কোভিড-১৯ তথা করোনা ভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্ব আজ টালমাতাল। এই প্রাণঘাতি ভাইরাস মানুষের জীবণ ও জীবিকাকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে সারা বিশ্বে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক সুদুরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। করোনা ভাইরাসের করাল থাবা থেকে বাঁচার জন্য মানুষ নিজেদের সুরক্ষিত রেখে জীবণের চাকা সচল রাখার জন্য ইতিমধ্যে স্বাভাবিক কার্যক্রম সীমিত আকারে শুরু করেছে। দেশের অন্যান্য সেক্টর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় নিজেদের নিয়োজিত করলেও দেশের শিক্ষা কার্যক্রম কার্যত বন্ধ রয়েছে। করোনার প্রভাব থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখার পদক্ষেপ হিসাবে গত ১৭ মার্চ ২০২০ তারিখে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যা অদ্যাবধি বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পড়া লেখায় মনোনিবেশ ধরে রাখার জন্য বেতার ও সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে দুর শিখন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়াও শিক্ষকরা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। করোনা পরিস্থিতি আয়ত্বের মধ্যে না আসায় ইতিমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপণী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা বাতিল করেছে সরকার। সম্প্রীতি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী করোনার কারণে ঝুলে থাকা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন শিক্ষার্থীদের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সকল শিক্ষার্থীদের অটো পাস বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হবে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর এই মুল্যবান ঘোষণার মাধ্যমে এ্ইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ছিলো তা নিমিষেই কেটে গেছে। তবে মাননীয় মন্ত্রীর প্রদত্ত ঘোষণার প্রেক্ষিতে সারাদেশে পরীক্ষা নেওয়া না নেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে চলছে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। এ বিষয়ে আমার নিসম্ব কিছু মতামত আমি আজকের লেখায় তুলে ধরতে চাই।
১৯৭১ সালের ৫বছর পর আমার জন্ম হওয়ায় সে বছর এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে কি ঘটেছিল আমার জানা নেই। তবে সে সময় ৫ম শ্রেণী পাশ করে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ায় আমার ২জন খালামনিকে এখনও পাড়া প্রতিবেশীর নানারকম বাজে মন্তব্য শুনতে হয়। এর মধ্যে একজন খালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর অবসর নিয়েছেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের এসএসসি পাশের সার্টিফিকেট হওয়ায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা অফিসার কাহারো নিকটই তিনি শিক্ষকের যোগ্য মর্যাদা পাননি। এই মর্যাদা হীনতার গ্লানি নিয়েই তাকে জীবণ পার করতে হচ্ছে। একজন শিক্ষক সারা জীবণ শিক্ষকতা করার পরও যদি সার্টিফিকেট ১৯৭১ সালের হওয়ায় শিক্ষকের মর্যাদা না পান তাহলে এর চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে। আমার মনে হয় যারা ১৯৭১ সালে এসএসসি পাশ করেছে তাঁরা সকলের কমবেশী এ ধরণের অনাকাংখিত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন।
