনা বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর
স্বামী ডক্টর ওয়াজেদ মিয়াকে ১৯৭৫ সালের ১লা অক্টোবর পরমাণু শক্তি বিভাগে ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছিল। 'র'-এর ওই প্রাক্তন কর্মকর্তা বলছিলেন, "শেখ হাসিনার সব খরচ ভারত সরকারই দিত। যদিও সেটা খুব সামান্যই ছিল। টাকাটা কলকাতায় তাঁর এক পরিচিত চিত্তরঞ্জন সুতারের মাধ্যমে দেওয়া হত।"
চেষ্টা করা হয়েছিল শেখ হাসিনা যে দিল্লিতে আছেন, সেই খবরটা যাতে কেউ না জানতে পারে। তবে বাংলাদেশের সরকার তাঁর অবস্থান জেনে গিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমান আর তাঁর স্ত্রী দেখা করতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানার সঙ্গে। দুই বোন তাঁদের জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছিলেন। শেখ রেহানার সে বছরই দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাবলীর জন্য তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে শান্তিনিকেতনে তাঁর ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে নিরাপত্তা-জনিত কারণে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছিল। ২৪শে জুলাই, ১৯৭৬ - শেখ রেহানার বিয়ে হয় লন্ডন-প্রবাসী শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে। কিন্তু শেখ হাসিনা এবং তাঁর স্বামী ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি।
এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বই 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান'-এ লিখেছেন, "রেহানাকে দিল্লিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে কথা বলার জন্য শেখ হাসিনা আর ডক্টর ওয়াজেদ ১৯৭৭ সালে মোরারজী দেশাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। শেখ রেহানাকে দিল্লি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন মি. দেশাই। তিনি ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দিল্লি এসেছিলেন। পান্ডারা পার্কের ফ্ল্যাটে শেখ হাসিনার সঙ্গেই ছিলেন তিনি।" তবে ধীরে ধীরে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার ব্যবস্থা থেকে হাত গোটাতে শুরু করেছিলেন মোরারজী দেশাই। সিরাজউদ্দিন আহমেদ লিখছেন, "ধীরে ধীরে ডক্টর ওয়াজেদ আর হাসিনার ওপরে এরকম চাপ তৈরি করা হচ্ছিল, যাতে তাঁরা নিজেরাই ভারত ছেড়ে চলে যান। প্রথমে তো তাঁর ফ্ল্যাটের বিদ্যুতের যে বিল দিয়ে দেওয়া হত, সেটা বন্ধ হল। তারপর গাড়ির ব্যবস্থাও তুলে নেওয়া হল। "ডক্টর ওয়াজেদ নিজের ফেলোশিপটা এক বছর বাড়ানোর আবেদন করেছিলেন। প্রায় তিন মাস তার কোনও জবাব আসেনি। সেকারণে তাঁকে বেশ আর্থিক সমস্যায়ও পড়তে হয়েছিল। শেষমেশ মোরারজী দেশাই অবশ্য ঠিক এক বছরের জন্য তার ফেলোশিপ বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছিলেন।"
শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা সেসময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় বেঁচে যান। পরবর্তীকালে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে ৬ বছর ভারতে অবস্থান করেন।
সে যাই হোক কোন বাধাই কারো মেধাকে আটকিয়ে রাখতে পরে না।
বিভিন্ন সমস্যা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তিনি সোনার বাংলার প্রধান মন্ত্রী। গত ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর ০৭ জানুয়ারি ২০১৯ শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর ১২ জানুয়ারি শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
১৯৯৬ সালের ২৩ জুন তিনি প্রথম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সে বছরের ১২ জুনের সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল।
২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তাঁর দল আওয়ামী লীগ পরাজয় বরণ করে। শেখ হাসিনা বিরোধীদলের নেতা নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামাত সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে জটিলতা সৃষ্টি করলে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। প্রায় ২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ঐ সরকার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। এই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এর আগে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনা ৩টি সংসদীয় আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই নির্বাচনের পরেই দেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। শেখ হাসিনা নব্বইয়ের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং এই আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়।
১৯৯১ সালের সংসদীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনা পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলসহ সকলকে সংগঠিত করেন।
১৯৯৬ সালে বিএনপি’র ভোটারবিহীন নির্বাচনের বিরুদ্ধে তিনি গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়।
মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় শেখ হাসিনা সবসময়ই আপোষহীন। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনায় দায়িত্ব নিয়ে তাঁর সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল স্থাপনের জন্য আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় স্থাপিত ট্রাইবুনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে এবং রায় কার্যকর করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ৫ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শেখ হাসিনা। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রসংসদের সহসভাপতি ছিলেন। তিনি এই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি ছিলেন। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই শেখ হাসিনা সকল গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডে থেকে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার পরপরই তিনি শাসকগোষ্ঠির রোষানলে পড়েন। তাঁকে বারবার কারান্তরীণ করা হয়। তাঁকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা করা হয়।
১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাঁকে আটক করে ১৫ দিন অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাঁকে দু’বার গৃহবন্দী করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২রা মার্চ তাঁকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দী ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ১১ নভেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দী হন। ১৯৯০ সালে ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাবজেলে পাঠায়। প্রায় ১ বছর পর ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন।
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাঁকে লক্ষ করে পুলিশের গুলিবর্ষণ। এতে যুবলীগ নেতা নূর হোসেন, বাবুল ও ফাত্তাহ নিহত হন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাঁকেসহ তাঁর গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ করে এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় শেখ হাসিনা অক্ষত থাকলেও ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শহীদ হন। লালদীঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাঁকে লক্ষ্য করে ২বার গুলি বর্ষণ করা হয়। জনসভা শেষে ফেরার পথে আবারও তাঁর গাড়ি লক্ষ করে গুলি বর্ষণ করা হয়।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বারবার হামলা করা হয়। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে তাঁকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে তাঁর কামরা লক্ষ করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দু’টি বোমা পুতে রাখা হয়। শেখ হাসিনা পৌঁছার পূর্বেই বোমাগুলো সনাক্ত হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বিএনপি সরকারের সময় সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট। ঐদিন বঙ্গবন্ধু এভিন্যুয়ে এক জনসভায় বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাঁকে লক্ষ করে এক ডজনেরও বেশি আর্জেস গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। লোমহর্ষক সেই হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ তাঁর দলের ২২ নেতাকর্মী নিহত হন এবং ৫ শোর বেশি মানুষ আহত হন। শেখ হাসিনা নিজেও কানে আঘাত পান।
শত বাধা-বিপত্তি এবং হত্যার হুমকিসহ নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা ভাত-ভোট এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ অর্জন করেছে গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতা। বাংলাদেশ পেয়েছে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা। শেখ হাসিনার অপরিসীম আত্মত্যাগের ফলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
মো: হায়দার আলী সভাপতি জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা