নদীর নাব্য সঙ্কট, তীব্র পানির ¯্রােত আর নষ্ট ফেরির কারণে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো ফেরিঘাটেই কয়েক মাস ধরে এশরকম অচলাবস্থা বিরাজ করছে। তাছাড়া প্রবল স্রোতে ঘাট ভেঙ্গে যাওয়ার কারণেও ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ফলে ফেরিঘাটগুলোর দু’পাড়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। আর যানবাহনসহ যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকতে হয়। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ মুমূর্ষ রোগী পারাপারেও বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। মূলত দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীগুলোতে ভারতের উজান থেকে প্রতিবছর ১২০ কোটি টন পলি এসে পড়ছে। তার মধ্যে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ ভাগ পলি ড্রেজিং করা হয়। সেজন্য দ্রুত সময়েই নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে হচ্ছে। ফলে নাব্য সঙ্কটের সৃষ্টি হচ্ছে। যা দিন দিন আরো প্রবল হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ এবং ফেরিঘাট সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলো মধ্যাঞ্চলমুখী হওয়ার কারণে পলি সাগরে যাওয়ার সুযোগ নেই। পাশাপাশি নদী ভাঙ্গনের কারণেও মাটিতে নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। সাধারণত ভাঙ্গনপ্রবণ নদীগুলোতে স্রোত বেশি হয়ে। তাতে দ্রুত পলি ছড়িয়ে যায়। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নদীগুলোতে পানি বেশি হয়। তখন স্রোত অস্বাভাবিক হওয়ায় দ্রুত পলি এসে জমা হয়। অথচ নদী ভাঙ্গন রোধ করা যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, দেশের ৯টি ফেরিঘাটে এখন ৫০টি ফেরি চলাচল করছে। তার মধ্যে বেশিরভাগই পুরনো। কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে ওসব ফেরি সচল রেখে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। ফলে মেরামত করার দিনই ফের ফেরি নষ্ট হওয়ার অহরহ নজির রয়েছে। তবে বিদ্যমান ফেরিঘাটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৪টি ঘাট হচ্ছে পাটুরিয়া (দৌলতদিয়া), পাটুরিয়া (কাজিরহাট), মাওয়া (শিমুলিয়া-চরজানাযাত), চাঁদপুর (শরীয়তপুর), ভোলা (লক্ষীপুর)। পাটুরিয়া মাওয়া ঘাট হয়ে ঢাকা থেকে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার মানুষ সড়কপথে চলাচল করে। কিন্তু পাটুরিয়ায় তীব্র স্রোতের কারণে প্রায়ই ফেরি পারাপার ব্যাহত হয়। মাওয়ায় উল্টো সমস্যা, সেখানে নাব্য সঙ্কটের কারণে আটকে যায় ফেরি। বিগত ৫ মাসের প্রায় প্রতিদিনই গুরুত্বপূর্ণ সবকটি ফেরিঘাটে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে কখনো তা বেশি, আবার কখনো কম। এমনকি বেশি স্রোতের কারণে টানা সপ্তাহব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ঘাটে দুর্ভোগের চিত্রও লক্ষ করা গেছে। বর্তমানে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট পার হতে দুই ধাপে প্রতিটি পণ্যবাহী ট্রাকের অন্তত ৩০ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। আর শিমুলিয়া কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে স্বল্প পরিসরে ফেরি চলাচল করায় পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌ রুটে যানবাহনের চাপ বেড়ে গেছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছোট গাড়ি ও পরিবহন বাস পারাপার করা হলেও আটকা পড়ে থাকছে কয়েকশ’ সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক। পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় যানবাহনের চাপ কমাতে সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে শিবালয় থানা পুলিশ ৭ কিলোমিটার আগেই আটকে দিচ্ছে। এসব ট্রাককে উথুলী সংযোগ পার হতে ১৩ থেকে ১৫ ঘণ্টা সময় লাগছে। সিরিয়াল অনুযায়ী ঘাট এলাকায় প্রবেশের পর ওজন স্কেল, টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ ও ফেরি পেতে সময় লাগছে আরো ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা। তাতে করে পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুট পার হতে আসা ট্রাক শ্রমিকদের ভোগান্তি বেড়েছে। সম্প্রতি টানা দুদিন শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। পদ্মার লৌহজং ও শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে উজান থেকে নেমে আসা পলিতে চ্যানেলে নাব্য-সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করায় ওই নৌপথে ছোট-বড় সব ফেরি এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। আর এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ বলছে, ১৩টি ড্রেজার দিয়ে পলি অপসারণের কাজ চলছে। তারপরও ধারণা করা হচ্ছে নাব্য-সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে আরো সময় লাগবে।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, ফেরিঘাট সচল রাখতে দ্রুত আধুনিক ও শক্তিশালী ফেরি কেনা প্রয়োজন। একই সাথে নদীর নাব্য রক্ষায় নিয়মিত ড্রেজিং করার পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলোতে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া দরকার। পাশাপাশি নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নেয়াও জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার দেশে দীর্ঘ মেয়াদী বন্যা হয়েছে। ফলে ঘাটগুলোতে দুর্ভোগ বেড়েছে বেশি। এখন প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে এ বছর বর্ষা একটু আগে ভাগেই এসেছে। আবার শেষ হচ্ছে দেরিতে। অর্থাৎ শীত মৌসুম উকি দিলেও বৃষ্টিপাত থামছে না।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে মাওয়া ঘাটে সমস্যা আরো বেড়েছে। কারণ সেতুর ক্ষতির আশঙ্কায় পিলারের চারপাশে জমে থাকা বালু ড্রেজিং করতে দেয়া হচ্ছে না। ব্যবহার করা যাচ্ছে না পাশের চ্যানেলটিও। ফলে ওই ঘাটের ফেরিগুলোকে ঘুরে যেতে হচ্ছে এবং বারবার নাব্য সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। যদিও রো রো ফেরিতে সবচেয়ে বেশি যান পারাপার করা যায় কিন্তু নাব্য সঙ্কটের কারণে এখন টানা ফেরি (ছোট ফেরি) চলাচল করছে। ফলে ঘাটে যানবাহন পারাপার স্বাভাবিক না হওয়ায় যানজটের ভোগান্তি বাড়ছে। এমন অবস্থায় দেশের সকল ফেরিঘাট সচল রাখার জন্য সবার আগে নিয়মিত ড্রেজিং নিশ্চিত করার পাশাপাশি পলি অপসারণ জরুরি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিটিসি) আরিচা কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. সালাম হোসেন জানান, শিমুলিয়া কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে স্বল্প পরিসরে ফেরি চলাচল করায় এ রুটে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। ছোট গাড়ি ও পরিবহন বাসের চাপ কম থাকলেও ঘাট টার্মিনালে ৩শ’ সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুটে ১৭টি ফেরি দিয়ে যানবাহন ও সাধারণ যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে।