আসলে প্রতিটি রাষ্ট্রেই ভেতরে ভেতরে একটা বিবর্তন চলে। চলে বিপ্লবের ছায়াপাত। মানুষ কখনো তা দেখে, কখনো তা দেখে না। এই বিবর্তন মার্কিন মুল্লুকে যেমন হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে সৌদি আরবেও। বাংলাদেশে যেমন হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে আফ্রিকায়ও। মূল চেতনা একই। ধরন ভিন্ন।
মানুষের জীবন প্রতিদিনই বিশ্বায়ন চায়। চায় নান্দনিক পরিবর্তন। এটা সমাজ পরিবর্তনের জন্য দরকারিও বটে। আছে এর পাশাপাশি সমস্যাও। পাল্লা দিয়ে এর সঙ্গে বেড়ে যায় অপরাধও। মানুষ কিংবা সমাজের বিশ্বায়ন হলো একটি প্রক্রিয়া। যার সাহায্যে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংস্থা বা এজেন্সি বিশ্বজুড়ে নিজেদের মধ্যে নানা প্রকার সম্পর্ক গড়ে তোলে। সম্পর্ক স্থাপনের পেছনে থাকে নানা ধরনের কারকের সক্রিয় অংশগ্রহণ। কারকগুলো নিজেদের মধ্যে যখন সম্পর্ক গড়ে তোলে তখন তা নিজেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। বিশ্বায়নের সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের নানাবিধ বিষয় যেমন- অর্থনীতি, বাণিজ্য, যোগাযোগ, রপ্তানি, শিল্পায়ন ইত্যাদি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এটা আমরা জানি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মূলত রাজনৈতিক ধারণার সঙ্গে জড়িত। বেশিরভাগ বিশ্লেষক বিশ্বায়ন ধারণাটিকে অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মনে করে এর অনুপুঙ্খ আলোচনায় বসেন, যা একেবারে অযৌক্তিক নয়। কারণ সাম্প্রতিককালে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জনতা ও শিক্ষিত মহল বিশ্বায়নকে অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে দেখে থাকেন। বিশ্বায়নকে তাই উৎপাদন এবং মূলধনের আন্তঃরাষ্ট্রীকরণ বলে গণ্য করার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই আন্তঃরাষ্ট্রীকরণকে বৈধ করে তোলার ব্যবস্থা করে। তারা বদলে দিতে চাইছে একলা চলো’ নীতি। কানেকটিভিটি মানুষকে দেখাচ্ছে অন্য পৃথিবীর দরজা।
অন্য একটি সংজ্ঞায় বিশ্বায়নকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্বায়ন হলো বাজার-চালিত একটি প্রক্রিয়া, যা বহিষ্কারকে স্বাগত জানায় অথবা বাধা দেয়। কিন্তু পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বিশ্বায়ন বলতে বোঝায় ক্রমবর্ধমান খোলামেলা পরিবেশ, উন্নত ধরনের পারস্পরিক জীবনের বিশ্বায়ন, মানুষের স্বপ্নের পৃথিবী নির্ভরশীলতা এবং সমন্বয়। বর্তমানে অনেকে বিশ্বায়ন বলতে অর্থনৈতিক লেনদেন এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৎপরতা বৃদ্ধি বুঝিয়ে থাকেন। অর্থাৎ জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার আওতায় অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য থাকলে তার আকার ও চরিত্র যে রূপ নেবে বিশ্বায়নের গ-ির মধ্যে এলে এগুলো সম্যক বৃদ্ধি পাবে। এবার আসি বিশ্বায়নের এই সময়ে মানুষের ভাগ্য বিষয়ে। নিউইয়র্কের পাতাল রেল দিয়ে চলাচলের সময় ট্রেনের কামরায় একটি উদার আহ্বান প্রায়ই চোখে পড়ে। নিউইয়র্ক মহানগরীর নাগরিকদের প্রতি একটি অনুরোধ করছেন। তিনি বলছেন, যাদের গৃহপালিত কুকুর আছে, তারা যেন কুকুরগুলো সিটির সুনির্দিষ্ট দপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেন। এজন্য একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের ফিও পরিশোধ করতে হয়। দিনে দিনে কুকুরের রেজিস্ট্রেশন বিষয়টির গুরুত্ব বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ধনিকেরই পালিত কুকুরের উচ্চ অঙ্কের ইন্স্যুরেন্স করা থাকে। কয়েক বছর আগের ঘটনা। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন এক ধনকুবের। সঙ্গে ছিল তার প্রিয় কুকুর। কুকুরটি মানসিকভাবে ছিল অসুস্থ। ফলে কুকুরটি কামড়ে দিয়েছিল একজন পথচারীকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে গিয়েছিল ওই পথচারীর। তিনি শিগগিরই ফোন করেছিলেন পুলিশে। পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল সব কটি পর্ব সেরে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন ওই পথচারী। ক্ষতিপূরণের মামলা করেছিলেন ওই ধনকুবেরের বিরুদ্ধে। আদালতের রায়ে দেড় মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন তিনি। না, দেড় মিলিয়ন ডলার ওই ধনকুবেরের নিজ পকেট থেকে পরিশোধ করেননি। পরিশোধ করেছিল কুকুরের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। তারপরও ধনকুবের কুকুরটি নিয়ে ছিলেন মহাআনন্দিত। সংবাদটি ওই সময়ে নিউইয়র্কে সাড়া জাগিয়েছিল।
মার্কিনিরা কুকুরপ্রিয় জাঁতি হিসেবে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছে বিশ্বব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নগরীতে কুকুর-বিড়ালের অভিজাত দোকানগুলো দেখলে চমকে উঠতে হয়। কুকুর-বিড়ালের খাবারের দোকান, পরিচর্যা কেন্দ্র, হাসপাতাল অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে চলে যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকের কাছে কুকুর-বিড়াল তাদের সন্তানতুল্য। অনেক মার্কিনি প্রকৃত পিতৃত্ব কিংবা মাতৃত্বের স্বাদ নিতে ভয় পান। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা দত্তক হিসেবে সন্তান গ্রহণ করে সে ইচ্ছে পূরণ করে থাকেন। আর যারা তাও পারেন না, তারা প্রিয় কুকুর-বিড়ালটিকে বুকে আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। অতিসম্প্রতি আবারো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কুকুর-বিড়াল।
জাতিসংঘের একটি সমীক্ষা জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকানরা কুকুর-বিড়াল পোষার খাতে যে অর্থ ব্যয় করে তার অর্ধেক দিয়ে বিশ্বের ছয় বিলিয়ন মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জল এবং স্যানিটেশনের সুব্যবস্থা করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ পরিচালিত এ জরিপে আরো দেখা গেছে, ইউরোপিয়ানরা প্রতি বছর মদপান বাবদ যে অর্থ ব্যয় করে এর দশ ভাগের এক ভাগ দিয়ে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব। অথবা ইউরোপিয়ানরা এক বছর আইসক্রিম খাওয়া থেকে বিরত থাকলে ওই অর্থ বিশুদ্ধ পানীয়জলের সংকট মোকাবেলায় যথেষ্ট হতে পারে। জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশুদ্ধ পানীয়জলের অভাবে প্রতি বছর বাইশ লাখ মানুষ ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়।
বিবর্তন মানুষকে এগিয়ে দেয় যেমনি তেমনি পিছিয়েও দেয়। না আমি কুকুর প্রেমের বিরুদ্ধে বলছি না। কিন্তু বিশ্বে এখনো যে কোটি কোটি মানুষ না খেয়ে আছে, সে কথা ভাববে কে? আর এ জন্যই সৌদি রাজতন্ত্রের ওপর মানুষ যেমনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে, তেমনি মার্কিনি গণতন্ত্রও বিতর্কিত হচ্ছে মানুষে মানুষে।
বিশ্বে পানি সংকট একটি বিরাট বিষয়। অনেক দেশেই মানুষ কোনো না কোনোভাবে দূষিত পানি ব্যবহার করে চলেছে। মানবাধিকার এবং গণহিতৈষীপূর্ণ যত বড় বড় বুলি আওড়ানোই হোক না কেন, বিশ্বের নিতান্ত গরিব মানুষগুলোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কতটা উদার? একুশ শতকে এসেও এর সঠিক জবাব খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনো। যায়নি কারণ যুক্তরাষ্ট্র কিছুকিছু ব্যাপারে এখনো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে না।
একথা আমরা সবাই কমবেশি জানি খাদ্যে অতিরিক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ যুক্তরাষ্ট্র তাদের উদ্বৃত্ত খাদ্য বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দেয় না। অর্থনৈতিক বাজার সমতার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সব সময়ই বিবেচ্য হিসেবে ছিল এবং আছে। এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য জাহাজ বোঝাই করে সমুদ্রে গিয়ে ফেলা দেয়া কিংবা ফলন্ত শস্যের মাঠের মালিক কৃষককে তার ফসলের মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করে ফসল মাঠেই জ্বালিয়ে ফেলার মাঝে কী কৃতিত্ব থাকতে পারে? না কোনো কৃতিত্ব নেই। আছে বিশ্বে ধনী এবং দরিদ্র্যের বৈষম্যকে জিইয়ে রাখার অদম্য স্পৃহা। আছে অর্থনৈতিক বাজারদর চাঙ্গা রাখার নামে একটি শ্রেণিকে নিষ্পেষণ করা। একজন মানুষের কতটুকু স্বাধীনতা থাকলে তাকে ব্যক্তিস্বাধীনতার সংজ্ঞায় ফেলা যাবে তা নিয়ে বিতর্ক চলছে বিশ্বের অনেক দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় সংস্থা, অনাথ আশ্রম, হাসপাতালগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিষ্ঠ হওয়া কোনো সন্তানকেই রাস্তায় ফেলে দিতে পারবে না তার মা-বাবা। প্রয়োজনে সরকারের হাতে তুলে দিতে পারে। সরকার ওই নবজাতকের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবে। কারণ কারো ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে সদ্য জন্ম নেয়া একজন নাগরিকের ওপর এমন আচরণ কাম্য হতে পারে না। অপচয়কেও এক ধরনের স্বাধীনতা, প্রাচুর্যের বড়াই বলে গণ্য করা হয় আমেরিকায়। অনেকে না বুঝেই অপচয়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ভাবতে কষ্ট হয়, এসব মানুষ যদি তাদের এই অপচয়কৃত অর্থটি বিশ্বের দরিদ্র মানুষের জন্য দান করে দিতো! অনেক বাংলাদেশি আমেরিকানকে জানি, যারা হৃদয় দিয়ে এ বিষয়টিকে অনুধাবন করেন। বাংলাদেশি আমেরিকানদের নিজ মাতৃভূমির জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছাও আছে। কিন্তু সে সুযোগ কোথায়? শুধু নিউইয়র্ক নগরীতেই প্রায় দেড় শতাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে