করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ঝিনাইদহের এক চিকিৎসক দম্পতি। পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই, নেই কোনো ভ্যাকসিন কিংবা কার্যকরী ওষুধ। তবুও কোভিড-১৯ নামের অদৃশ্য এক প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন নবীন চিকিৎসকরা। তাদেরই একজন ডাক্তার শামীমা শিরিন লুবনা ও তার স্বামী ডাক্তার আব্দুল্লাহিল কাফি। একমাত্র সন্তানকে বাড়ি রেখে দিন-রাতের অধিকাংশ সময় মানব সেবায় ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন তারা। মানবসেবার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ডাক্তার শামীমা ও কাফি দম্পতি। করোনা রোগীদের সেবায় কাজ করতে গিয়ে তিন তিন বার করোনা পজেটিভ হয়েছে। করোনা পজেটিভ হলেও আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টাইনে থেকেও রোগীদের সেবা ও হাসপাতালেল অফিসিয়াল কাজ করেছেন। স্বামী সন্তানকে আলাদা রেখে মানুষের সেবাই কাজ করেছেন। শামীমা শিরিন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে কাফি ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে সার্জারী বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। কাজের প্রতি তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, একাগ্রতা, ধৈর্য্য ও সাহসিকতা অতুলনীয়।
শামীমা শিরিন কালীগঞ্জে যোগদানের পর থেকে স্থানীয় চিকিৎসা সেবায় এসেছে অমূল পরিবর্তন। মাত্র দশ মাসে স্থানীয় রোগীদের হাসপাতালমুখি করেছেন। হাতপাতালের উন্নয়নেও এনেছেন ব্যাপক পরিবর্তন। হাসপাতালের প্রসূতী, গাইনী এবং সার্জারী বিভাগের অপারেশন নিয়মিত করণ, কমপ্লেক্সের সামনে নতুন গেট নির্মাণ, বিভিন্ন স্থানে ডাস্টবিন স্থাপন, হাসপাতালে ফ্লু কর্ণার স্থাপন, স্যেন্দর্য বর্ধনে বাগান তৈরি, দর্শনার্থীদের জন্য ওয়েটিং রুম তৈরি, মেডিকেল অফিসারদের জন্য দুটি কোয়াটার মেরামত ও ডেন্টাল ইউনিটের জন্য নতুন যন্ত্রপাতি কেনাসহ নানা উন্নয়ন মূলক কাজ করেন। এখন আর মানুষ বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনীকগুলোতে যেতে চায় না। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করেন। ডাক্তার শামীমা ১৯৯৮ সালে জেলার কালীগঞ্জ শহরের ছলিমুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও একই শহরের মাহতাব উদ্দীন ডিগ্রী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন খুলনা মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে পাশের পর ২৮তম বিসিএস দিয়ে স্বাস্থ্য ক্যাডারে চুড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন। এরপর চিকিৎসক হিসাবে মানবসেবার ব্রত নিয়ে প্রথমে যোগদান করেন তার শৈশবের স্মৃতি বিজড়ীত কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সহকারী মেডিকেল অফিসার হিসাবে। এরপর টাঙ্গাইল, নাটোর ও ঝিনাইদহ সদর হয়ে আবারো জন্মস্থান কালীগঞ্জে আসেন। তবে, এবার মেডিকেল অফিসার নয়, থানা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করেন। যোগদানের মাত্র তিন মাস পর শুরু হয় বিশ^ব্যাপী করোনা আতঙ্ক। এরপর আমাদের দেশেও ধরা পড়ে করোনা রোগী। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে শতর্ক থাকতে বলা হয়। প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেওয়া হয়। বেড়ে যায় দ্বায়িত্ব কর্তব্য আর ব্যস্ততা। দেশে করোনা সংক্রমের শুরুতেই আইইডিসিআর’র নির্দেশনায় চলতে থাকে কার্যক্রম। এরপর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কয়েক দফা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শুরু হয় হাসপাতালের নিয়মিত ডিউটির পাশাপাশি চিকিৎসা নিতে আসা লোকদের করোনা সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা, করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা লোকদের নমুনা সংগ্রহ করা, তাদের প্রাথমিক চিকিৎসাপত্র দেওয়া, শনাক্তকৃত রোগীদের হাসপাতাল অথবা বাসায় (আইসোলেশন/ কোয়ারেন্টাইন) চিকিৎসার বিষয়ে নানা সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ প্রদানের কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে থাকেন। এতকিছুর মধ্যেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, মিডিয়াকর্মী, রোগী ও তাদের স্বজনসহ আরো অনেকের সাথে কথা বলতে হয়, তথ্য দিতে হয়। পরম ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার সাথে সামাল দিচ্ছেন ডা. শামীমা শিরিন। অন্যদিকে তার স্বামী ডা. কাফি ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে সুনামের সাথে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। তার স্বামী কাফির শরীরেও দু’বার করোনা পজেটিভ হয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলার হাসপাতালে এখনো ৪৩১ করোনা রোগী সনাক্ত হয়েছে। নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষা করা হয়ছে ৭ হাজার ৯শত ৩৬ জনের। ফলে রোগী বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়েই বেড়েছে ব্যস্ততা ও কাজের পরিধি। এরমধ্যে উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের কমিউনিটি ক্লিনীক দেখতে হয়। ফলে অবিরাম পরিশ্রমের ফলে শারীরিকভাবে কাতর হলেও মনের জোরটা এখনো ধরে রেখেছেন।
ডাক্তার শামীমা শিরিন বললেন, চাকুরি বলে নয়, মানবিক কারণে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কাজ করে যাচ্ছি। টানা ডিউটির পর বাসায় গেলে জরুরী প্রয়োজনে আবারও আসতে হয়। সেটা দিনে হোক আর গভীর রাতেই হোক। কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে, কখন দিন যায়, রাত পার হয় তা অনেক সময় টের পাই না। সবচেয়ে বেশি মিস করি আমাদের সন্তানকে। খারাপ লাগে, ক্লান্তিও আসে, আক্রান্তের ঝুঁকিও আছে, তবুও এখান থেকে পিছু হটার সুযোগ তো নেই। মানবসেবার ব্রত নিয়েই তো এমন পেশায যোগ দিয়েছি।