এবার আসি আমার নিজের কথায়। আমি ১৯৯২ সালে এসএসসি পরিক্ষার্থী ছিলাম। আপনারা হয়ত সকলেই অবগত আছেন ১৯৯২ সাল ছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসে নৈবত্তিক পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণের প্রথম বছর। আমরা ক্লাস নাইনে থাকতেই যার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। বর্তমান সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে যেমন শুরুর দিকে শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরণের আতংক বিরাজ করছিল তেমনি আমরাও নৈবত্তিক পদ্ধতি নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ছিলাম। শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর শিক্ষকদের অনিশ্চয়তা দুর করতে অবশেষে শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিটি বিষয়ের জন্য ৫শত করে প্রশ্ন দিয়ে প্রশ্ন ব্যাংক নির্ধারিত করে দেন। যাই হোক প্রশ্ন ব্যাংক রপ্ত করে আমরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি এবং আশানুরুপ ফলাফল নিয়ে আসতে সক্ষম হই। নির্ধারিত প্রশ্ন ব্যাংক থাকায় এবং নৈবত্তিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা হওয়ায় সে বছর পাশের হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কয়েক পার্সেন্ট বেশী ছিলো। আর এ কারণে যদি কোন শিক্ষার্থীকে কেউ জিজ্ঞাসা করতো তোমার রেজাল্ট কি? প্রতি উত্তরে শিক্ষার্থী যদি বলতো পাশ করেছি বা অমুক ডিভিশন পেয়েছি তাহলে বিপরীত দিক থেকে উত্তর আসতো চেয়ার-টেবিল পাশ করেছে তুমি কি আর না পাশ করে পারো? তাহলে একজন শিক্ষার্থী ২বছর ধরে পড়ালেখা করে নৈবত্তিকের নতুন পদ্ধতি আয়ত্ব করে এক ঝুঁড়ি আতংক মাথায় নিয়ে রীতিমতো পরীক্ষা দিয়েও যদি এমন মন্তব্য শুনতে হয় তবে এর চেয়ে গ্লানি একজন শিক্ষার্থীদের জন্য আর কি হতে পারে। আমি মনে করি পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিষয়ে মানুষের জ্ঞানের ঘাটতির কারণে এ ধরণের মন্তব্য শিক্ষার্থীদের শুনতে হয়েছে। মানুষ মনে করেছে নৈবত্তিক বা টিক চিহ্ন দেওয়া কোন পরীক্ষ্ইা নয়। যে কেউ এ কাজ করতে পারবে।
প্রিয় পাঠক, আমার উপরোক্ত উদাহারণ দুটি উপস্থাপনের উদ্দেশ্য হলো রীতিমতো পরীক্ষা দিয়েও যদি ১৯৭১ ও ১৯৯২ সালের এসএসসি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের গ্লানি ও অপমানজনক কথা শুনতে হয় তাহলে পরীক্ষা না দিয়েই যদি কোন শিক্ষার্থী সাটিফিকেট পেয়ে যায় তাহলে তাদের সেই সার্টিফিকেট মানুষ কিভাবে গ্রহণ করবে বা কিভাবে মুল্যায়ন করবে। পরবর্তিকালে ভর্তি পরীক্ষা, চাকুরীর আবেদন ও ইন্টারভিউ, বিবাহ, বিদেশ গমন ইত্যাদি ক্ষেত্রে যদি ২০২০ সালে এইচএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট সরিয়ে রাখা হয় এবং অবমুল্যায়ন করা হয় তাহলে এই গ্লানি ও অপমান তাঁরা কিভাবে সইবে। জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে এইচএসসি’র মতো গুরুত্বপুর্ণ একটি পরীক্ষার ফলাফল প্রদান কতটা যুক্তিযুক্ত আর কতটা নিরপেক্ষ হবে সেটাও আমাদের গভীর ভাবে ভেবে দেখা দরকার। কারণ এমনও হাজার শিক্ষার্থী আছে যারা কোন কারণে এসএসসিতে ভালো ফলাফল করতে না পারায় এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আকাংখায় আদাজল খেয়ে পড়া লেখা করেছে। কিন্তু জেএসসি আর এসএসসি ফলাফলের উপর ভিত্তি করে এইচএসসির ফলাফল দেওয়া হলে তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে। জীবণের উপর তাঁরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে। অপরদিকে এই সিদ্ধান্তের বিপরীত চিত্রও আছে, অতীত পারফরমেন্সের কারণে যারা এইচএসসি পাশ করার স্বপ্ন কখনও দেখেনি তাঁরাও অনায়াসে উচ্চ মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট নিয়ে যাবে। যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।
