একসময় খরস্রোতা এক নদীর নাম ছিল বড়াল। তবে এখন অনেকটাই নাব্যতা হারিয়েছে। যৌবনের চিহ্ন হারিয়েছে অনেক আগে। এবার কার্তিক মাসেই বড়ালের উৎপত্তিস্থল পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।
বড়াল পদ্মার শাখা নদী। রাজশাহীর চারঘাটে বড়ালের উৎপত্তিস্থল। বড়াল পদ্মা থেকে বেরিয়ে আঁকা-বাঁকা পথে চারঘাট, বাঘা, বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম উপজেলার মধ্য দিয়ে পাবনা পেরিয়ে সিরাজগঞ্জে যমুনায় মিলিত হয়েছে।
কয়েক যুগ আগেও বড়ালের যৌবন ছিল। এ নদী বর্ষা মৌসুমে বন্যায় কানায় কানায় পূর্ণ হতো। প্রখর স্রোত ছিল। কোন কোন সময় দূ’কূল বন্যায় প্লাবিত হয়ে পলিমিশ্রিত পানি বিভিন্ন মাঠে প্রবেশ করতো। কৃষকরা পলিমিশ্রিত উর্বর জমিতে দ্বিগুণ ফসল ফলাতো। সারাবছর জেলেরা নদীতে ছোট বড় মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে স্বাচ্ছন্দে সংসার চালাতো। বিভিন্ন জায়গায় পণ্য বোঝায় বড় বড় পালতোলা নৌকা যাতায়াত করতো। নৌকাবাইচ হতো। কিশোর-কিশোরীরা আনন্দে সাঁতার কাটতো।
সেই দিনগুলো ক্ষীণ হয়ে আসে ১৯৮০ সালের দিকে। স্লুইস গেট দেওয়ার পর বড়াল তার খরস্রোতা রূপ হারায়। আর এখন দখলে বড়াল হয়ে উঠেছে সরু নালা। ২০১০ সালে নদী খননের নামে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নেওয়া ১৩ কোটি টাকার প্রকল্প কোনো কাজে আসেনি। নদী খনন করে সেই বালু নদীতে স্তূপ করে রাখার কারণে বন্যার পানিতে তা আবার নদীতে চলে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে পানি উন্নয়ন বোর্ড ‘বড়াল বেসিন প্রকল্প’ নামে বিভিন্ন অবকাঠামোসহ নদী খনন কাজ শুরু করে। প্রকল্পটির কাজ শেষ হয় ২০০৪-০৫ অর্থবছরে। এই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন রেগুলেটর, অবকাঠামো, খাল ও নদী পুনঃখননের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ২০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করে মূল্য বাবদ ৭৬ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ভূমি মালিকদের পরিশোধ করা হয়। তার পরেও নদী তীরবর্তী এলাকা দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, বড়াল নদীর আশপাশে যারা বসবাস করছেন, তারা নদী দখল করে সেখানে ধান চাষ করেন। প্রভাবশালীরাও আছেন এই তালিকায়। ফলে মূল পদ্মা থেকে পানি যাতে বড়ালে আসতে না পারে সেজন্য মাটি ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, বড়ালে পদ্মার পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে এবং নাব্য ফিরিয়ে আনতে বড়াল নদীকে ঘিরে গত ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ‘নাটোরের নারদ ও মুসা খান (আংশিক) নদী ও রাজশাহীর চারঘাটের রেগুলেটরের ইনটেক চ্যানেল খনন’ নামে ১৩ কোটি ৩ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রায় ১৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার নদী খনন ও প্রবেশ মুখে খনন করতে এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চারঘাট বড়াল নদীর ইনটেক চ্যানেল খনন কাজ শেষ হয়। ইনটেক চ্যানেল খনন কাজ হলেও বড়ালের সুদিন আর ফেরেনি। এবার কার্তিক মাসেই বড়ালের উৎসমুখ পানিশূন্য হয়ে গেছে।
চারঘাট বড়াল নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বাদশা জানান, বিভিন্ন স্থানে স্লুইস গেট ও বাঁধ নির্মাণের ফলে বড়াল নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় নদীতে কিছু পানি জমলেও শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়। বিভিন্ন ভাবে দখল আর দূষণে এবার শুষ্ক মৌসুম আসার আগেই বড়ালের উৎসমুখ পানিশূন্য হয়েছে।
স্থানীয় শিক্ষক ফজলুর রহমান জানান, এই কার্তিক মাসেই বড়ালের উৎসমুখ পানিশূন্য হয়ে গেছে। সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করে নদীটি পুনঃখনন করা না হলে বড়াল নদী একদিন হারিয়ে যাবে মানচিত্র থেকে।