বাঙালিদের। শীত মৌসুমে এসব সংগঠন স্বল্প ব্যবহৃত শীতের কাপড় সংগ্রহ করে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পাঠাতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পাঠাবেন কীভাবে? বাংলাদেশ সরকার যদি নিজ ব্যয়ে বিনামূল্যে প্রাপ্ত এসব কাপড় বাংলাদেশে বহন করে নিয়ে গিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বণ্টনের ব্যবস্থা করত তবে অনেক প্রবাসীই এমন মহতী কাজে এগিয়ে আসতেন।
বাংলাদেশেও অনেক বিপ্লবী আছেন, যারা টেবিল চাপড়ে রাজা-উজির মারেন। লাল পতাকার হাওয়া গায়ে লাগান। কিন্তু মানবিক কোনো ইস্যুতে তাদের পাওয়া যায় না। আজকের সমাজকে এসব বিষয় চিহ্নিত করতে হবে। আমরা দেখেছি, ধর্মের লেবাস দিয়ে বিভিন্ন দেশে মানুষের অগ্রসরমানতাকে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তা রুখতে হবে। সমকালে দাঁড়িয়ে মধ্যযুগের দোহাই দেয়া উচিত নয়। মানুষে মানুষে সাম্যতার ভারসাম্য তাই আজ কালের দাবি হয়েই থেকে যাচ্ছে। মানবতা রক্ষা করা যাবে না যদি মানুষের হৃদয়ের মানবিক সমুদ্রকে আরো জাগানো না যায়। আর সে উদ্যোগ নিতে হবে প্রতিটি মানুষকেই। শিকড়ের সন্ধান করতে হবে। করতে হবে ‘দ্য রুটস’ খ্যাত একেকজন অ্যালেক্স হ্যালির মতো আত্মানুসন্ধান।
মানুষ বিশ্বায়নকে নিতে চাইছে তার হাতের মুঠোয়। মোবাইল ফোন এখন একটি শক্তিশালী ডিভাইস। তা দিয়ে অনেক ভালো কাজের ক্যাম্পেইন করা যায়। প্রজন্মকে এ সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। জীবন স্বপ্নের পরিচর্যা চায়। তা না হলে মানুষে মানুষে সৃষ্টির সিঁড়ি তৈরি হয় না। সম্প্রীতি মানুষকে এগিয়ে নেয়। দেশপ্রেম মানুষকে আলোকিত করে। যত আঁধার, তা কেটেই উদ্ভাসিত হতে হবে প্রজন্মকে।
তাহলে কি বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে, পৃথিবীতে কি আর কোন বিপ্লব হওয়ার সম্ভাবনা নেই, ঠিক তাই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যেহেতু বিজ্ঞান আর তাই একদিন ফিরে আসবে মানুষের মধ্যে সমতা তথা আধুনিক সাম্যবাদ। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যদি সত্যিই বিজ্ঞান হয় তাহলে পুঁজিবাদের পর সমাজতন্ত্র হবেই। এবং সমাজতন্ত্র পেরিয়ে আধুনিক সাম্যবাদ দিকে ধাবিত হবে সমাজ। বিপ্লব নয় বিবর্তনই আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দিকে ফিরে যাবে। এবং সেটার আলামত এখন পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। নির্বাচন এর মাধ্যমে সমাজ ঠিক করে নিচ্ছে, কারা নেতৃত্ব দেবে একবিংশ শতাব্দির প্রযুক্তি নির্ভর সমাজকে। দ্বান্দিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, মানুষের মধ্যে শ্রেণীগত দ্বন্দ আর থাকবে না, সমাজের এই দ্বন্দহীন অবস্থা না থাকলে তাহলে দ্বন্দমুলক বস্তুবাদ বিজ্ঞান হিসাবে কিসের সাথে কিসের দ্বন্দ হবে তাই এখন ভাববার বিষয়। যেহেতু দ্বন্দ থাকবেই তাহলে কিসের দ্বন্দ তা এখন সুস্পষ্ট যে পৃথিবীর সাথে অন্যান্য গ্রহ - উপগ্রহদের দ্বন্দ।
