কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে কয়েক দফা বন্যা আর ভারি বৃষ্টিতে আমন চাষে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষকরা। ধার-দেনা-ঋণ করে করা আমনের এমন ক্ষতিতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তারা।
উজানের ঢল ও অতি বৃষ্টির পানিতে জুন মাস থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পরপর পাঁচ দফা বন্যায় উপজেলার রায়গঞ্জ, বামনডাঙ্গা, বেরুবাড়ী, নুনখাওয়া, নারাণপুর, বল্লভেরখাষ, কচাকাটা, কেদার ইউনিয়ন এবং নাগেশ্বরী পৌরসভার বেশ কছিু এলাকা প্লাবিত হয়। তলিয়ে যায় ইরি, আউশ ধান, পাট, ভুট্টা, কাউন, চিনা, তিল ও মরিচসহ চিনাবাদাম ও সবজি ক্ষেত। এতে হতাশ কৃষকরা। আর এই ক্ষতিতে খাদ্য ঘাটতির আসঙ্কাও রয়েছে এমনকী গৃহপালিত পশুর খাদ্য নিয়েও দুশ্চিন্তার অন্ত নেই তাদের। এ অবস্থায় সরকার সহায়তা না করলে আগামী মৌসুমে জমি পরিত্যক্ত থাকার শঙ্কায় কৃষকরা।
তথ্য বলছে, প্রথম দফা বন্যায় তেমন ক্ষতি না হলেও শেষ দু’দফায় নাগেশ^রী উপজেলায় ৬হাজার ৫৫হেক্টর আমন আবাদ নিমজ্জিত হয়েছে। এদিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় জেলায় ১৭ হাজার ৫৫৬ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। পানি নেমে যাওয়ার পর ১১হাজার ৬শ ৬২হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলে নিরুপন করে কৃষি বিভাগ। এর মধ্যে আমন বীজতলা ১হাজার ৪শ ৯হেক্টর, আউশ ৫হাজার ২শ ১৭হেক্টর, সবজি ৯শ ৫৩হেক্টর, পাট ৯হাজার ২শ ৩৫হেক্টর, তিল ৩শ ৫হেক্টর, মরিচ ২শ ৫হেক্টর ও চিনা ১শ ৪০হেক্টর ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় এ দুই মিলে ১লাখ ৩৪হাজার ৮শ ৫৮জন কৃষকের মোট ১শ ৪০কোটি ৬৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। তৃতীয় দফা বন্যা শেষে জেলার ২৭হাজার ৭শ ৬১জন কৃষককে সবজি বীজ, ১শ ৫টি কমিউনিটি বীজতলা ও শতাধিক ভাসমান বীজতলা এবং ১শ ১২টি ট্রে বীজতলা প্রস্তুত করে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে আমন চারা বিতরণ করে কৃষি বিভাগ।
নাগেশ্বরী পৌরসভার রুইয়ারপাড় এলাকার দিনমজুর হাসানুল হকের স্ত্রী নছিরণ বেগম জানায়, নিজস্ব আবাদি জমি না থাকায় বর্গা নিয়ে সাড়ে ৩ বিঘা জমিতে ধানের চাষ শুরু করেন তারা। ৩য় ও ৪র্থ দফা বন্যায় তা নষ্ট হয়ে যায়। পরে ধার-দেনা করে রামখানা ইউনিয়নের নাখারগঞ্জ এলাকা থেকে ধানের চারা কিনে আবারও চাষাবাদ শুরু করে স্বপ্ন দেখেন ক্ষতি পুষিয়ে নেবার। কিন্তু তাও ৫ম দফা বন্যায় পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। ২ বারে তাদের খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। এ আবাদ নষ্ট হওয়ায় সামনে ঘরে খাবার থাকবে তাদের। বল্লভেরখাষ ইউনিয়নের মার্জিয়া বেগম জানান, প্রথম দফার বন্যায় ৪ বিঘা কাউন আবাদ নষ্ট হয়েছে। পরে চড়া দামে আমন চারা কিনে ২বিঘা জমিতে লাগানোর পর বন্যায় আবারও নষ্ট হয়। সামনের দিনগুলোতে কেমনে চলবে পরিবার এ দুশ্চিন্তায় দিন কাটে তার। কচাকাটার কৃষক আবদুল বাতেন জানান, ‘প্রথম বন্যায় ১৫বিঘা পাট নষ্ট হয়। পরে ধানও পঁচে যায়। অনেক ঋণে পড়েছেন তিনি। ফসল নেই শোধ কেমনে হবে এ চিন্তায় ঘুম আসে না। বলেন, সরকারি সহায়তা না পেলে আাগামী মৌসুমে আবাদ করার সামর্থ্য নেই। সবজি চাষি আতোয়ার জানান, ৩ বিঘা জমির মুলা ও লাল শাক অতিবৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে। এতে তার ক্ষতি প্রায় ৩০হাজার টাকা।
ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার স্বপ্ন নিয়ে কৃষি বিভাগের সহায়তা ও নিজেদের প্রচেষ্টায় নতুন করে আমনের চারা লাগানোর পর আবারও অতি বৃষ্টিতে শুরু হয় বন্যা। সেপ্টেম্বর মাসে দুই দফা বন্যা একই সাথে ভারি বৃষ্টিতে নিচু এলাকার আমনের আবাদ আবারও তলিয়ে গেলে উঠতি আমন ধানের চারা পানির নিচে তলিয়ে থাকায় অনেক আবাদ পঁচে নষ্ট হয়।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে এবারের বন্যায় উপজেলায় ৬ হাজার ৫৫ হেক্টর রোপা আমন আবাদ পানিতে নিমজ্জিত হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম দফা বন্যায় সম্পূর্ণরুপে ক্ষতি হয় ৩ হাজার ৫শ ৫৭ হেক্টর জমির রোপা আমন। এছাড়াও মাসকলাই ১শ ১৫ হেক্টর এবং শাকসবাজি ২৮ হেক্টর।
এ অবস্থায় মূলধন হারানোর শঙ্কায় থাকা কৃষকরা বলছেন সরকারিভাবে সহায়তা না পেলে আগামী মৌসুমে কোন আবাদই তারা করতে পারবেন না অর্থের অভাবে। তাই সরকারি প্রণোদনা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্থরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাজেন্দ্রনাথ রায় বলেন, কৃষকদের সহযোগিতা চেয়ে দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই প্রণোদনা হিসেবে সরিষা, ভূট্টা, বোরো ধান, গম ও সূর্যমুখীর বীজ এসে পৌঁছবে। আসলেই কৃষকদের বিতরণ করা হবে।