শিক্ষার্থীদের করোনা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সরকার ঝুলে থাকা এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করেছে। ঝুঁকি বিবেচনায় এটা অবশ্যই সরকারের সুদুরপ্রসারী সিদ্ধান্ত। কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখা দরকার পিএসসি, জেএসসি আর এইচএসসি কে একই পাল্লায় মাপা হলে সেটা হবে এক ধরণের ভুল। এইচএসসি পরীক্ষা হুট করে বাতিল না করে আরো কিছু সময় নেওয়া যেতো বলে আমি মনে করি। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার জন্য পরীক্ষা বাতিল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হলেও প্রকৃতপক্ষে আমরা কতটুকু শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা দিতে পেরেছি সেটাও ভেবে দেখা দরকার। কারণ বর্তমানে সারাদেশে সকল সেক্টরে স্বাভাবিক কর্মকান্ড শুরু হয়েছে। প্রতিদিন অফিস আদালত, হাট-বাজার, পথে-ঘাটে যে লাখো মানুষ বিচরণ করছে তাঁরা প্রত্যেকেই কোন না কোন শিক্ষার্থী পরিবার থেকে এসেছে। পরিবার থেকে সকালে বের হয়ে কাজ সেরে দিন শেষে পুনরায় পরিবারে ফিরে গিয়ে সন্তানদের সাথে মেলামেশা করছে। তাদের এই সন্তানরা প্রত্যেকে কোন না কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও দেশের অধিকাংশ স্থানেই প্রাইভেট টিনশনি কিন্তু বন্ধ নেই। মফস্বল শহরে সকাল আর বিকেলে শিক্ষার্থীদের দল বেঁধে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া দেখেই বোঝা যায় তাঁরা আসলে কতটা সুরক্ষার মধ্যে আছে। তাহলে আমার প্রশ্ন হলো শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে এবং পরীক্ষা বাতিল করে কি সত্যিই আমরা শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছি। শিক্ষার্থীদের ঘরে আটকে রেখে শিক্ষক আর অভিভাববকদের মাঠে ছেড়ে দিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছি তা অবশ্যই আমাদের ভেবে দেখা দরকার।
এইচএসসি সার্টিফিকেট শিক্ষার্থীদের জীবণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করে তাঁদের উচ্চ শিক্ষার ভর্তির সুযোগ। এই পরীক্ষার ফলাফল তাদের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে আসে। এসএসসি পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থীরা প্রায় ২ বছরের অধিক সময় পড়ালেখা করে পরীক্ষার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছে। তাঁরা যে কোন সময় পরীক্ষায় বসতে প্রস্তুত। আর সেই পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ না পেয়ে অটো পাস নিয়ে পরবর্তি জীবণে যদি তাঁদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তবে এটা তাদের জন্য হবে চরম অবমাননাকর। যা হবে সত্যিই দুঃখজনক।
এখন প্রশ্ন হলো এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে না এটা তো মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েই দিয়েছেন। এখন আর কি করার আছে। অবশ্যই করার আছে। সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা যেমন মন্ত্রীর আছে তেমনি বাস্তবতার নিরীখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করারও ক্ষমতা আছে। কয়েকজন অভিভাবক আর বিজ্ঞজনের কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করে যতটা বুঝেছি তাঁরা সকলেই পরীক্ষা গ্রহণের পক্ষে। তাই পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা কার্যকর করার পূর্বে দয়া করে অভিভাবকদের সাথে সংলাপ করুন, তাদের মতামত গ্রহণ করুন। চলমান পদ্ধতিতে যদি পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব নাও হয় তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কলেজ ভিত্তিক পরীক্ষা গ্রহণ করে ফলাফল প্রদান করা হোক। এতে অটো পাসের অনাকাংখিত অবমাননা থেকে শিক্ষার্থীরা রক্ষা পাবে বলে আমি মনে করি। এছাড়া এই অটো পাস শিক্ষার্থীদের জীবণে অটো বাঁশ হয়ে নেমে আসতে পারে।
(মো. আতাউর রহমান, উন্নয়নকর্মী ও সাংবাদিক)