পরিবারের সুখের জন্য মালোয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান মো. মুখলেছ মিয়া (২৫)। সেই সুখ ভাগ্যে জুটেনি তার। মা, বাবা, স্ত্রী সন্তানের সাথে শেষ দেখাটাও করে যেতে পারেননি। আকস্মিক এক গাড়ি দূর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে যুবক মুখলেছের প্রাণ।
দেড় বছর পর শুক্রবার ভোরে মুখলেছ এসেছেন বাড়িতে। তবে জীবিত নয়, কফিনে মোড়ানো লাশ হয়ে। হাঁসির বদলে পাহাড় পরিমাণ শোকে কাতরাচ্ছেন মুখলেছের পরিবার। কফিনে জড়িয়ে স্ত্রী সন্তান ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে সেখানকার পরিবেশ। গ্রামের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুখলেছের মুখটি একটি এক নজর দেখার জন্য শতশত মানুষের ভীড়। সকলের চোখেই পানি। কী করূন ও নির্মম দৃশ্য! মুখলেছ উপজেলার দেওড়া গ্রামের বাটবাড়িয়া এলাকার মো. সাচ্চুর মিয়ার ছেলে। গতকাল সকালে দেওড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাযা শেষে মুখলেছের লাশকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
পারিবারিক ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া মুখলেছরা ৩ ভাই ও ২ বোন। সবার বড় মুখলেছ। ৭ সদস্যের পরিবারকে চালাতে খুবই কষ্ট হতো সাচ্ছু মিয়ার। তারপরও ছেলেকে পড়ানোর চেষ্টা করেছেন। বড় ছেলে হিসেবে পিতার কষ্ট মুখলেছকে ভাবিয়ে তুলে। মুখলেছ দেওড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল। একসময় মুখলেছ পরিবারের কষ্ট দূর করে সুখের স্বপ্ন দেখতে থাকে। তাই পড়ালেখা ছেড়ে দেড় বছর আগে পাড়ি জমায় মালোয়েশিয়ায়। সেখানে ‘নিউ সুসান’ নামের একটি কোম্পানীতে শ্রমিক পদে চাকরী পায়। মাস শেষে বেতন পেয়ে বাড়ি পাঠায়। ছেলের পাঠানো টাকা হাতে পেয়ে মনখুলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন তার মা বাবা। ইতোমধ্যে মুখলেছ দুই ছেলে সন্তানের জনক হয়। মালেয়েশিয়া প্রবাসী মুখলেছের বড় ছেলে দিশান (০৩) ও ছোট ছেলে রাফসান (দেড় বছর)।
একসময় দুই বোনকে বিয়ে দেয়। মা মাবা স্ত্রী সন্তান ও ছোট দুই ভাইকে নিয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দেই চলছিল মুখলেছের পরিবারটি। হঠাৎ করে একটি ঝড়ে তাদের পরিবারের সবকিছু তছনছ করে দিবে কে জানতো? গত ২৭ মে সোমবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা। কোম্পানীর গাড়িতে মালামাল লোড আনলোড করার সময় বেপরোয়া গতির একটি গাড়ি মুখলেছকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই মুখলেছের মৃত্যু হয়। মালেয়েশিয়ার মাটিতেই নিভে গেল মুখলেছ ও তার পরিবারের সকল আশা আর স্বপ্ন। বেলা ১টায় মুখলেছের মৃত্যুর সংবাদ পায় পরিবার।
আর্তচিৎকার আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে ওই বাড়ির পরিবেশ। মুখলেছের মরদেহটি দেশে আনতে কাজ শুরূ করেন পরিবার। সময় যেন কোন ভাবেই যাচ্ছিল না পিতা মাতা স্ত্রী সন্তানদের। মৃত্যুর ১৭ দিন পর শুক্রবার ভোরে মালোয়েশিয়া থেকে কফিন বন্দি হয়ে মুখলেছ এসেছেন। তার কফিনটি বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্র স্বজনদের আর্তচিৎকার আর আহাজারিতে প্রকম্পিত হতে সেখানকার আকাশ বাতাস। বুক ছাপড়িয়ে প্রতি মূহুর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মূর্ছা যাচ্ছে মুখলেছের মা আবেদা বেগম (৪৭) ও পিতা সাচ্ছু মিয়া। চিৎকার করে সক্সঘা হারাচ্ছেন মুখলেছের স্ত্রী রূমানা বেগম (২২)। শিশু দিশান ও রাফসান সকলের দিকে শুধু ফেল ফেল করে তাকিয়ে আছে। কারণ মৃত্যু কী সেটা বুঝার সক্ষমতা এখনো হয়নি তাদের। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন তার প্রিয় সহপাঠিরা। কী নির্মমতা? কী যে কষ্ট? অবুঝ শিশু ২টি এখনো জানে না বা বুঝে না যে চীর দিনের জন্য তারা হারিয়েছে ভরসার আশ্রয়স্থল পিতা মুখলেছকে। কী যে এক হৃদয় বিদায়ক দৃশ্য। শান্তনা দেয়ার ভাষা ও সাধ্য যেন কারোরই নেই। সকলের চোখেই পানি। শোকের ছাড়া নেমে আসে গোটা গ্রামে। গতকাল (শুকবার) সকাল ১০ টায় কয়েকশত লোকের অংশগ্রহণে জানাযা শেষে মুখলেছের মরদেহটি চীরদিনের জন্য দাফন করা হয়েছে বাড়ির পাশের কবরস্থানে।