বিপ্লব নয় বিবর্তনই যা অটোম্যাটিক্যালি সমাজ প্রগতির মাধ্যমেই বিকশিত হবে সমাজ। মানুষের মধ্যে থাকবেনা শ্রেণী শোষণ, থাকবেনা বৈষম্য পার্থক্য। সমাজ বিজ্ঞানের নিজস্ব নিয়মে পরিচালিত হবে সমাজ এবং গড়ে উঠবে বর্ণহীন বিভেদহীন শ্রেণীহীন শোষণহীন বৈষম্যহীণ এক আধুনিক সমাজ। সমাজের কোন স্তরকে যেমন পাশ কাটিয়ে নুতন কোন সমাজ বা সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ করা যায় না, ঠিক তেমনি জোর পূর্বক চাপিয়ে দেয়া যায় না কোনো সমাজের নিয়ম। তার যথেষ্ট প্রমান পাই আমরা সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতন্ত্র থেকে। মহান অক্টোবর বিপ্লব যেমন পুঁজিবাদকে পাশ কাটিয়ে সামন্ততন্ত্র থেকে এক লাফে সমাজতন্ত্র কায়েম করেছিল, যে কারণে সমাজতন্ত্র ৭০ বছর টিকলেও আবার সেই পুঁজিবাদেই ফিরে আসতে হয়েছে। কার্ল মার্ক্সের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বিজ্ঞান হিসেবে সেই দাবিই করে আসছে যে কোনো সামাজিক স্তরকে পাশ কাটিয়ে নয় বরং তা সমাজের অমোঘ নিয়মেই বা অটোম্যাটিক্যালি বা বিবর্তনের ধারাই একটু একটু করে আমরা সমাজতন্ত্রের পথেই চলে যাবো।
সভ্যতার বিবর্তন অনুযায়ী সমস্ত মানবগোষ্ঠীর মধ্যেই বর্বরযুগের আগে এসেছে বন্যযুগ এবং সভ্যযুগের আগে এসেছে বর্বরযুগ। সমগ্র মানবজাতির উৎস এক, অভিজ্ঞতা এক, প্রগতির পথও এক। সমগ্র মানবজাতির উদ্ভব হয়েছিল একই প্রক্রিয়ায়, অগ্রগতির একই স্তরে মানুষের চাহিদা সর্বত্রই এক এবং সমাজের একই অবস্থায় মানব কার্যকলাপ সর্বত্রই এক। না, কোনরকম অতিরঞ্জিত বা কল্পিত কোন ব্যাপার নয়, আজ যথেষ্ট দৃঢ় প্রমাণ সহযোগেই একথা ঘোষণা করা যায়।
সমগ্র মানবজাতির প্রত্যেকটি শাখা সম্পূর্ণ পৃথকভাবে বিকাশের যে যে অবস্থাতে উন্নীত হয়েছে এবং বিকাশের প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে আসার জন্য যে সকল অপরিহার্য পর্যায়গুলিকে অতিক্রম করতে হয়েছে তা ঐতিহাসিক ভাবে সর্বত্রই এক এবং একইরকম হতে বাধ্য। বর্বর অবস্থার মধ্যযুগে আর্য আর সেমিটিকরাই (মিশরীয় সভ্যতা) এগিয়ে যেতে আরম্ভ করেছিল। কলোম্বাস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করেন সেইসময় সভ্যথার নিরিখে আমেরিকান ই-িয়ানরা ব্রোঞ্জ আবিষ্কার প্রায করে ফেলেছে। যখন এশিয়াটিক ও ইউরোপীয় মানবগোষ্ঠী কিনা লোহার যন্ত্রপাতি আবিস্কারের মুখে। যেহেতু মানবসভ্যতার অগ্রগতির হিসাবে লৌহ্যযুগ থেকে ব্রোঞ্জযুগ প্রায় চার হাজার বছরের কনিষ্ঠ, অতএব, আমেরিকান ই-িয়ানরা অগ্রগতির হিসাবে আর্যদের তুলনায় সভ্যতায় চার হাজার বছর পিছিয়ে ছিল। যেখানেই মানবসভ্যতার বন্য অবস্থার মধ্য বা নিন্মস্তর পাওয়া গিয়েছে সেখানেই পূর্ণভাবে দলগত বিবাহ হয় বর্তমান ছিল কিংবা এমন কিছু চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গিয়েছে যার থেকে বোঝা গিয়েছে তাদের মধ্যে কিছুকাল পূর্বেও দলগত বিবাহ প্রচলিত ছিল। সুতরাং, মানব-ইতিহাসের এই পর্বে এই বিবাহ স্বাভাবিক ছিল।
প্রাচীন গোত্রগুলিতে মাতৃকূল অনুযায়ী বংশপরস্পরা নির্ধরিত হত। মাতৃকূল অনুযায়ী বংশপরস্পরা ততদিনই প্রচলিত ছিল যতদিন পর্যন্ত যে ভ্রুণটি নারী তার গর্ভে ধারণ করেছে সেই ভ্রুণের জন্মদাতা পুরুষটি কে তা জানার উপায় ছিল না। এর থেকে এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই নেওয়া যায় যে, তখন এক পুরুষের সাথে এক নারীর বিবাহের রীতি প্রচলিত ছিল না। পরবর্তীকালে বর্বরযুগের উচ্চ অবস্থায় যখন সিনডায়াসমিয়ান বা জোড় বাঁধা পরিবার অর্থাৎ এক পুরুষের সাথে এক নারীর বিবাহের নিয়ম সমাজে দৃঢ় হল তখন বংশধারার পরিচয় মাতৃকূল থেকে পিতৃকুলে পরিবর্তিত হয়েছিল। যদিও জোড় বাঁধা পারিবার ভিত্তিক বিবাহের শুরুটি সম্পূর্ণ হতে সময় লেগেছে তিনটি জাতিতাত্বিক-যুগ (বঃযবহরপৎষ)-এর।
পূর্ব রোমীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ‘কনষ্টান্টিনোপাল’ থেকে মাঞ্চুদের রাজধানী ‘পেকিং’ পর্যন্ত সম্রাটদের হারেমের মধ্যে যেসব ব্যবস্থা ছিল এবং লীলা ও কাণ্ড সংঘটিত হত, সামন্ততান্ত্রিক যুগের হিন্দু রাজাদের রাজ-অবরোধেও যে তাহার ব্যতিক্রম ঘটে নাই তাহা সংস্কৃত সাহিত্য পাঠেই অবগত হওয়া যায়।
মিশরে পিরামিডগুলিতে মৃত মানুষের জন্য খাদ্য-পানীয় মজুত রাখা এবং আমাদের শ্রাদ্ধ ও পিতৃতর্পণে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে আহারাদি প্রদানের রীতি মানবসভ্যতার একটি অবস্থার একই অনুর্বর মস্তিষ্কের ভাবনা প্রসূত।
হিন্দুর বিবাহ-পদ্ধতির বিবর্তনের সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশসমুহের বিবাহ-পদ্ধতির বিবর্তনেরও মিল রয়েছে। সম্প্রদান, পাণিগ্রহণ, সপ্তপদী গমন, বিবাহকালে বর-কনের মস্তকে লাজ বর্ষণ প্রভৃতি কতকাংশে ই-ো-ইউরোপীয় জাতির অতি আদিমকালের রেওয়াজ প্রসূত।
অতীত ছেড়ে যদি বর্তমানে আসা যায়, তাহলেও এমন বহু মিল চোখে পড়বে। যেমন, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে একক পরিবারের বহুল প্রচলন। আমার ছেলেবেলাতেও দেখেছি, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়া পরিবারিক-সম্মান হানিকর বলে গণ্য হত। কোন পরিবার পৃথকান্ন হওয়া গ্রাম্য চর্চার একটি মুখরোচক বিষয় ছিল।
কিন্তু, নিয়তি কেন বাধ্যতে। সভ্যতায় উত্তরণের ধাপ-পরস্পরাকে অমান্য করবে কে? সুতরাং ইউরোপে যা ঘটেছিল তাই-ই ঘটেছে এইদেশে - দেড়/দুশো বছরের ব্যবধানে। একান্নবর্তী পরিবার আদতে মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনেরই ক্রমশঃ ক্ষয়িত বিবর্তিত রূপ। যার মোহ এখনও কিয়দংশে রয়ে গিয়েছে।
সব, সবকিছুর বিবর্তন বা ক্রমবিকাশই প্রকৃতির নিয়ম। মানবসভ্যতা থেকে মানবসৃষ্টি কোনটিই এর ব্যতিক্রম নয়। বিবর্তনের নিয়মেই কোনকিছুই একেবারে হয় না। দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমশঃ পরিবর্তিত হতে হতে এক একটি রূপ পরিগ্রহ করে। সভ্যতার বিবর্তন ঠিক কিভাবে ঘটেছে তা পাঠক/পাঠিকাদের সম্যক বোঝাতে মানবসভ্যতায় সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বিবর্তন বিষয়ে একটু আলোচনা করব।
আদিতে সমাজ যখন মাতৃতান্ত্রিক তখন সম্পত্তি থাকত মায়ের হাতে। সেই সম্পত্তি মা থেকে বর্তাত মেয়েতে। তারপর যখন পুরুষতন্ত্রের সূত্রপাত হতে শুরু করল তখন সম্পত্তির অধিকারী হল পুরুষ, কিন্তু পিতা নয়। মায়ের বদলে মামা। মামা থেকে হস্তান্তরিত হত ভাগ্নেতে। এইভাবে বিবর্তিত হতে হতে সম্পত্তির অধিকার পেয়েছে পিতা। পিতা থেকে তা বর্তেছে পুত্রে।
মানবসভ্যতা এগিয়েছে নিজের গরজে, কারও অঙ্গুলি হেলনে বা পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট করে রাখা পথ ধরে নয়। আজও তাই চলে। আজ থেকে একশত বছর পরে মানবসভ্যতার রূপ ঠিক কি হবে জানার কোন উপায় নাই। বলতে পারবে একমাত্র সময়। আর কেউ নয়।
মানবসভ্যতার মতোই একই নিয়মে ও একই উপায়ে এগিয়েছে সৃষ্টি। বিবর্তন এবং বিবর্তন ও বিবর্তন।
জড় থেকেই জীবের উৎপত্তি। জড় থেকে প্রথমে জড়ত্বের প্রাণ প্রতিষ্ঠা তারপর প্রাণ-জড়ত্বের জীবে বিবর্তন। জড়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল উদ্ভিদে। উদ্ভিদ প্রাণী কিন্তু জীব নয়। প্রাণ থাকলেও উদ্ভিদকে জড় পদার্থ বলেই মনে হবে। এবং তার মধ্যে জড়ত্বের ভাব এতই প্রবল যে জগদীশচন্দ্র বোস এই সেদিন প্রমাণ করে না দেখানো পর্যন্ত বিজ্ঞানীরাও উদ্ভিদকে প্রাণী বলতে স্বীকৃত ছিল না। সুতরাং জড় থেকে প্রাণীতে বিবর্তনের মধ্যবর্তী স্তর উদ্ভিদ। যেটি জড় ও প্রাণের উভরূপ। প্রাণ-জড়ত্ব থেকে জীবে বিবর্তনেরর উভরূপ প্রকৃতিতে আজও বর্তমান। যার নাম ভাইরাস।
ভাইরাসের দুই অবস্থা - জড় ও জীব। দুই অবস্থাতেই ভাইরাস দিব্যি বেঁচে থাকে। কেলাসে পরিণত হয়ে দীর্ঘকাল জড় অবস্থায় থেকে গিয়েও আবার উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই পুনরায় সজীব হয়ে ওঠে ও বংশবিস্তার করতেও সক্ষম হয়।
সুতরাং, খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আদিতে জড় থেকেই পৃথিবীতে এসেছে প্রথমজীব এবং তা ছিল ভাইরাস জাতীয় অর্ধজড় অর্ধজীব।
জড়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠার আঁতুড়ঘর জল। জল থেকেই জীব উঠে এসেছিল স্থলে, উড়েছিল আকাশে। প্রথমে জলচর, তারপর জল থেকেই ক্রমান্বয়ে স্থলচর ও খেচর।
জলজ প্রাণী বিবর্তিত হয়ে যখন পাখনাযুক্ত মাছের উৎপত্তি হল, তখন সেই পাখনাযুক্ত মাছ থেকেই বিবর্তিত হয়ে একদিকে হল স্থলচর অন্যদিকে খেচর বা পাখী। পাখনাযুক্ত মাছের দু-জোড়া পাখনা - একজোড়া মাথার কাছাকাছি, অন্যজোড়া লেজের সন্নিকটবর্তী। এই দু-জোড়া পাখনা বিবর্তিত হয়ে স্থলচরের চারটি পা হয়েছে এবং পাখীর দুটি পা ও দুটি ডানা। চারপেয়ের সামনের পা-জোড়া মাছের মাথার দিকের পাখনার ও পিছনের পা-জোড়া লেজের দিকের পাখনার বিবর্তিত রূপ। একইভাবে সামনের ও পিছনের জোড়া-পাখনা থেকে যথাক্রমে একজোড়া ডানা ও একজোড়া পা পেয়েছে পাখী।
না, কে কবে অনুগ্রহ করে তাঁর ইচ্ছার উ্দ্েরক হলে হাজার কয়েক জলচর, হাজার কয়েক স্থলচর ও হাজার কয়েক খেচর জাতি-প্রজাতির এক একজোড়া করে অঙ্ক কষে কষে পাঠিয়ে (সঙ্গে কয়েক লক্ষ জাতি-প্রজাতির উদ্ভিদও রয়েছে) পৃথিবীতে জীব সৃষ্টি করে সৃষ্টিকর্তার আসনটি অলঙ্কৃত করেছেন এমন ভাবনা অতি বড় কাল্পনিকের কল্পনাতে আসবে না (একমাত্র বদ্ধ উন্মাদ ভিন্ন)। তাই যদি হত, তাহলে উদ্ভিদরা কি এমন পাপ করেছিল যে, সৃষ্টিকর্তা প্রাণ দিয়েও তাদের জড়ভরত করে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন? বেচারা গাছ, তখনই ছাগলে মুড়ে খাচ্ছে, তখনই ডাল কেটে ফেলছে - এতবড় মহীরূঢ় হয়েও কাউকে বাধা দিতে অক্ষম। জীবের কথাই ধর, সৃষ্টিকর্তা কতবড় একচখো - যেখানে গাছের মুড়িয়ে ফেলা পাতা, কেটে দেওয়া ডাল পুনরায় গজিয়ে উঠছে, সেখানেই জীবের একটি পা কাটলে তাকে তিন-পেয়ে হয়েই সারাজীবন কাটাতে হচ্ছে। এইরকম দু-মুখো নীতি নিয়েও তিনি নাকি সুক্ষ-বিচারক!